আহমেদ আল আমীন
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি দাবি করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও রাজনীতিক এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা ও সমর্থনে মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হাসিনা একজন ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসকে হয়ে উঠেন।
আজ সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দি গ্রহণ করে। জবানবন্দি গ্রহণ অসমাপ্ত অবস্থায় শুনানি আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমানের দাবি, এদেশে মব কালচার তৈরি করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছে, এই বিচারের রায় আগেই নির্ধারিত ছিল।
নিজেকে একজন লেখক, ইতিহাস গবেষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘মহান জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া জানাই। একজন সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক হিসেবে আমি এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, বিকাশ এবং পতন দেখেছি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিখেছি। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিলো।
এতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত ছিলো বলে দাবি করেন তিনি। এ বক্তব্যের সমর্থনে মাহমুদুর রহমান ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ থেকে উদ্ধৃত করেন। তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘২০০৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদের সঙ্গে দিল্লিতে প্রণব মুখার্জির যে কথোপকথন হয়েছিল, লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন। তখন প্রণব ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জেনারেল মঈনের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল যে হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হলে সেনাপ্রধান মঈন চাকরির নিশ্চয়তা পাবেন, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারবেন। মঈনের সঙ্গে প্রণবের এই মিটিংটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। আর বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বরে। এর অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই এর ফলাফল দিল্লিতে নির্ধারিত হয়ে যায়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছিল।’
প্রসিকিউশনের এই সাক্ষী বলেন, ‘নির্বাচনে এই ফলাফলের পেছনে জেনারেল মঈন এবং ডিজিএফআইয়েরও সরাসরি ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে তখন কর্মরত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে জড়িত ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ পরে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’
তিনি দাবি করেন, ‘ক্ষমতাসীন হয়ে হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে হবে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নৈতিকতা উচ্চমানের থাকলে তারা কোনভাবেই একটি বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকার মেনে নেবে না। এ জন্য হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য, ধানমন্ডির এমপি শেখ ফজলে নূর তাপস সরাসরি জড়িত ছিল।’
জবানবন্দিতে সাক্ষী উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ তাপস এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা বিডিআর হত্যার পরিস্থিতি তৈরি করে। এই হত্যায় তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকলেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, যা দুর্ভাগ্যের বিষয়। বিডিআর হত্যায় সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তৎকালীন সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মঈন সেনা সদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেননি। বরং দুদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে দিয়েছিল।
‘আসলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি হাসিনার একধরনের ঘৃণা ছিল’। এই বক্তব্যের সমর্থনে মাহমুদুর রহমান আরেকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন। এর নাম ‘দ্য জামদানি রেভ্যুলুশন’। লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটিতে লেখক ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তখন শেখ হাসিনা ছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারতীয় হাইকমিশনার বিদায়ী সাক্ষাৎকার করতে গেলে হাসিনা তাকে বলেন—‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্য একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।’ শেখ হাসিনা সেদিন আরও বলেন, ভারত যেন বলে তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোন প্রশিক্ষণ কিংবা সহায়তা দিচ্ছে না।’
ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার মুখে রাষ্ট্রবিরোধী এমন বক্তব্যে হতবাক। তিনি হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারত এ ধরনের কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি তা বিশ্বাস করবে? জবাবে হাসিনা আবারও হাই কমিশনারকে একই কথা বলেন।
আসলে সেনাবাহিনীর প্রতি হাসিনার এই বিদ্বেষ, বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয় বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তখন সেনাবাহিনীর একাংশ যারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের বিদ্রোহে এক দলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিল সর্বপ্রথম কর্তৃত্ববাদী শাসন।’
শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনা বিদ্বেষ ছিল, জবানবন্দিতি উল্লেখ করেন সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান। এর সপক্ষে তিনি আরও একটি বইয়ের রেফারেন্স দেন। তিনি জানান, বইটির নাম দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড, লেখক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। এই সাংবাদিক শেখ মুজিবের বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেন, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে তিনি রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছিলেন। রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য শেখ মুজিব ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনা বিদ্বেষের কারণে হাসিনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও নৈতিকতা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাক।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে, হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন।
সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে শেখ হাসিনার সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করে বলে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে একে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়। তাই আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে সতর্ক করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।’
মাহমুদুর রহমান জানান, এই লেখার জন্য আদালত অবমাননার মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময়কার আদালতের দুটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি আদালতকে ব্যবহার করে করা হয়েছিল। পরে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রসঙ্গ।
সাক্ষী বলেন, ‘এই মামলার শুনানিতে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট সম্ভবত ৮ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধানে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে রায় দেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এই ৪ জন বিচারপতিকেই একদা প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারের প্রতি আজ্ঞাবহ বিচারপতিদের পুরস্কৃত করার নীতি গ্রহণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এ লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।’
মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, সকল ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগণের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য একটা পাবলিক এনিমি কনসেপ্ট (গণশত্রু) তৈরি করে। হিটলারের জার্মানিতে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরে ইহুদীদের এইভাবেই গণশত্রু হিসেবে অভিহিত করে তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশেও একইভাবে ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণিকে নির্মূলের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাঁদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন। এমনকি ঢাকায় সফররত ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, “প্রটোকল বা না হলে আমিও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতাম।’’ এতে প্রমাণিত হয়, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজেমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল।’
তিনি দাবি করেন, ‘শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে রেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফাঁসি দাবির বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাগণ বাংলাদেশের যেসব মিডিয়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন, সেগুলো বন্ধের দাবি জানায়। ন্যায়বিচার না করে ফাঁসির দাবি এবং ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবির মধ্য দিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়। তখন আমার দেশ পত্রিকা জনগণকে এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমরা একটি সংবাদ প্রকাশ করি যার শিরোনাম ছিলো “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’’। এই সংবাদ প্রকাশের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু সরকার এতে খুব অসন্তুষ্ট হয় এবং এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশের ফলে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয় উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ আলেম এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকায় এসে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করে। আমার দেখা মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণ জমায়েত সেদিন ঢাকায় হয়েছিল। ওই দিন তাঁরা কতগুলো দাবি-দাওয়া জানিয়ে আলটিমেটাম দেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় মে মাসের ৫ তারিখে তাঁরা আবার ঢাকায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেদিন মধ্য রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাঁদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়।’
সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, র্যাবের অপারেশন চিফ জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। গণহত্যার পরদিন এই তিন জন সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন। সেই গণহত্যার পুরস্কার হিসেবে বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং আজিজ আহম্মেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হয় বলে দাবি—মাহমুদুর রহমানের।
তিনি বলেন, ‘এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে আজ পর্যন্ত শাপলা গণহত্যার বিচার বাংলাদেশে হয়নি।’
সাক্ষী ট্রাইব্যনালকে বলেন, ‘শাপলা গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করছিলেন সে বিষয়ে একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট আমার দেশ এবং লন্ডনের দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক তার বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে নিয়মিত শলাপরামর্শ করতেন। তাদের স্কাইপে কথোপকথনের বিষয়বস্তু আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, পুরো বিচার প্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক বেলজিয়ামে অবস্থানরত জিয়াউদ্দিন এবং ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করছেন।’
মাহমুদুর রহমান জানান, নিজামুল হক তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার কাছে পদোন্নতির জন্য তদবির করছিলেন। জবাবে বিচারপতি সিনহা তাকে বলেন, ‘পদোন্নতির আগে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং আইন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও বিচারপতি এসকে সিনহা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। স্কাইপে কথোপকথন এবং ইমেইলে প্রাপ্ত নথিপত্রে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই মামলাগুলোর রায় পূর্বনির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। স্কাইপে কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্টে প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁকে শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেওয়া হয়। তারপর পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। অবসরের পরে তাঁকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বানানো হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সরকারি নিপীড়ন শুরু হয়। শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, একতরফা নির্বাচন হলে তিনি সামাল দিতে পারবেন এবং এর পরে বাংলাদেশে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে তিনটি নির্বাচনি তামাশা মঞ্চস্থ হয়।’
হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবমান হওয়া প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রন্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন হাসিনা। তিনি এবং তাঁর সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, গুম করেছে, হেফাজতে নির্যাতন করেছে এবং আয়নাঘর বানিয়েছে। ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে র্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে প্রথমে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। পরে আদালতের নির্দেশ ছাড়াই বেআইনিভাবে ডিবি থেকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তারপর অন্ধকার সেলে নিয়ে গারদের শিকের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়। টিএফআই সেলে তাঁকে শারিরীক নির্যাতন করা না হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় মাহমুদুর রহমান পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পান। তাদের এক এক জনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো।
সেলের অধিকাংশই আলেম শ্রেণির মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’
তিনি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পান। যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত এবং নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাংগানো ছিলো। তাঁকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট থানায়। এ পর্যায়ে তিনি সেখানকার নির্যাতনের বর্ণনা দেন। পুরো থানার বাতি নিভিয়ে ৫/৬ জন আততায়ী সেলে প্রবেশ করে তাঁকে বিবস্ত্র করে। এ সময় তার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। এ বিষয়ে ‘জেল থেকে জেলে’ নামে তার লেখা একটি বইয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে জানান তিনি। এরপর ২০১৩ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হলে তাকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলেন।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, ভিন্ন মত এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমকে বৈধতা দিতে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপপ্রচার করে। জঙ্গি দমনের নামে তারা কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরি করেছে। এই সব নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় জনগণের ওপর জুলুম চালানো হয়েছে। তাঁদের জঙ্গি সাজিয়ে ফেইক এনকাউন্টারে (ভুয়া বন্দুকযুদ্ধ) নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভিকটিম বানানো হয়েছে, যাতে তাদের জন্য বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এরকম একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির জঙ্গি নাটক। সেখানে ডিবি থেকে কয়েকজন গুমের ভিকটিমকে ধরে এনে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়। সারাদেশে কিছু দিন পরপর এই ধরনের জঙ্গি নাটক সাজানো হয়েছে। যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা নিজেকে ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন।
সাক্ষী উল্লেখ করেন, দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে হাসিনা জঙ্গি দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। তাঁর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ সহযোগির ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী মূল ভূমিকা পালন করেছেন।
সাক্ষীর দাবি, বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি জুগিয়েছেন।
আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আমিন উদ্দিন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব জহিরুল হক দুলাল, সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর রাণা দাশ গুপ্ত, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য।
পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, বেনজীর আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, জাবেদ পাটোয়ারী ও নুর মোহাম্মদ এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছেন বলে দাবি মাহমুদুর রহমানের।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালের নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনারবৃন্দ এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশন বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধবংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ূয়া, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরীন আখতার এবং তাদের সঙ্গীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, শমশের মবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন।
তিনি দাবি করেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন উ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী এবং ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছেন।
আর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে ৩ সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান দাবি করেন, এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস এবং হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সব সময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানিন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ এবং ২০২৪ এর ভুয়া নির্বাচনের পরেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকা এবং ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণেরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে—জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি দাবি করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও রাজনীতিক এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা ও সমর্থনে মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হাসিনা একজন ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসকে হয়ে উঠেন।
আজ সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দি গ্রহণ করে। জবানবন্দি গ্রহণ অসমাপ্ত অবস্থায় শুনানি আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমানের দাবি, এদেশে মব কালচার তৈরি করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছে, এই বিচারের রায় আগেই নির্ধারিত ছিল।
নিজেকে একজন লেখক, ইতিহাস গবেষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘মহান জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া জানাই। একজন সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক হিসেবে আমি এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, বিকাশ এবং পতন দেখেছি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিখেছি। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিলো।
এতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত ছিলো বলে দাবি করেন তিনি। এ বক্তব্যের সমর্থনে মাহমুদুর রহমান ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ থেকে উদ্ধৃত করেন। তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘২০০৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদের সঙ্গে দিল্লিতে প্রণব মুখার্জির যে কথোপকথন হয়েছিল, লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন। তখন প্রণব ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জেনারেল মঈনের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল যে হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হলে সেনাপ্রধান মঈন চাকরির নিশ্চয়তা পাবেন, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারবেন। মঈনের সঙ্গে প্রণবের এই মিটিংটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। আর বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বরে। এর অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই এর ফলাফল দিল্লিতে নির্ধারিত হয়ে যায়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছিল।’
প্রসিকিউশনের এই সাক্ষী বলেন, ‘নির্বাচনে এই ফলাফলের পেছনে জেনারেল মঈন এবং ডিজিএফআইয়েরও সরাসরি ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে তখন কর্মরত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে জড়িত ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ পরে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’
তিনি দাবি করেন, ‘ক্ষমতাসীন হয়ে হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে হবে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নৈতিকতা উচ্চমানের থাকলে তারা কোনভাবেই একটি বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকার মেনে নেবে না। এ জন্য হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য, ধানমন্ডির এমপি শেখ ফজলে নূর তাপস সরাসরি জড়িত ছিল।’
জবানবন্দিতে সাক্ষী উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ তাপস এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা বিডিআর হত্যার পরিস্থিতি তৈরি করে। এই হত্যায় তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকলেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, যা দুর্ভাগ্যের বিষয়। বিডিআর হত্যায় সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তৎকালীন সরকার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মঈন সেনা সদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেননি। বরং দুদিন ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে দিয়েছিল।
‘আসলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি হাসিনার একধরনের ঘৃণা ছিল’। এই বক্তব্যের সমর্থনে মাহমুদুর রহমান আরেকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন। এর নাম ‘দ্য জামদানি রেভ্যুলুশন’। লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটিতে লেখক ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তখন শেখ হাসিনা ছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারতীয় হাইকমিশনার বিদায়ী সাক্ষাৎকার করতে গেলে হাসিনা তাকে বলেন—‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্য একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।’ শেখ হাসিনা সেদিন আরও বলেন, ভারত যেন বলে তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোন প্রশিক্ষণ কিংবা সহায়তা দিচ্ছে না।’
ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার মুখে রাষ্ট্রবিরোধী এমন বক্তব্যে হতবাক। তিনি হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারত এ ধরনের কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি তা বিশ্বাস করবে? জবাবে হাসিনা আবারও হাই কমিশনারকে একই কথা বলেন।
আসলে সেনাবাহিনীর প্রতি হাসিনার এই বিদ্বেষ, বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয় বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তখন সেনাবাহিনীর একাংশ যারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের বিদ্রোহে এক দলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিল সর্বপ্রথম কর্তৃত্ববাদী শাসন।’
শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনা বিদ্বেষ ছিল, জবানবন্দিতি উল্লেখ করেন সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান। এর সপক্ষে তিনি আরও একটি বইয়ের রেফারেন্স দেন। তিনি জানান, বইটির নাম দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড, লেখক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। এই সাংবাদিক শেখ মুজিবের বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেন, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে তিনি রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছিলেন। রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য শেখ মুজিব ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনা বিদ্বেষের কারণে হাসিনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও নৈতিকতা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাক।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে, হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন।
সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে শেখ হাসিনার সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করে বলে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে একে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়। তাই আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে সতর্ক করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।’
মাহমুদুর রহমান জানান, এই লেখার জন্য আদালত অবমাননার মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময়কার আদালতের দুটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি আদালতকে ব্যবহার করে করা হয়েছিল। পরে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রসঙ্গ।
সাক্ষী বলেন, ‘এই মামলার শুনানিতে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট সম্ভবত ৮ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধানে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দেন। বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে রায় দেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এই ৪ জন বিচারপতিকেই একদা প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারের প্রতি আজ্ঞাবহ বিচারপতিদের পুরস্কৃত করার নীতি গ্রহণ করে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এ লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়। সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।’
মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, সকল ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগণের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য একটা পাবলিক এনিমি কনসেপ্ট (গণশত্রু) তৈরি করে। হিটলারের জার্মানিতে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরে ইহুদীদের এইভাবেই গণশত্রু হিসেবে অভিহিত করে তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশেও একইভাবে ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণিকে নির্মূলের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাঁদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন। এমনকি ঢাকায় সফররত ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, “প্রটোকল বা না হলে আমিও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতাম।’’ এতে প্রমাণিত হয়, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজেমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল।’
তিনি দাবি করেন, ‘শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে রেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট বা ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফাঁসি দাবির বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাগণ বাংলাদেশের যেসব মিডিয়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন, সেগুলো বন্ধের দাবি জানায়। ন্যায়বিচার না করে ফাঁসির দাবি এবং ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবির মধ্য দিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়। তখন আমার দেশ পত্রিকা জনগণকে এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমরা একটি সংবাদ প্রকাশ করি যার শিরোনাম ছিলো “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’’। এই সংবাদ প্রকাশের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু সরকার এতে খুব অসন্তুষ্ট হয় এবং এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশের ফলে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয় উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ আলেম এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকায় এসে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করে। আমার দেখা মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণ জমায়েত সেদিন ঢাকায় হয়েছিল। ওই দিন তাঁরা কতগুলো দাবি-দাওয়া জানিয়ে আলটিমেটাম দেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় মে মাসের ৫ তারিখে তাঁরা আবার ঢাকায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেদিন মধ্য রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাঁদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়।’
সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, র্যাবের অপারেশন চিফ জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। গণহত্যার পরদিন এই তিন জন সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন। সেই গণহত্যার পুরস্কার হিসেবে বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং আজিজ আহম্মেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হয় বলে দাবি—মাহমুদুর রহমানের।
তিনি বলেন, ‘এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে আজ পর্যন্ত শাপলা গণহত্যার বিচার বাংলাদেশে হয়নি।’
সাক্ষী ট্রাইব্যনালকে বলেন, ‘শাপলা গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করছিলেন সে বিষয়ে একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট আমার দেশ এবং লন্ডনের দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক তার বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে নিয়মিত শলাপরামর্শ করতেন। তাদের স্কাইপে কথোপকথনের বিষয়বস্তু আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, পুরো বিচার প্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক বেলজিয়ামে অবস্থানরত জিয়াউদ্দিন এবং ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করছেন।’
মাহমুদুর রহমান জানান, নিজামুল হক তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার কাছে পদোন্নতির জন্য তদবির করছিলেন। জবাবে বিচারপতি সিনহা তাকে বলেন, ‘পদোন্নতির আগে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং আইন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও বিচারপতি এসকে সিনহা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। স্কাইপে কথোপকথন এবং ইমেইলে প্রাপ্ত নথিপত্রে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই মামলাগুলোর রায় পূর্বনির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। স্কাইপে কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা এবং দি ইকনোমিস্টে প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁকে শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেওয়া হয়। তারপর পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। অবসরের পরে তাঁকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বানানো হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সরকারি নিপীড়ন শুরু হয়। শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, একতরফা নির্বাচন হলে তিনি সামাল দিতে পারবেন এবং এর পরে বাংলাদেশে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে তিনটি নির্বাচনি তামাশা মঞ্চস্থ হয়।’
হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবমান হওয়া প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণকে ভীত সন্ত্রন্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন হাসিনা। তিনি এবং তাঁর সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, গুম করেছে, হেফাজতে নির্যাতন করেছে এবং আয়নাঘর বানিয়েছে। ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে র্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে প্রথমে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। পরে আদালতের নির্দেশ ছাড়াই বেআইনিভাবে ডিবি থেকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তারপর অন্ধকার সেলে নিয়ে গারদের শিকের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়। টিএফআই সেলে তাঁকে শারিরীক নির্যাতন করা না হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় মাহমুদুর রহমান পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পান। তাদের এক এক জনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো।
সেলের অধিকাংশই আলেম শ্রেণির মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’
তিনি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পান। যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত এবং নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাংগানো ছিলো। তাঁকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট থানায়। এ পর্যায়ে তিনি সেখানকার নির্যাতনের বর্ণনা দেন। পুরো থানার বাতি নিভিয়ে ৫/৬ জন আততায়ী সেলে প্রবেশ করে তাঁকে বিবস্ত্র করে। এ সময় তার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। এ বিষয়ে ‘জেল থেকে জেলে’ নামে তার লেখা একটি বইয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলে জানান তিনি। এরপর ২০১৩ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হলে তাকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলেন।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, ভিন্ন মত এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমকে বৈধতা দিতে ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপপ্রচার করে। জঙ্গি দমনের নামে তারা কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরি করেছে। এই সব নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় জনগণের ওপর জুলুম চালানো হয়েছে। তাঁদের জঙ্গি সাজিয়ে ফেইক এনকাউন্টারে (ভুয়া বন্দুকযুদ্ধ) নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভিকটিম বানানো হয়েছে, যাতে তাদের জন্য বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এরকম একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির জঙ্গি নাটক। সেখানে ডিবি থেকে কয়েকজন গুমের ভিকটিমকে ধরে এনে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়। সারাদেশে কিছু দিন পরপর এই ধরনের জঙ্গি নাটক সাজানো হয়েছে। যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা নিজেকে ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন।
সাক্ষী উল্লেখ করেন, দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে হাসিনা জঙ্গি দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। তাঁর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ সহযোগির ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী মূল ভূমিকা পালন করেছেন।
সাক্ষীর দাবি, বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি জুগিয়েছেন।
আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আমিন উদ্দিন, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব জহিরুল হক দুলাল, সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর রাণা দাশ গুপ্ত, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য।
পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, বেনজীর আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, জাবেদ পাটোয়ারী ও নুর মোহাম্মদ এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছেন বলে দাবি মাহমুদুর রহমানের।
মাহমুদুর রহমানের দাবি, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালের নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনারবৃন্দ এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশন বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধবংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ূয়া, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরীন আখতার এবং তাদের সঙ্গীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, শমশের মবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছেন।
তিনি দাবি করেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মঈন উ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী এবং ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছেন।
আর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে ৩ সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এই সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান দাবি করেন, এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস এবং হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সব সময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানিন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ এবং ২০২৪ এর ভুয়া নির্বাচনের পরেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকা এবং ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণেরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে—জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান।
ঢাকার দিলকুশা, মতিঝিল আর গুলশানের ব্যাংক শাখাগুলোতে এখন অস্বস্তিকর ভিড়। সকাল থেকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা—কারও চোখে উদ্বেগ, কারও হাতে চেকবই। কেউ কেউ দিনের পর দিন ঘুরেও টাকা তুলতে পারছেন না।
২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে শুরু হওয়া তর্কের জেরে সহপাঠীদের ওপর হামলার অভিযোগে আসামের শিলচরে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি) থেকে পাঁচ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
৩ ঘণ্টা আগেকাতারের ওপর সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
৪ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশি পণ্যে আরোপিত মার্কিন শুল্ক আরও হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
৬ ঘণ্টা আগে