ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান প্রায় এক মাস আগে ‘জেন জি উপদেষ্টা’ নিয়োগের ঘোষণা দেন। উপদেষ্টা আমিররেজা আহমাদির সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবিও প্রকাশ করেন তিনি, যা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আহমাদি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর দায়িত্ব হলো ইরানের তরুণদের কথা শোনা — ‘তেহরান থেকে দেশের সীমান্ত পর্যন্ত।’ এমনকি তিনি নিজের মোবাইল নম্বরও প্রকাশ করেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার মুখে তিনি মন্তব্যের সুযোগ বন্ধ করে দেন।
সমালোচকরা অভিযোগ তোলেন, আহমাদি প্রকৃত জেন জি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন না, কৃত্রিম অনুসারী (বট) ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছেন এবং তরুণ সংগঠন বা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই নিয়োগকে বিশ্লেষকরা দেখছেন একটি কৌশল হিসেবে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন মধ্যপন্থী প্রশাসন নির্বাচনী প্রচারে সামাজিক স্বাধীনতা বাড়ানো ও নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে তারা—যে প্রজন্ম এশিয়া ও বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি।
তবে পেজেশকিয়ান প্রশাসন এই উদ্যোগে সাফল্য পাচ্ছে না। একদিকে তরুণদের উদাসীনতা, অন্যদিকে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর অনীহা—দুই মিলিয়ে সরকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক কঠোরপন্থী নেতা তরুণদের সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনই দেখছেন না।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, ইরান সরকার এমন এক প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগে লড়ছে যারা অনলাইন জগতে বেড়ে উঠেছে এবং সরকারের আদর্শিক কাঠামোর বাইরে চিন্তা করে।
তিনি বলেন, সরকারের তরুণমুখী প্রচেষ্টা বাস্তবে ‘গভীর পরিবর্তনের’ চেয়ে অনেক বেশি ‘কৌশলগত ও প্রতিরোধমূলক।’ এটি মূলত অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ঠেকানোর প্রচেষ্টা মাত্র। কঠোরপন্থী অভিজাতদের ক্ষমতা হারানোর ভয় তরুণদের আস্থা হারানোর চেয়ে অনেক বড়।
ভাকিলের মতে, এই ভারসাম্যহীনতা ইরানকে ‘দমননীতির রাজনীতিতে’ আটকে রেখেছে। ফলে দেশটি পরস্পরবিরোধী বার্তা, নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আটকে থাকবে।
বর্তমানে যারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অবস্থান নিচ্ছে, তারা মূলত জেন জি প্রজন্মের তরুণ। এদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতিতে দারুণভাবে বিপর্যস্ত।
২০২২ সালের বিক্ষোভের সময় নারীরা তাদের চুল কেটে প্রতিবাদ করছেন। ছবি: বিবিসি।
সীমা পরীক্ষা: ইরানে সামাজিক স্বাধীনতা নিয়ে দ্বন্দ্ব
ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা জুন মাসে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ‘জয়ে’র পর দেশটিতে সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে ইরানি কর্তৃপক্ষ বলছে, কঠিন পরিস্থিতি—জাতিসংঘের পুনর্বহাল নিষেধাজ্ঞা এবং যুদ্ধের ঝুঁকি—মোকাবিলা করতে জনগণের সমর্থন অপরিহার্য।
এই বাস্তবতা অনেক কর্মকর্তাকে, বিশেষ করে মধ্যপন্থী ও বাস্তববাদী শিবিরের সদস্যদের, সামাজিক স্বাধীনতার ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার আহ্বান জানাতে বাধ্য করেছে।
মধ্যপন্থী গোষ্ঠীর নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও সম্প্রতি কঠোরপন্থী সংসদ সদস্য ও রাজনীতিকদের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, তারা এমন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন যা অধিকাংশ ইরানির কাছে অগ্রহণযোগ্য। সম্ভবত বাধ্যতামূলক হিজাব আইনকে ইঙ্গিত করেই তিনি এই মন্তব্য করেন। সরকার জানিয়েছে, এই আইন তারা প্রয়োগ করবে না।
তবে বিপরীতে, প্রতিষ্ঠানের ভেতরের কঠোরপন্থীরা যতটা সম্ভব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের চেষ্টা করছে।
এই সপ্তাহে তেহরানের কেন্দ্রস্থলে তোলা একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সেখানে দেখা যায়, তরুণ-তরুণীরা ধর্মীয় পোশাকবিধি অগ্রাহ্য করে রাস্তায় সংগীত পরিবেশনা উপভোগ করছে। কয়েক বছর ধরে সংগীতশিল্পীরা রাস্তায় গান গাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আসছেন। এখন এসব অনুষ্ঠান কিছুটা সাধারণ হলেও, অতিরিক্ত জনপ্রিয় হলে পুলিশি দমন অভিযান হয়।
ভিডিওর এক ব্যান্ড সদস্যের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। পুলিশ জানায়, ‘অপরাধমূলক কনটেন্ট প্রকাশের’ কারণে আদালতের নির্দেশে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করা হয়েছে। ওই সদস্যের বিরুদ্ধে আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, তা এখনো জানা যায়নি।
এদিকে, রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যমগুলো তেহরানে আরেকটি অভিযানের খবর দিয়েছে। ফার্স নিউজের তথ্যমতে, পাকদাশত এলাকায় ‘ছেলে ও নগ্ন নারীদের নাচসহ ডিস্কো পার্টি’র টিকিট বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে এবং আয়োজকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এটি আসলে একটি ইলেকট্রনিক মিউজিক ইভেন্ট ছিল, যা সরকারের অনুমতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছিল।
ইরানে জনসমক্ষে নাচ, বিশেষত নারী ও পুরুষের একসঙ্গে নাচ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং প্রায়ই দণ্ডনীয়। মদ্যপানও সম্পূর্ণ অবৈধ। ফলে অনেকেই পাচার করা বা ঘরে তৈরি অ্যালকোহল পান করেন, যা প্রায়ই বিষাক্ত হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়।
তবু কিছু ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টে ডিজে ভাড়া করে গান বাজানো হয়, এমনকি গোপনে মদও পরিবেশন করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে তেহরানের নাহজোল বালাঘে পার্কে অবস্থিত একটি বড় রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ একটি ভিডিওতে দেখা যায় সেখানে মানুষ নাচছে এবং মদ পরিবেশন করার অভিযোগ ছিল।
গত কয়েক সপ্তাহে আরও কয়েকটি পোশাকের দোকান ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারণ তারা তরুণদের নিয়ে নাচের আয়োজন করেছিল। একই মাসে, তেহরানের আজাদি টাওয়ারে আয়োজিত একটি বড় কনসার্টও বাতিল করা হয়, যা মূলত সরকার জাতীয় ঐক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আয়োজন করেছিল।
এই ঘটনাগুলো ইরানি প্রশাসনের অন্তর্দ্বন্দ্বকে স্পষ্ট করে। সরকার অনেক সময় নীতিনির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বিপ্লবী গার্ডসহ অন্যান্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান চাইলে সরকারি সিদ্ধান্তকেও অমান্য করতে পারে—এটাই ইরানের বর্তমান বাস্তবতা।
তুরস্কে এক বিক্ষোভে একজন ইরানি মহিলা নাচছেন। ইরানে প্রকাশ্যে নাচ নিষিদ্ধ। ছবি: বিবিসি।
হিজাব আইন ও অনলাইন স্বাধীনতা
ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃপক্ষকে বিতর্কিত হিজাব আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ না করার নির্দেশ দিয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্র যদি কারও পোশাককে ‘অশালীন’ মনে করে, তবে নারী ও পুরুষ উভয়েরই কারাদণ্ড, বেত্রাঘাত বা জরিমানার শাস্তি হতে পারে।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশজুড়ে দীর্ঘ ও সহিংস বিক্ষোভ হয়। ২২ বছর বয়সী এই তরুণীকে হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল নৈতিকতা পুলিশ এবং হেফাজতে তার মৃত্যু দেশজুড়ে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়।
প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সরকার দাবি করেছে যে নৈতিকতা পুলিশের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। তবুও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশের বিভিন্ন শহরে তাদের গাড়ি দেখা গেছে।
রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো নারী মোটরসাইকেল চালকরা। এখনো তাদের জন্য মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হয় না। সরকার এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেছে, কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকে রক্ষণশীলদের প্রভাবাধীন সংসদে সেটি আটকে আছে।
তবুও ক্রমেই আরও বেশি নারী মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তেহরানে শত শত নারী একসঙ্গে বাইক রাইডে অংশ নেওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।
পেজেশকিয়ান সরকারের আরেকটি প্রতিশ্রুতি ছিল কঠোর ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা এবং আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। কিন্তু সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
এই সপ্তাহে সরকার দাবি করেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, জুন মাসের সংঘাত না ঘটলে নিষেধাজ্ঞাগুলো ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হতো।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও লেখিকা আজাদে মোয়াভেনি আল জাজিরাকে বলেন, ইরানের তরুণ প্রজন্ম কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিই আস্থা রাখে না, কারণ কেউই তাদের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের বাস্তববাদী গোষ্ঠীগুলো কেবল নিজেদের হতাশাই প্রকাশ করছে। এর কোনো মূল্য নেই। সর্বোচ্চ যা করছে, তা হলো প্রেসিডেন্টের মতো বলে দিচ্ছে যে তিনি এমন আইন প্রয়োগ করবেন না, যা অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করে না— যেমন হিজাব আইন।’
মোয়াভেনি মনে করেন, সমাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য কখনো স্বাধীনতা শিথিল করা, আবার কখনো কঠোর করা—এই কৌশল এখন আর কার্যকর নয়। সমাজে দ্রুত পরিবর্তন, ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট এবং একাধিক চলমান সঙ্কট ইরানিদের দৈনন্দিন জীবন বদলে দিয়েছে, যার ফলে পুরনো পদ্ধতি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সূত্র: আল-জাজিরা