ভারতের বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দশমবার শপথ নিয়ে নতুন ইতিহাস গড়লেন জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর নেতা নীতিশ কুমার। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)-এর বিপুল জয়ের পর এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি পাটনার ঐতিহাসিক গান্ধী ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং এনডিএর শীর্ষ নেতারা এতে উপস্থিত ছিলেন। এতে জোটের শক্ত অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়। কুমারের সঙ্গে ২৬ জন মন্ত্রীও শপথ নেন। এর মধ্যে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় পেয়েছে বিজেপি।
ঘটনাটি ভারতের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ নীতিশ কুমার এখন ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি মুখ্যমন্ত্রীদের একজন হিসেবে বিবেচিত। তিনি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারলে নতুন রেকর্ডও গড়তে পারেন। নতুন সরকার গঠন বিহারে সুশাসন, উন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নীতীশ কুমার ও বিহারের রাজনীতি
নীতিশ কুমার পেশায় প্রকৌশলী এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। ২০০৫ সাল থেকে তিনি বিহারের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। অবকাঠামো, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে জোট পরিবর্তন করেছেন—কখনো এনডিএর সঙ্গে, আবার কখনো মহাগাটবন্ধনের সঙ্গে।
দশমবার শপথ নিয়ে তিনি ভারতের ইতিহাসে একমাত্র নেতা হিসেবে এমন সাফল্য অর্জন করলেন। যদি তিনি ২০৩০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকেন, তবে সিকিমের পাওয়ার চামলিংকেও পেছনে ফেলে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা মুখ্যমন্ত্রী হবেন।
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে এনডিএ ২৪৩ আসনের মধ্যে ২০২টি আসন পায়। জেডিইউ ৮৫, বিজেপি ৮৯ এবং সহযোগী দল এলজেপি (আরভি) বাকি আসনগুলো পায়। বিপরীতে আরজেডি-নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র ৪১টি আসন পেয়ে বড় ধরনের পরাজয়ের মুখে পড়ে। এতে স্পষ্ট যে ভোটাররা স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান
গান্ধী ময়দানে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। উৎসুক জনতা এনডিএর পতাকা ও কুমার-মোদির ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে উপস্থিত ছিল। বিহারের গভর্নর রাজেন্দ্র বিষ্ণু আরলেকার নীতীশ কুমারকে শপথ পড়ান। তিনি সংবিধান রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা ও বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতি ছিল।
সহযোগী নেতা নায়ডুও অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এটি এনডিএর ঐক্য প্রদর্শনের এক বড় মঞ্চে পরিণত হয়। শপথ গ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানান। বিজেপির সম্রাট চৌধুরী ও বিজয় কুমার সিনহা উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, যা জোটের ক্ষমতা-বণ্টন কাঠামোকে আরও স্পষ্ট করে।
মন্ত্রিসভা গঠন
২৬ সদস্যের মন্ত্রিসভায় এনডিএর বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে সমন্বিত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। বিজেপি পেয়েছে ১৪টি মন্ত্রণালয়, জেডিইউ ৮টি, এলজেপি(আরভি) ২টি এবং হাম(এস) ও আরএলএম প্রত্যেকে একটি করে। উল্লেখযোগ্য বিজেপি মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন দিলীপ জয়সওয়াল, সঞ্জয় কুমার সিং, প্রমোদ কুমার, লেখেন্দ্র রাউশন, রামা নিশাদ, নারায়ণ প্রসাদ, সুরেন্দ্র মেহতা, অরুণ শঙ্কর প্রসাদ, সঞ্জয় ‘টাইগার’ সিং, কমনওয়েলথ স্বর্ণপদকজয়ী শ্রেয়সী সিং, রাম কৃপাল যাদব এবং নিতিন নবীন।
জেডিইউ থেকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন বিজয়েন্দ্র প্রসাদ যাদব, শ্রাবণ কুমার, বিজয় কুমার চৌধুরী, অশোক চৌধুরী, মোহাম্মদ জামা খান (একমাত্র মুসলিম মন্ত্রী), লেশি সিং, মদন সহনী এবং সুনীল কুমার। সহযোগী দলের মধ্যে হাম (এস)-এর সন্তোষ মাঁঝি এবং আরএলএম-এর দীপক প্রকাশ মন্ত্রিত্ব পান। মন্ত্রিসভায় তিনজন নারী রয়েছেন। আবার অনেক অভিজ্ঞ নেতাকেও পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই দপ্তর বণ্টন ঘোষণা করা হবে। এ বণ্টনে শক্তি, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সমাজকল্যাণ গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাজনৈতিক তাৎপর্য
নীতিশ কুমারের প্রত্যাবর্তন এনডিএর অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে। মোদি সরকারের সহযোগিতায় বিহারের উন্নয়নগত অগ্রগতি জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব। উন্নয়ন, অবকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই সরকার বিহারের অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে পারে।
তবে সমালোচকদের মতে, নীতিশ কুমারের অতীতে জোট পরিবর্তনের ইতিহাস ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব রয়েছে, কারণ এই বিজয় বিজেপির আঞ্চলিক প্রভাবকে আরও সুদৃঢ় করেছে এবং বিরোধী জোটের মনোবল দুর্বল করেছে। নীতীশ কুমার যদি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেন, তবে তিনি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বের এক বিশেষ স্থান অর্জন করবেন।
জনমত ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
এনডিএর ভেতরে প্রতিক্রিয়া বেশ ইতিবাচক। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুপ্রিয়া প্যাটেল নীতীশ কুমার ও তার মন্ত্রিসভাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম যেমন সিএনবিসি-টিভি১৮ এবং হিন্দুস্তান টাইমস অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই এই ঘটনাকে নীতিশ কুমারের দৃঢ়তা ও স্থিতিস্থাপকতার উদাহরণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনা ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব ও স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস