আজকের বিশ্ব অভূতপূর্বভাবে ধনী, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও ব্যাপক উৎপাদনশীল। ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের শুরুতে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেছিলেন যে বিশ্বের খাদ্য ফুরিয়ে যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ার হার কৃষি উৎপাদনের চেয়ে অনেক দ্রুত ছিল। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনগুলো তখন সতর্ক করেছিল—বড় পরিবর্তন না এলে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
কিন্তু ‘সবুজ বিপ্লব’ কৃষি উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি আনে। নতুন কৌশল, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে ফসল উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও পরিবেশ কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, অপচয় কমানো গেলে বিশ্ব এখন প্রায় ১ হাজার কোটি মানুষকে খাওয়াতে সক্ষম—যা বর্তমান জনসংখ্যার চেয়ে ২০০ কোটি বেশি।
তবুও এই সফলতা আত্মতুষ্টি তৈরি এবং এক নতুন খাদ্যসংকটকে আড়াল করেছে। এই সংকটের মূল কারণ খাদ্যের অভাব নয়, বরং খাদ্যে পৌঁছানোর বাধা। প্রাচুর্যের মধ্যেই কোটি কোটি মানুষ বঞ্চিত। ২০২৫ সালের স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৭২ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ৪ কোটি ৩০ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু খর্বাকৃতির। পুষ্টিহীনতা ও সংক্রমণে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) ২০২৫ সালের গ্লোবাল আউটলুক অনুযায়ী, ৩১৯ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে—যা ২০২০ সালের আগে তুলনায় ১৩০ শতাংশ বেশি। গাজা ও সুদানে একযোগে দুটি দুর্ভিক্ষ চলছে।
একদিকে যুদ্ধ, জলবায়ু বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে অনেক দাতা দেশ খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিচ্ছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দ্য ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইএসএআইডি) বন্ধ হওয়ায় আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটতে পারে—যার অনেকটাই ক্ষুধাজনিত হবে।
এভাবে সাহায্য থেকে সরে গিয়ে ধনী দেশগুলো এক বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করছে। তার বুঝতে পারছে না এক স্থানের খাদ্য সংকট অন্য স্থানেও অস্থিরতা ডেকে আনে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে, অর্ধশতাব্দী আগে যেভাবে খাদ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনই ভয়াবহ পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে। পার্থক্য শুধু এতটুকু—এই সংকট সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট ও প্রতিরোধযোগ্য।
খাদ্য সংকটের কারণ
২০ শতকের বড় দুর্ভিক্ষগুলো মূলত খরার কারণে ঘটেছিল। এখন খাদ্য সংকটের কারণ আরও জটিল—সহিংস সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। উপসালা কনফ্লিক্ট ডেটা প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যেখানে সক্রিয় সংঘাতের সংখ্যা ছিল ৪৬টি ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬১টি। বর্তমানে প্রতি বছর যেসব সংঘাত মীমাংসিত হয় তার হার গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। যারা তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে, তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বসবাস করছে। শুধু গাজা ও সুদানে যুদ্ধের কারণে ১০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনও খাদ্যসংকটকে ত্বরান্বিত করছে। লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, ১৯৮৫–২০০৪ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ২৩১টি জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটত। ২০০৫ সালের পর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৪৩টি অর্থাৎ ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
২০২৪ সালে এক বছরে ৩৭১টি দুর্যোগ (খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়) রেকর্ড করা হয়, যা ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। সে বছর ঘূর্ণিঝড় মেলিসা ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৩১ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে, আর পাকিস্তানে বন্যায় ৬৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাহেল অঞ্চলে ঘন ঘন খরার ফলে দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতি বাড়ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো একে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির ভঙ্গুরতাও সংকটকে তীব্র করছে। নিম্ন-আয়ের অর্ধেক দেশ এখন ঋণসঙ্কটে বা তার কাছাকাছি অবস্থায়। এতে সরকারগুলো ঋণ শোধে ব্যয় বাড়িয়ে খাদ্য আমদানি, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষি বিনিয়োগে কাটছাঁট করছে। বর্তমানে ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ এমন দেশে বাস করছে, যেখানে ঋণের সুদ পরিশোধে স্বাস্থ্য বা শিক্ষাখাতের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়।
বাড়তি ঋণ, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও উৎপাদন ব্যয়ের কারণে গত পাঁচ বছরে ৬১টি দেশে খাদ্যের দাম ৫০ শতাংশ এবং ৩৭টি দেশে ১০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সুরক্ষাবাদী নীতি বাড়ায় দরিদ্র দেশগুলো তাদের খাদ্য আমদানি ও মৌলিক পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব হারাচ্ছে।
ক্ষুধার খেলা
মানবিক দুর্ভোগ ঠেকানোর জন্য গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক অনীহার ভারে নুয়ে পড়েছে। টানা পাঁচ বছর ধরে বাড়ার পর ২০২৪ সালে বৈশ্বিক সহায়তা তহবিল ৯ শতাংশ কমে যায়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) ধারণা করছে, ২০২৫ সালে এটি আরও ৯ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এই কাটছাঁটের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ওপর।
গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য সহায়তার বাজেট প্রায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) বিশ্বজুড়ে ১২ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে সহায়তা দিয়েছিলো। কিন্তু ২০২৫ সালে বড় দাতাদের অনুদান কমে যাওয়ায় এই সংখ্যা প্রায় ২১ শতাংশ কমতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের পর থেকে তাদের অনুদান ৫৫ শতাংশ কমিয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যও একই পথে হেঁটেছে। ফলে অনেক এলাকায় খাদ্য সহায়তা প্রতিদিনের ৩০০ ক্যালরির নিচে নেমে এসেছে। প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ পুরোপুরি খাদ্য সহায়তা হারানোর ঝুঁকিতে আছে, যখন বৈশ্বিক ক্ষুধা আরও বাড়ছে।
সহায়তা সংস্থাগুলো শুধু অর্থ সংকটে নয়, নিরাপত্তা ঝুঁকিতেও ভুগছে। এইড ওয়ার্কার সিকিউরিটি ডাটাবেজ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩৮৩ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন, যা আগের তিন বছরের গড়ের দ্বিগুণ। এটি যুদ্ধরত পক্ষগুলোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি বেড়ে চলা অবহেলার প্রতিফলন।
এই বাজেট সংকোচন কেবল দরিদ্র জনগণের প্রতি বৈশ্বিক সংহতির দুর্বলতাই নয়, বরং ধনী দেশগুলোর জন্যও বাস্তব হুমকি। অস্থির সময়েই সম্মিলিত পদক্ষেপ সবচেয়ে জরুরি, কারণ মানবিক সহায়তা কমে গেলে সংকট আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাস্তুচ্যুতি সৃষ্টি করে। ২০১৭ সালে ডাব্লিউএফপি-র এক গবেষণায় দেখা যায়, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ১ শতাংশ বাড়লে শরণার্থী প্রবাহ ১ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়ে। একই গবেষণায় আরও বলা হয়, কোনো সংঘাত যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেই সংঘাত থেকে শরণার্থী প্রবাহ প্রতি বছর গড়ে ০.৪ শতাংশ করে বেড়ে যায়।
২০২৪ সালে ওইসিডি দেশগুলো ২ হাজার ৪২০ কোটি ডলার ব্যয় করে ১৯ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করেছে—প্রতি জনে প্রায় ১২০ ডলার। কিন্তু একই সময়ে তারা নিজ দেশে মাত্র ৩০ লাখ শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীর জন্য ব্যয় করেছে ২ হাজার ৭৮০ কোটি ডলার—প্রতি জনে প্রায় ৯ হাজার ২০০ ডলার। অর্থাৎ, কাউকে তার নিজ দেশে খাওয়ানো অনেক সস্তা, তুলনায় শরণার্থী হিসেবে তাকে সমর্থন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা না নিলে পরে খরচ আরও বেড়ে যায়, আর সঙ্গে বাড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢল প্রায়ই দেশীয় রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে এবং বিভাজন ও চরমপন্থা উস্কে দেয়।
ক্ষুধা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতাও ডেকে আনে। খাদ্য সংকট আক্রান্ত রাষ্ট্রের বৈধতা দুর্বল করে, সীমিত সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়ায় এবং সহিংসতার প্রবণতা ত্বরান্বিত করে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে—খাবার দিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে এবং অভাবকে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার বানায়। ক্ষুধা ও সংঘাতের এই সম্পর্ক চক্রাকার; একটির অস্তিত্ব অপরটিকে আরও গভীর করে।
দুর্ভিক্ষ থেকে প্রাচুর্যে
এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক সাহস প্রয়োজন। এটি কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়। বিশ্ব জানে কীভাবে খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ করতে হয়। সমস্যা মূলত রাজনৈতিক ও আর্থিক। খাদ্য নিরাপত্তাকে যৌথ অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে, অবশিষ্ট দায়িত্ব হিসেবে নয়।
শুধু জীবনরক্ষাকারী উদ্যোগ নয়, বরং এমন প্রকল্পগুলোকেও সমর্থন দিতে হবে যা মানুষকে ক্ষুধার ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।
ক্ষুধা ও সম্পদের সংকটই সহিংসতা ও অভিবাসনকে ত্বরান্বিত করে। তাই ন্যাটো, জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি–৭ দেশগুলোর কৌশলগত নীতিতে খাদ্য নিরাপত্তাকে মূল স্তম্ভ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) মতো সংস্থাগুলোর পূর্ণ অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে। এই সমন্বয়ের নেতৃত্ব এফএও ও ডাব্লিউএফপি-র হাতে থাকা উচিত।
উন্নত দেশগুলোকে দুর্বল দেশগুলোর পণ্যের ওপর শুল্ক ও বাণিজ্যিক বাধা তুলে দিতে হবে। রপ্তানিকারক দেশগুলোকে খাদ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ তা বাজার অস্থিতিশীল করে ও দাম বাড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় খরা-সহনশীল কৃষি, বন্যা ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুদ্র কৃষকের বীমা কর্মসূচিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
ধনী দেশগুলো বিদেশি সহায়তা কমাচ্ছে। তবে তারা এখনো ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে সংঘাত নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, খাদ্য নিরাপত্তাই শান্তির ভিত্তি।
চরম ক্ষুধা প্রতিরোধে প্রতি ডলার ব্যয় মানে ভবিষ্যতে বিপর্যয় মোকাবিলায় বহু ডলার সাশ্রয়। ক্ষুধা টিকে থাকার বিষয় নয়—এটি নীতিনির্ধারণের বিষয়। তাই ক্ষুধা নির্মূল করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি কৌশলগত অপরিহার্যতা।
(ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইনের লেখার সংক্ষেপিত অনুবাদ)