.png)

মাহবুবুল আলম তারেক

দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের পরিবর্তিত শক্তির ভারসাম্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উভয় নেতা বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন। বিশ্লেষকদের মতে—কে বেশি লাভবান হলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, ক্ষমতার ভারসাম্যের দিক থেকে মতভেদ নেই।
২০১৯ সালের পর প্রথম মুখোমুখি বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ছিলেন অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে। বৈঠক শেষে তিনি প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আংশিক প্রত্যাহারের বিনিময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাড়ও পান।
এপেক সম্মেলনের আড়ালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে হাত মেলানো ও সৌজন্য প্রদর্শনের দৃশ্য থাকলেও, শি সমতার বার্তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঝড়-তরঙ্গ ও চ্যালেঞ্জের মুখেও আমাদের সঠিক পথে এগোতে হবে, যাতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জাহাজ স্থিতিশীলভাবে চলতে পারে।’
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের ফেলো ডেক্সটার রবার্টস বলেন, ‘চীন এখন নিজেকে প্রায় সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখে। তাদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কিছুটা দুর্বল।’
২০১৮ সালে ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর থেকে চীন নিজেদের অর্থনীতি আরও সুরক্ষিত করেছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র হাজারো চীনা কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর বেইজিং ঘোষণা দেয়—বিশ্বের যেকোনো কোম্পানি যদি অল্প পরিমাণেও চীনা বিরল খনিজ ব্যবহার করে, তাহলে রপ্তানির জন্য চীনের অনুমোদন নিতে হবে।
এই পদক্ষেপে চীন স্পষ্ট বার্তা দেয়—তারা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত। চীন বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ উত্তোলন ও ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, এসব রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি হলে বৈশ্বিক শিল্পখাতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
টেনিও কোম্পানির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি গ্যাব্রিয়েল উইলডাও বলেন, ‘বিরল খনিজ নিয়ন্ত্রণ চীনের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। এটি বাণিজ্য আলোচনায় চীনের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়েছে।’ তার মতে, এই নিয়ন্ত্রণ অন্য দেশগুলোকে চিনের বিরুদ্ধে শুল্ক বা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপে নিরুৎসাহিত করবে।
এছাড়া, চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন কেনা বন্ধ করার সময় চীন ইতোমধ্যেই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সরবরাহ দ্বিগুণ করে ফেলেছিল। ফলে আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের আইওয়া, নেব্রাস্কা ও ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে, যা ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে।
রবার্টস বলেন, ‘চীন ট্রাম্পের লেনদেন-কেন্দ্রিক মনোভাব ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে। তারা জানে, ট্রাম্প ‘চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে’ নিজের সাফল্য মাপেন। তাই বেইজিং তাকে প্রয়োজনীয় চুক্তি দিতে প্রস্তুত থাকে, যদি তাতে তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়।’
যুদ্ধবিরতির আওতায় চীন আবার যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন কেনা শুরু করবে এবং ১২ ধরনের বিরল খনিজের মধ্যে ৫টির ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখবে। বাকি ৭টি খনিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। ফলে, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক মূলত এপ্রিলের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ছাড়টি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে—ফেন্টানিল-সম্পর্কিত পণ্যের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানী জা ইয়ান চং বলেন, ‘আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে ছিল, এখন চীন বিরল খনিজকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রও নতুন কৌশল খুঁজে বের করবে—এভাবেই এই প্রতিযোগিতা চলবে।’
চীনা বিশ্লেষকরা বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চংইয়াং ইনস্টিটিউটের ডিন ওয়াং ওয়েন বলেন, ‘ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র শক্তির ভারসাম্য এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ এখন ব্যর্থ ঘোষণা করা যায়।’
তার ভাষায়, ‘চীনের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মান করতে শিখিয়েছে। দুই দেশ এখন প্রকৃত সমতার যুগে প্রবেশ করেছে। ভবিষ্যতেও মতভেদ থাকবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চীনকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করতে পারবে—সে যুগ শেষ।’

নিজেকে মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরছে বেইজিং
শি জিনপিং বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনে ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করার পর এপেক সম্মেলনে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার গিওংজুতে শহরে শুক্রবার শুরু হওয়া দুই দিনের এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলনে শি ছিলেন কেন্দ্রবিন্দুতে। ট্রাম্প আগের দিনই চীনের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি সম্পন্ন করে কোরিয়া ত্যাগ করেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে শি বলেন, ‘সময় যত অস্থির হয়, আমাদের তত বেশি একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ব এখন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি ও ‘আমেরিকা ফার্স্ট’নীতির ফলে যে মুক্তবাণিজ্যব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে, শি এখন সেটির রক্ষক হিসেবে নিজ দেশকে উপস্থাপন করছেন। তিনি সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানান—যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিকাপলিং’ প্রচেষ্টার বিপরীতে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি, সবুজ শিল্প ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর আশা প্রকাশ করেন।
চীনের সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও অন্যান্য সবুজ প্রযুক্তি রপ্তানি অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি করছে এবং আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা রয়েছে।
ট্রাম্প বৃহস্পতিবার শির সঙ্গে বৈঠকে বিরল খনিজ রপ্তানি পুনরায় চালু ও মার্কিন সয়াবিন কেনা বিষয়ে সমঝোতা করেন। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত কিছু শুল্ক কমাতে রাজি হয়। বৈঠক শেষে ট্রাম্প একে ‘বড় সাফল্য’ বলে অভিহিত করেন।
তবে, তিনি এপেক সম্মেলনে যোগ না দিয়ে কোরিয়া ত্যাগ করেন। প্রায় ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক জনসংখ্যা ও অর্ধেকের বেশি বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিনিধিত্বকারী এ ফোরাম থেকে সরে দাঁড়ানো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর প্রতি ট্রাম্পের অনীহারই প্রতিফলন। তিনি বরং একান্ত বৈঠক ও মিডিয়া-কেন্দ্রিক কূটনীতি পছন্দ করেন।
মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে শির অবস্থান
আল জাজিরার সাংবাদিক জ্যাক বার্টন গিওংজুতে থেকে জানান, শি ‘ট্রাম্পের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করছেন।’ তিনি ১১ বছর পর দক্ষিণ কোরিয়া সফরে এসে শুক্রবার পৃথকভাবে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং এবং জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে বৈঠক করবেন। শনিবার কোরীয় উপদ্বীপের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুতে শি ও লি’র মধ্যে বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে।
বার্টনের মতে, জাপানের সঙ্গে বৈঠকটি আগামী সময়ের কূটনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে। চীনা গণমাধ্যম তাকাইচিকে দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী হিসেবে বর্ণনা করেছে, যিনি বিতর্কিত ইয়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শন করেছেন। এই মন্দিরে ১৯ শতক থেকে শুরু করে যুদ্ধাহত ২৫ লাখ জাপানির স্মৃতি সংরক্ষিত, যার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ক্লাস এ’ যুদ্ধাপরাধীরাও রয়েছেন। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে এটি ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতার প্রতীক।
বার্টন বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন উভয়ই জাপানের সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা বিষয় একই ঐতিহ্য লালন করে। তারা বলেছে, অতীতকে এক পাশে রেখে কূটনীতি এগিয়ে নেওয়া হবে। এতে ইতিবাচক ফল আসার সুযোগ রয়েছে।’
শি শুক্রবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনির সঙ্গেও বাণিজ্য বিষয়ে বৈঠক করেন। বার্টনের ভাষায়, ‘এই বৈঠক থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চুক্তি ঘোষণা হতে পারে।’
২১টি এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের নেতা ও প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। আলোচনায় রয়েছে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও যৌথ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
এপেক অঞ্চলের প্রধান উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, জনসংখ্যার বার্ধক্য এবং কর্মসংস্থানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সব সদস্য দেশকে যৌথ বিবৃতিতে সম্মত করানোর চেষ্টা করছেন, যাতে ২০১৮ সালের পাপুয়া নিউগিনি সম্মেলনের মতো ব্যর্থতা না ঘটে। তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী চো হিউন মনে করেন, মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে বিবৃতি প্রকাশের সম্ভাবনা কম।
আল জাজিরার বার্টনের ভাষায়, ফলাফল হতে পারে ‘একটি নরম বা পানিমিশ্রিত সংস্করণ।’ তিনি শেষে প্রশ্ন তোলেন—‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই যুগে এপেক কি টিকে থাকতে পারবে?’
সূত্র: আল-জাজিরা

দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের পরিবর্তিত শক্তির ভারসাম্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উভয় নেতা বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন। বিশ্লেষকদের মতে—কে বেশি লাভবান হলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, ক্ষমতার ভারসাম্যের দিক থেকে মতভেদ নেই।
২০১৯ সালের পর প্রথম মুখোমুখি বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ছিলেন অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে। বৈঠক শেষে তিনি প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আংশিক প্রত্যাহারের বিনিময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাড়ও পান।
এপেক সম্মেলনের আড়ালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে হাত মেলানো ও সৌজন্য প্রদর্শনের দৃশ্য থাকলেও, শি সমতার বার্তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঝড়-তরঙ্গ ও চ্যালেঞ্জের মুখেও আমাদের সঠিক পথে এগোতে হবে, যাতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জাহাজ স্থিতিশীলভাবে চলতে পারে।’
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের ফেলো ডেক্সটার রবার্টস বলেন, ‘চীন এখন নিজেকে প্রায় সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখে। তাদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কিছুটা দুর্বল।’
২০১৮ সালে ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর থেকে চীন নিজেদের অর্থনীতি আরও সুরক্ষিত করেছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র হাজারো চীনা কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর বেইজিং ঘোষণা দেয়—বিশ্বের যেকোনো কোম্পানি যদি অল্প পরিমাণেও চীনা বিরল খনিজ ব্যবহার করে, তাহলে রপ্তানির জন্য চীনের অনুমোদন নিতে হবে।
এই পদক্ষেপে চীন স্পষ্ট বার্তা দেয়—তারা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত। চীন বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ উত্তোলন ও ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, এসব রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি হলে বৈশ্বিক শিল্পখাতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
টেনিও কোম্পানির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি গ্যাব্রিয়েল উইলডাও বলেন, ‘বিরল খনিজ নিয়ন্ত্রণ চীনের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। এটি বাণিজ্য আলোচনায় চীনের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়েছে।’ তার মতে, এই নিয়ন্ত্রণ অন্য দেশগুলোকে চিনের বিরুদ্ধে শুল্ক বা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপে নিরুৎসাহিত করবে।
এছাড়া, চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন কেনা বন্ধ করার সময় চীন ইতোমধ্যেই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সরবরাহ দ্বিগুণ করে ফেলেছিল। ফলে আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের আইওয়া, নেব্রাস্কা ও ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে, যা ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে।
রবার্টস বলেন, ‘চীন ট্রাম্পের লেনদেন-কেন্দ্রিক মনোভাব ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে। তারা জানে, ট্রাম্প ‘চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে’ নিজের সাফল্য মাপেন। তাই বেইজিং তাকে প্রয়োজনীয় চুক্তি দিতে প্রস্তুত থাকে, যদি তাতে তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়।’
যুদ্ধবিরতির আওতায় চীন আবার যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন কেনা শুরু করবে এবং ১২ ধরনের বিরল খনিজের মধ্যে ৫টির ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখবে। বাকি ৭টি খনিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। ফলে, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক মূলত এপ্রিলের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ছাড়টি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে—ফেন্টানিল-সম্পর্কিত পণ্যের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানী জা ইয়ান চং বলেন, ‘আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে ছিল, এখন চীন বিরল খনিজকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রও নতুন কৌশল খুঁজে বের করবে—এভাবেই এই প্রতিযোগিতা চলবে।’
চীনা বিশ্লেষকরা বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চংইয়াং ইনস্টিটিউটের ডিন ওয়াং ওয়েন বলেন, ‘ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র শক্তির ভারসাম্য এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ এখন ব্যর্থ ঘোষণা করা যায়।’
তার ভাষায়, ‘চীনের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মান করতে শিখিয়েছে। দুই দেশ এখন প্রকৃত সমতার যুগে প্রবেশ করেছে। ভবিষ্যতেও মতভেদ থাকবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চীনকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করতে পারবে—সে যুগ শেষ।’

নিজেকে মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরছে বেইজিং
শি জিনপিং বাণিজ্য যুদ্ধ প্রশমনে ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করার পর এপেক সম্মেলনে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার গিওংজুতে শহরে শুক্রবার শুরু হওয়া দুই দিনের এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলনে শি ছিলেন কেন্দ্রবিন্দুতে। ট্রাম্প আগের দিনই চীনের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি সম্পন্ন করে কোরিয়া ত্যাগ করেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে শি বলেন, ‘সময় যত অস্থির হয়, আমাদের তত বেশি একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ব এখন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি ও ‘আমেরিকা ফার্স্ট’নীতির ফলে যে মুক্তবাণিজ্যব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে, শি এখন সেটির রক্ষক হিসেবে নিজ দেশকে উপস্থাপন করছেন। তিনি সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানান—যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিকাপলিং’ প্রচেষ্টার বিপরীতে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি, সবুজ শিল্প ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর আশা প্রকাশ করেন।
চীনের সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও অন্যান্য সবুজ প্রযুক্তি রপ্তানি অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি করছে এবং আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা রয়েছে।
ট্রাম্প বৃহস্পতিবার শির সঙ্গে বৈঠকে বিরল খনিজ রপ্তানি পুনরায় চালু ও মার্কিন সয়াবিন কেনা বিষয়ে সমঝোতা করেন। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত কিছু শুল্ক কমাতে রাজি হয়। বৈঠক শেষে ট্রাম্প একে ‘বড় সাফল্য’ বলে অভিহিত করেন।
তবে, তিনি এপেক সম্মেলনে যোগ না দিয়ে কোরিয়া ত্যাগ করেন। প্রায় ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক জনসংখ্যা ও অর্ধেকের বেশি বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিনিধিত্বকারী এ ফোরাম থেকে সরে দাঁড়ানো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর প্রতি ট্রাম্পের অনীহারই প্রতিফলন। তিনি বরং একান্ত বৈঠক ও মিডিয়া-কেন্দ্রিক কূটনীতি পছন্দ করেন।
মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে শির অবস্থান
আল জাজিরার সাংবাদিক জ্যাক বার্টন গিওংজুতে থেকে জানান, শি ‘ট্রাম্পের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করছেন।’ তিনি ১১ বছর পর দক্ষিণ কোরিয়া সফরে এসে শুক্রবার পৃথকভাবে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং এবং জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে বৈঠক করবেন। শনিবার কোরীয় উপদ্বীপের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুতে শি ও লি’র মধ্যে বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে।
বার্টনের মতে, জাপানের সঙ্গে বৈঠকটি আগামী সময়ের কূটনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে। চীনা গণমাধ্যম তাকাইচিকে দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী হিসেবে বর্ণনা করেছে, যিনি বিতর্কিত ইয়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শন করেছেন। এই মন্দিরে ১৯ শতক থেকে শুরু করে যুদ্ধাহত ২৫ লাখ জাপানির স্মৃতি সংরক্ষিত, যার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ক্লাস এ’ যুদ্ধাপরাধীরাও রয়েছেন। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে এটি ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতার প্রতীক।
বার্টন বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন উভয়ই জাপানের সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা বিষয় একই ঐতিহ্য লালন করে। তারা বলেছে, অতীতকে এক পাশে রেখে কূটনীতি এগিয়ে নেওয়া হবে। এতে ইতিবাচক ফল আসার সুযোগ রয়েছে।’
শি শুক্রবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনির সঙ্গেও বাণিজ্য বিষয়ে বৈঠক করেন। বার্টনের ভাষায়, ‘এই বৈঠক থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চুক্তি ঘোষণা হতে পারে।’
২১টি এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের নেতা ও প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। আলোচনায় রয়েছে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও যৌথ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
এপেক অঞ্চলের প্রধান উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, জনসংখ্যার বার্ধক্য এবং কর্মসংস্থানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সব সদস্য দেশকে যৌথ বিবৃতিতে সম্মত করানোর চেষ্টা করছেন, যাতে ২০১৮ সালের পাপুয়া নিউগিনি সম্মেলনের মতো ব্যর্থতা না ঘটে। তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী চো হিউন মনে করেন, মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে বিবৃতি প্রকাশের সম্ভাবনা কম।
আল জাজিরার বার্টনের ভাষায়, ফলাফল হতে পারে ‘একটি নরম বা পানিমিশ্রিত সংস্করণ।’ তিনি শেষে প্রশ্ন তোলেন—‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই যুগে এপেক কি টিকে থাকতে পারবে?’
সূত্র: আল-জাজিরা
.png)

পাপুয়া নিউগিনির দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের একটি গ্রামে ভূমিধসে অন্তত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) মধ্যরাতে এঙ্গা প্রদেশের কুকাস গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
৯ ঘণ্টা আগে
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান আরও এক সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি বাড়াতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার তুরস্কে অনুষ্ঠিত আলোচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১২ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের বিদেশ সফর সাধারণত বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পাঁচ দিনের পূর্ব এশিয়া সফরও ছিল মূলত তার ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রদর্শন। তবে এবার একই সঙ্গে, সেই ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৩ ঘণ্টা আগে
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দপ্তরকে পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালুর নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ট্রাম্পের এই নির্দেশের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইরান। দেশটি বলছে, শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার পর এই নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামি।
১৪ ঘণ্টা আগে