leadT1ad

রংপুরে মব সহিংসতায় নিহত রুপলালের পরিবারে এখন ‘রাজ্যের দুশ্চিন্তা’

রংপুরের তারাগঞ্জে মব সহিংসতায় জামাতাসহ প্রাণ হারান রুপলাল রবিদাস। এখন তাঁর কিশোর ছেলে আপন রবিদাসকে শুরু করতে হচ্ছে পরিবারের জন্য উপার্জন। আপনের মা দুলালী রানী রবিদাস (৪০) বলেন, ‘একদিকে জমির মালিক চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। কোথায় যাব, কিভাবে বাঁচব। আমার ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু সংসারের দুঃখ তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন পথে।’

স্ট্রিম সংবাদদাতা
লালমনিরহাট
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৬
মব সন্ত্রাসে নিহত রুপলাল রবিদাসের পরিবার। স্ট্রিম ছবি

আপন রবিদাসের চোখে অশ্রু, হাতে মরিচাধরা জুতা সেলাইয়ের যন্ত্রপাতি। যে কিশোরের বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তাকে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে ফুটপাতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজের। মব সন্ত্রাসে বাবা রুপলাল রবিদাস (৪৭) প্রাণ হারানো পর সে-ই এখন সংসারের গুরুত্বপূর্ণ উপার্জনকারী মানুষ।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর ইউনিয়নের গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আপন (১২)। মঙ্গলবার দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে উঠানের এক কোণে বসে। বাবার পুরোনো ব্যাগ থেকে মরিচাধরা হাতুড়ি, সুই, ফর্মা, মাতুল, চাবি, বাটুল, কাঁচি, সুতো আর জুতা সেলাইয়ের চিমটা বের করে পরিষ্কার করছিল সে। তার বাবা অনেক আগে থেকে ফুটপাতে বসে জুতা মেরামতের কাজ করতেন। সেই কাজের যন্ত্রপাতিই আজ পরিবারের বেঁচে থাকার অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে।

বাবার পুরোনো ব্যাগ থেকে  জুতা মেরামতের জিনিসপত্র বের করছে আপন রবিদাস। স্ট্রিম ছবি
বাবার পুরোনো ব্যাগ থেকে জুতা মেরামতের জিনিসপত্র বের করছে আপন রবিদাস। স্ট্রিম ছবি

কাঁদতে কাঁদতে আপন বলে, ‘বাবার আশা ছিল আমাকে মানুষ করবে, পড়াশোনা শেখাবে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা মব করে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। এখন সংসারে খাবারই জোটে না। তবুও আমি স্কুলে যেতে চাই। পড়াশোনা করতে চাই।’

আপন পরিকল্পনা করছে ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করবে আর মাঝেমাঝে স্কুলেও যাবে। জুতা সেলাইয়ের কাজ করে যা রোজগার করছে, তা থেকেই সংসারের কাজে ও তার পড়াশোনার খরচও আসবে। আপন বলছে, ‘বাবা না থাকার যে কষ্ট, সেটা আমি বুঝতে পারছি। বাবা থাকলে আমাকে শুধু স্কুলেই যেতে বলতেন, আর পড়াশোনা করতে বলতেন। আমার ভাগ্যই নির্মম।’

আপনের বড় বোন পলাশী রবিদাস (১৬)। সে গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। চোখে-মুখে বিষাদের ছাপ, তবুও বুকভরা স্বপ্ন। সে চায় পড়াশোনা করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। পলাশী বলে, ‘যত কষ্টই হোক আমি এসএসসি পরীক্ষা দিব। কলেজে ভর্তি হব। তবে সবচেয়ে কষ্ট লাগে যখন দেখি আমার ছোট ভাই আপন স্কুল ছেড়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওরও পড়ার সুযোগ পাওয়া উচিত।’ কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে পলাশীর। নিজেকে সামলে আবার বলে, ‘আমাদের ঘর এতটাই ভাঙাচোরা যে বৃষ্টির পানিতে বিছানাপত্র ও আমার বই-খাতা ভিজে যায়।’

রুপলালের ব্যবহৃত সরঞ্জাম। স্ট্রিম ছবি
রুপলালের ব্যবহৃত সরঞ্জাম। স্ট্রিম ছবি

আপনের বড় ভাই দুলাল রবিদাস (২০)। তিনি ২০২১ সালে এসএসসি পাস করলেও আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি দারিদ্র্যের কারণে। এখন গ্রামের মাঠে কৃষি শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরির কাজ করেন। প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয়ের অর্ধেক যায় অসুস্থ মায়ের ওষুধে, বাকিটুকু পরিবার চালাতে। তারপরও কাজ জোটে না প্রতিদিন। ‘বাবার মৃত্যুতে আমরা অন্ধকারে ডুবে গেছি। ছোট ভাই পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু সংসার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কাজে। আমি অসহায়,’ চোখ ভিজে আসে দুলালের। জুতা সেলাইয়ের কাজ সেও জানে, গ্রামের বাজারে সংসার চালানোর মতো তেমন রোজগার হয় না।

আপনদের পরিবার যে ভিটেতে থাকে, তা অন্যের জমি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে জমির মালিক জায়গা ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ঘরের ফুটো হওয়া টিন দিয়ে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে, বিছানা ভিজে যায়। ঘর মেরামতের সামর্থ্য নেই তাদের। স্বামীর মৃত্যুর শোক ছাপিয়ে যাচ্ছে ছেলে-মেয়ে নিয়ে গোজার ঠাঁই করার দুশ্চিন্তা।

আপন রবিদাস। স্ট্রিম ছবি
আপন রবিদাস। স্ট্রিম ছবি

আপনের মা দুলালী রানী রবিদাস (৪০) বলেন, ‘একদিকে জমির মালিক চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। কোথায় যাব, কীভাবে বাঁচব। আমার ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু সংসারের দুঃখ তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন পথে।’

চলতি বছরের ৯ আগস্ট রাত ৯টার দিকে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বুড়িরহাট বটতলায় ভ্যানচোর সন্দেহে প্রদীপ লাল রবিদাস ও তাঁর শ্বশুর রুপলাল রবিদাসকে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত লোকজন। পুলিশের উপস্থিতিতেই মারধরে হত্যা করা হয় তাঁদের। নিহতদের মধ্যে প্রদীপ জীবিকা নির্বাহ করতেন ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালিয়ে, আর রুপলাল ছিলেন ফুটপাতে জুতা মেরামতকারী।

ওই ঘটনায় রুপলালের স্ত্রী মালতি রানী রবিদাস তারাগঞ্জ থানায় ৭০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত