leadT1ad

রাতে হাতিরঝিলের রূপবদল, দাপট অপরাধীদের

হাতিরঝিল ঘিরে অসংখ্য গলি থাকায়, চুরি-ছিনতাইয়ের পর সহজেই গা-ঢাকা দিচ্ছে অপরাধীরা। তাদের কাছে অসহায় নিরস্ত্র আনসার সদস্যরা। এ ছাড়া মাদকসেবী ও কারবারিদের রয়েছে অবাধ আনাগোনা। অধিকাংশ সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করাও হয়ে পড়ে কষ্টসাধ্য।

এস এম নূরুজ্জামান
এস এম নূরুজ্জামান

নান্দনিক যে সেতুগুলোর জন্য হাতিরঝিলের নামডাক সেখানেও জ্বলে না সড়কবাতি। মধুবাগ সেতু থেকে তোলা। স্ট্রিম ছবি

দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল এখন রাতে ভিন্ন চেহারায় হাজির হচ্ছে। সবখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাদক কারবারি, ছিনতাইকারীসহ অপরাধ চক্রের সদস্যরা। ঝিল ঘিরে অসংখ্য গলি থাকায়, চুরি-ছিনতাইয়ের পর সহজেই গা-ঢাকা দিচ্ছে তারা।

হাতিরঝিলের সড়কবাতির বেহাল দশা; বেশির ভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা অকেজো। মাটি খুঁড়ে নিত্য চুরি হচ্ছে সড়কবাতির তার। অপরাধীদের কাছে অসহায় ‘নিরস্ত্র’ আনসার সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়তনের তুলনায় হাতিরঝিলে নিরাপত্তাকর্মী কম। দিনের পর দিন সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট, যেন দেখার কেউ নেই। এই সুযোগে বেপরোয়া অপরাধীরা।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধন করেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত এটির দেখভাল সেনাবাহিনীর অধীনে ছিল। ওই বছরের ৩০ জুন হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বুঝে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এরপর ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে রাজউকের অধীনে নিরাপত্তার দায়িত্বে আসে আনসার বাহিনী।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়রা বলছেন, সেনা, নৌ, পুলিশসহ অন্যদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী (পোশাকের কারণে স্থানীয়দের কাছে লাল বাহিনী নামে পরিচিত) যতদিন দায়িত্বে ছিল, ততদিন হাতিরঝিলের নিরাপত্তা আঁটসাঁট ছিল। রাজউক বুঝে নেওয়ার পর থেকে অবনতি হয়েছে; বেড়েছে অপরাধীদের আনাগোনা।

হাতিরঝিল ট্রাফিক জোনের রেইনবো ক্রসিংয়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করে স্ট্রিমকে বলেন, মাদক কারবার তো সবার সামনে চলে। সন্ধ্যার পর থেকে বাড়ে ছিনতাইকারী ও ভাসমান যৌনকর্মীর আনাগোনা। রাত যত গভীর হয়, রূপ বদলাতে থাকে হাতিরঝিল। তারা পুরো হাতিরঝিল দাপিয়ে বেড়ালেও নির্বিকার আনসার সদস্যরা।

এ ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেছেন, হাতিরঝিলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আনসার সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশ ও রাজউকের নিজস্ব টহল সদস্য মোতায়েন করা হবে। এ বিষয়ে রোববার (১৬ নভেম্বর) রাজউকে বৈঠক হয়েছে। আশা করছি, শিগগির এ কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, পুরো হাতিরঝিল সিসিটিভির আওতায় আনা হবে। যেসব সড়কবাতি নষ্ট, সেগুলো মেরামত করা হবে। প্রয়োজনে দিনে কমিয়ে রাতে দায়িত্বে আনসার সদস্য বাড়ানো হবে। পুলিশও সহায়তা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে।

মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় ঝিলের একমাত্র পদচারী সেতুতে সড়কবাতি থাকলেও নষ্ট। ভ্রাম্যমাণ এই দোকানির মাথার ওপর থাকা বাতিটি তাঁর নিজের। তিনি চলে গেলেই অন্ধকারে ঢেকে যাবে পুরো সেতুটি। স্ট্রিম ছবি
মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় ঝিলের একমাত্র পদচারী সেতুতে সড়কবাতি থাকলেও নষ্ট। ভ্রাম্যমাণ এই দোকানির মাথার ওপর থাকা বাতিটি তাঁর নিজের। তিনি চলে গেলেই অন্ধকারে ঢেকে যাবে পুরো সেতুটি। স্ট্রিম ছবি

লাশের পর লাশ উদ্ধার, গা নেই প্রশাসনের

গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলের এফডিসি অংশে দাবাকোর্ট সংলগ্ন লেকের পানি থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের তথ্য, উদ্বোধনের পর এ পর্যন্ত লেক থেকে অন্তত ২৮ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগকে অন্য জায়গায় হত্যার পর লাশ এখানে ফেলা হয়। এমনকি হাতিরঝিল সড়কে খুন হয়েছেন দুই সংবাদকর্মী।

সম্প্রতি দুপুরে সরেজমিন দাবাকোর্টে কয়েকজনকে তাস খেলতে দেখা যায়। বেঞ্চগুলোতে ঘুমাচ্ছেন ছিন্নমূল সদস্যরা। এখানে বিশ্রাম নিতে আসা ভ্যানচালক নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, রাতভর ভ্যানে মালপত্র টানি। দিনে একটু ঘুমানোর জন্য এখানে আসি। আগে শান্তিতে ঘুমানো যেত, এখন রেললাইনের ‘পোলামাইয়ারা ডিস্টার্ব’ করে।

একই এলাকায় রাতের চিত্র ভিন্ন। মানুষের আনাগোনা কম। সড়কে গাড়ি চলছে; কেউ কেউ হাঁটছেন। যেখানে আলো কম, সেখানেই ছোট্ট জটলা। ভাসমান যৌনকর্মীদের সঙ্গে দর মেটাচ্ছেন আগন্তুকরা। অনেককে গাঁজা সেবন করতেও দেখা যায়।

রাজধানীর অপরাধজগৎ নিয়ে কাজ করা পুলিশের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে জানান, আশির দশকে রাজধানীর অপরাধ জগতের সদস্যরা তাদের কর্মকাণ্ডের আখড়া ও যে তিন-চারটি পয়েন্টে লাশ ফেলা নিরাপদ মনে করত, তার একটি হাতিরঝিল। এখানকার ঝিল, ডোবার চারপাশে কারওয়ানবাজার রেললাইন, এফডিসি, মধুবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁওয়ে বিভিন্ন বস্তি গড়ে উঠেছিল। সেখানে অবাধে চলত মাদক কারবার, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনোখুনি। তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী আলাউদ্দীন ছিলেন এসব এলাকার অঘোষিত গডফাদার। প্রকাশ্যে তিনি তেজগাঁও থানার তৎকালীন এসআই দীনেশকে গুলি করে হত্যা করেন। পরে অবশ্য হাতিরঝিলেই গণপিটুনিতে মারা যান আলাউদ্দীন।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের তথ্য, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে হাতিরঝিল থানাধীন এলাকায় ছয়জন হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা আটটি। এ সময়ে খুন, ছিনতাই, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধের ঘটনায় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

শিশুর লাশ উদ্ধারের বিষয়ে হাতিরঝিল থানার এসআই রূপন চৌধুরী বলেন, দাবাকোর্ট লেক থেকে শিশুর লাশ উদ্ধারে মামলা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, এখন বেশির ভাগ এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যায় না। ফলে হত্যা কেন, যে কোনো অপরাধের ঘটনায় জড়িতকে শনাক্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান স্ট্রিমকে বলেছেন, অপরাধীদের আখড়া তকমা থেকে ধীরে ধীরে বের হচ্ছে হাতিরঝিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক নিরাপদ। প্রাতঃভ্রমণ ও সন্ধ্যার পর ছিনতাইয়ের কিছু অভিযোগ পেয়েছি। পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট ও টহল জোরদার করা হয়েছে। হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপদ হাতিরঝিল গড়ে তোলা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অসংখ্য গলিতে সর্বনাশ

অনিরাপদ হাতিরঝিল হয়ে ওঠার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চারপাশে বিভিন্ন এলাকায় আসা-যাওয়ার অসংখ্য গলিকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, অনেকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ এমনকি মাজার বানিয়ে হাতিরঝিলের সীমানা প্রাচীর কেটে গলি বানিয়েছে। এর ফলে অপরাধ করার পর সহজেই এসব গলি দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

রেইনবো ক্রসিংয়ে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য আবদুল আলিম স্ট্রিমকে জানান, হাতিরঝিলে তাদের ১৮টি চেক পোস্ট রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে দুজন গার্ড কমান্ডের অধীনে ১১৮ সদস্য পুরো হাতিরঝিলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।

রাতে হাতিরঝিলের এই আলো-আঁধারি পরিবেশে অপরাধীদের থাকে অবাধ আনাগোনা। স্ট্রিম ছবি
রাতে হাতিরঝিলের এই আলো-আঁধারি পরিবেশে অপরাধীদের থাকে অবাধ আনাগোনা। স্ট্রিম ছবি

এ সময় তার পাশে থাকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আনসার সদস্য জানান, ৭ নভেম্বর রাতে রামপুরা পয়েন্ট থেকে তিন চোর ধরেন তারা। রাত গভীর হলে উৎপাত বাড়ে দুর্বৃত্তদের। তখন সব পয়েন্টের নিরাপত্তা কাভার করা সম্ভব হয় না।

হাতিরঝিলের ভ্রাম্যমাণ দোকানি চাঁদপুরের আবু জাফর স্ট্রিমকে বলেন, লাল বাহিনী চলে যাওয়ার পর থেকে চুরি, ছিনতাই, মাদকের আড্ডা বেড়েছে। সন্ধ্যায়ও কানে মোবাইল ফোন নিয়ে কথা ঝুঁকিপূর্ণ। মুহূর্তে টান দিয়ে নিয়ে যাবে।

রেইনবো ক্রসিংয়ে মাটি খুঁড়ে সড়কবাতির ক্যাবল সংযোগ দিচ্ছিলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান– মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজের কয়েক কর্মচারী। তাদের ফোরম্যান দীন ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, মাটি খুঁড়ে তার চুরি করায় পুরো হাতিরঝিল কার্যত অন্ধকারে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার চুরি বেড়েছে।

পুলিশের টহল দলের এক সদস্য জানান, হাতিরঝিলে ব্রিজগুলোর নিচে ও আশপাশে নিয়মিত ছিনতাই হচ্ছে। হাতিরঝিলের বেশির ভাগ এলাকা এখন অন্ধকারে থাকে। সড়কবাতি নষ্ট; সিসিটিভি ক্যামেরাও অচল। গলি থেকে এসে, অপকর্ম করে দ্রুত গলি দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে। রাজউক সড়কবাতি ও সিসিটিভি ঠিক করছে না।

দুই সংস্থার ঠেলাঠেলিতে নাগরিকের নাভিশ্বাস

অনিরাপদ হাতিরঝিলে নাগরিকের নাভিশ্বাস। নিরাপত্তা জোরদার না করে এ নিয়ে রাজউক ও পুলিশ পরস্পরকে দায়ী করছে। হাতিরঝিল থানার ওসি মো. রাজু জানান, হাতিরঝিলের সিসিটিভি ক্যামেরা ও সড়কবাতি বেশির ভাগ সময় অকার্যকর থাকে। ফলে অপরাধী শনাক্তে তাদের বেগ পেতে হয়। এরপরও এখানকার কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব, চুরি, ছিনতাই ও মাদক কারবার ঠেকাতে তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল ট্রাফিক জোনের এক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, রাজউকের পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে হাতিরঝিলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ‘হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা ভবন’ই তো রয়েছে। কেন এখন নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছি, দায়িত্ব পালন করছি।

হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা ভবনে গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। আনসার সদস্যরা জানান, এটি নামেই হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা ভবন। বাস্তবে কমিউনিটি সেন্টারে চলে বিয়ে, জন্মদিন ও বিভিন্ন আড্ডা।

এক আনসার সদস্যের দেওয়া নম্বরে কল দিলে নিজেকে হাতিরঝিল প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত রাজউকের প্রকৌশলী আবু সাইদের অফিস সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, হাতিরঝিলের তিন বিভাগ সিভিল, ইলেকট্রিক ও মেকানিক্যালে পৃথক কর্মকর্তা আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হলে মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে আসতে হবে। কারণ হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা ভবনে কেউ থাকেন না। কর্মকর্তারা কখনও হাতিরঝিল পরিদর্শনে গেলে, সেখানে বিশ্রাম করেন।

এ ব্যাপারে রাজউক চেয়ারম্যান বলেছেন, হাতিরঝিলে এতগুলো রেস্তোরাঁ, এসব তো পরিকল্পনায় ছিল না। যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তারা এসব অনিয়ম করেছে। একেকটি রেস্তোরাঁর সঙ্গে ৩০-৩৫ বছরের চুক্তি করে গেছে। এসব জিনিস এখন নিরাপত্তার সংকট তৈরি করছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত