leadT1ad

কেমন ছিল ৫ আগস্টে বন্দরনগরী

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হঠাৎ ফেটে পড়ে বিজয়ের উল্লাসে

স্ট্রিম সংবাদদাতাচট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ৫১
৫ আগস্টে বন্দরনগরী। স্ট্রিম ছবি

৫ আগস্ট ২০২৪। সোমবার। সকাল থেকেই এক অস্বাভাবিক নীরবতা চেপে বসেছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বুকে। চারপাশে থমথমে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সড়কে সেনাবাহিনীর টহল, মোড়ে মোড়ে পুলিশ, এলিট ফোর্স র‍্যাবের স্নাইপার ভ্যান, আর বিজিবির হুইসেলের শব্দ। সাধারণ মানুষ কার্যত ঘেরাটোপে বন্দি।

সকাল ৯টা পর্যন্ত শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট ফাঁকা। বন্দর, কর্ণফুলী ব্রিজ, নিউমার্কেট, আগ্রাবাদ, অক্সিজেন মোড়, গরিবুল্লাহ শাহ—সব জায়গায় শশ্মানের নীরবতা। দোকানপাট বন্ধ, গণপরিবহন উধাও।

ঠিক বেলা ১টা ৪০ মিনিট। চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি মোড়ে হঠাৎ করেই কিছু তরুণ-তরুণী ছুটে আসে হাতে জাতীয় পতাকা, কেউবা সাদা কাপড়ে লেখা ব্যানার হাতে। মুহূর্তেই ধ্বনিত হয়—‘পালাইছে, পালাইছে! শেখ হাসিনা পালাইছে!’

প্রথমে সবাই হতভম্ব। তারপর নিশ্চিত হয়, হ্যাঁ, একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। তখন দীর্ঘদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ, জমে থাকা কষ্ট, রাগ, অপমান সব ফেটে পড়ে চিৎকার হয়ে, কান্না হয়ে, হাসি হয়ে। কেউ মাটিতে বসে সিজদাহ করে, কেউ জড়িয়ে ধরে অচেনা প্রতিবেশীকে।

শহর জুড়ে বিজয়ের কান্না

চারপাশ থেকে ছুটে আসতে থাকে উল্লসিত মানুষ। প্রত্যেকের চোখ ছলছল। ঠিক সেই সময় বন্দরনগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কথা হয় অন্তত ১০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে।

বাকলিয়ার রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভাই, পুলিশের কত মার খাইছি, গালি খাইছি। আজ মনটা হালকা লাগতেছে। মনে হইতেছে, সত্যি স্বাধীন হইলাম।’

স্বাধীনতার নামে যে নারী দেশকে বন্দি করেছিল, তার পতন দেখলাম। এখন মরেও শান্তি—কথাগুলো বলেছিলেন খুলশীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন।

চট্টগ্রামের ফটো সাংবাদিক আজিম অননের সঙ্গে কথা হলে তিনি তাঁর গুম হওয়া বাবার কথা স্মরণ করেন। তাঁর বাবা থাকলে সেদিন খুশি হতেন, এটা জানাতেও ভুল করেননি তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান। তিনি ৫ আগস্ট খুব ভোরে ক্যাম্পাস থেকে বের হন আন্দোলনে যোগ দিতে। তাঁর লক্ষ্য ছিল কাজির দেউড়িতে যাওয়া। কারণ সেখানে নগরের ছেলেরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেখানে কোনোমতে পৌঁছাতে পারলেই হলো। ছদ্মবেশে রওনা দেন নোমান। তার মত অনেকেই ছদ্মবেশ ধারণ করেন। কারণ চারপাশে তখন গোয়েন্দা নজরদারি। সবাই যেন মৃত্যুকে পেছনে ফেলে চলে আসছিল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য।

তিনি বলেন, ‘দুপুরের পরপর যখন শহরে পৌঁছে খবর পেলাম শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছে, মনে হচ্ছিল গায়ের রক্ত চলাচল থেমে গেছে। আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়াটা ছিল একটা চিৎকার, যা শুধু প্রতিবাদ নয়, তা ছিল মুক্তির উল্লাস। আমি নিজে দাঁড়িয়ে বলেছি, ‘‘ভাইরা, আজকের দিনটা আমরা বইয়ের পাতায় রাখব না, বুকের ভেতর রাখব।’”

শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়েই রাস্তায়

৫ আগস্টের দুপুর শুধু সরকারের পতন নয়, একটি নিঃশ্বাস-আটকে-থাকা জাতির মুক্তির শ্বাস ফিরে পাওয়ার মুহূর্ত। একটি অধ্যায়ের অবসান, আরেকটি ইতিহাসের সূচনা। চট্টগ্রামের রাস্তায় লেখা সেই ইতিহাস আজও থমকে আছে কাজির দেউড়ির দেয়ালে, মানুষের চোখে, অশ্রুজলে।

সকালে প্রতিদিনের মতো আন্দোলনের জন্য বের হন নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। কিন্তু বিষয়টি যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য হাতে ছিল বাজারের ব্যাগ। যেন বাজার করতেই অলস কোনো ছেলে বাসা থেকে বের হয়েছেন। পুলিশের ভয় তো ছিলই। হয়তো ধরা পড়লে তাঁর আর ফেরা হতো না। পরিস্থিতি জটিল সাইফুল তা জানতেন। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ না দেখে তাঁরা কেউই বাসায় ফিরতে নারাজ। দেশজুড়ে তখন গুঞ্জন চলছে, হাসিনা পালাবে। কিছুক্ষণ পরেই সাইফুলসহ আন্দোলনকারী জানতে পারেন, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়েছেন। সাইফুল আরও জানান, সেই দৃশ্য, কান্না, হাসি তিনি সারাজীবনে ভুলবেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, এতদিনের ভয়, জুলুম সবকিছু যেন শেষ হলো। যে স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলনে এসেছিলেন তার প্রথম ধাপ যেন অতিক্রম করলেন তাঁরা।

শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়েই ঘর ছেড়েছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের শিবিরের সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল। তিনি বলেন, ‘ভয়, আটক, গুলি কিছুই থামাতে পারতো না আমাদের। সকাল থেকেই সব জনশক্তি নিয়ে সড়কে অবস্থান নিই। কেউ উত্তর পাহাড়তলী, কেউ অলঙ্কার মোড়, কেউ কাজির দেউড়ি আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম চূড়ান্ত ঘোষণা পাওয়ার জন্য।’

দুপুর ১টার পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন, তখন জুয়েলসহ তাঁর সহযোদ্ধারা কারও মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পান নি। সবাই কাঁদছিলেন, কেউ পতাকা নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমি বলছিলাম, ‘‘ভাইরা, আমরা পিছিয়ে যাইনি, আমরাই ছিলাম মৃত্যুর মুখোমুখি।” আজ যারা বলবে, এ তো শুধু একজন শাসকের দেশত্যাগ, তারা জানে না আমাদের বুকের ভেতর কত মৃত্যু নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই আনন্দ, এই স্বাধীনতা আমরা কাঁধে করে বয়ে এনেছি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত