গাজায় ইসরায়েলি হামলার দুই বছর
স্ট্রিম ডেস্ক
ইসরায়েল ধীরে ধীরে খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে—বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মত এমনটাই।
চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিকে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের করা দাবিকে স্বীকার করে নেয় জাতিসংঘ। এর এক মাস পরই, জাতিসংঘের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে।
এই ঘোষণার পরপরই জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান টম ফ্লেচারের মতো শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বারবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েলের ‘পরিকল্পিত বাধা’ বন্ধ করার আহ্বান জানান। কিন্তু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সরকার কখনোই এই অভিযোগ স্বীকার করেনি।
জেনেভা-ভিত্তিক ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের চেয়ারম্যান রামি আবদুর মতে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি জিনিসপত্র আটকে দেওয়ার এই নীতিই প্রমাণ করে, ইসরায়েল গাজাকে অনাহারে রেখে আরও ফিলিস্তিনিকে হত্যা করতে চায়।
তুরস্ক-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে রামি আবদু বলেন, ‘গাজার দুর্ভিক্ষ অন্য দুর্ভিক্ষের চেয়ে আলাদা। এই দুর্ভিক্ষ শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক সংকটের ফল নয়। বরং, এটি খাদ্য ও জলকে যুদ্ধের অস্ত্র এবং গণহত্যার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একটি নীতি।’
আবদু জোর দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবে তাদের এই উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে আসছেন। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে “অনাহার/ক্ষুধা”কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা একটি যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু গাজায় এই অপরাধটি প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনেই করা হচ্ছে।’
২০২৩ সালের অক্টোবরের অনেক আগে থেকেই ইসরায়েল গাজার খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করে আসছিল।
২০০৬ সালে গাজার সমস্ত সীমান্ত পারাপারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ইসরায়েল একটি অবরোধ আরোপ করে। যার মাধ্যমে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জন্য প্রতিদিন কত ক্যালোরি খাবার বরাদ্দ হবে, সেটাও ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ হিসাব করে দিত।
আবদু জানান, ২০২৩ সাল নাগাদ গাজার প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনির মধ্যে চারজনই ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ এবং রক্তস্বল্পতার মতো অপুষ্টিজনিত রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আবদু আরও জানান, এই পরিকল্পনার কারণে গাজার বাসিন্দারা বিদেশি সাহায্যের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে তাদের আর কোনো উপায় থাকে না।
আবদু বলেন, ‘যখন ইসরায়েল সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেয়, তখন স্থানীয়ভাবে খাবারের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। একই সময়ে, গাজার খাদ্যের মূল উৎসের জমিগুলোতে ইসরায়েল বোমা ফেলে এবং বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর, যখন ইসরায়েল গাজার ওপর “সম্পূর্ণ অবরোধ” ঘোষণা করে এবং খাদ্য, জল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। রাতারাতি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, ত্রাণের গাড়িগুলো সীমান্তে আটকে পড়ে এবং সংকট আরও গভীর হয়। জ্বালানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রুটির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, জলের পাম্প অকেজো হয়ে পড়ে এবং ট্রাক চলাচল থেমে যায়। ফলে, খাবার তৈরি, সংরক্ষণ বা পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ জলের অভাবে রোগের প্রকোপ বাড়ে, যা ক্ষুধাকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।’
আবদু আরও বলেন, ‘কৃষিজমি ধ্বংস এবং মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল গাজার খাদ্যের উৎসগুলোকে ধ্বংস করার একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি পরিকল্পনার অংশ।’
আবদু’র মতে, ‘ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল, সেটাকেই তারা ধীরগতির বিনাশের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমা হামলার ফলে গাজায় ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভিড় বেড়েছে এবং সীমিত ত্রাণ সরবরাহের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে, প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি এই বিধ্বস্ত ভূখণ্ডে বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে।
আবদু বলেন, ‘হঠাৎ করে পালিয়ে যেতে হওয়ায় মানুষ প্রায়শই সবকিছু ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর সবচেয়ে মারাত্মক শিকার হয়েছে শিশু এবং গর্ভবতী মহিলারা। ক্ষুধা, রোগ এবং বিশুদ্ধ জলের অভাব—এই তিনটি মিলে খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের অধিকারের একটি ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে, গাজার প্রধান মানবিক সাহায্য সংস্থা জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর বিরুদ্ধে ইসরায়েল তাদের অভিযান আরও জোরদার করে।
বিভিন্ন দেশ সাহায্য স্থগিত করলে সংস্থাটি কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। তাদের গুদামে বোমা হামলা হয়, ত্রাণবাহী গাড়ি আটকে দেওয়া হয় এবং লুটপাটের খবরও পাওয়া যায়।
২০২৪ সালের শুরু থেকে ইসরায়েল উত্তর গাজায় ত্রাণ প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ করে দেয় এবং অক্টোবরের অভিযানের পর সেই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে।
২০২৪ সালের মে মাসে রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার সঙ্গে বাইরের বিশ্বের শেষ সংযোগটুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এক বছর পর, ২০২৫ সালের মে মাসে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) চালু করে।
কিন্তু এই সংস্থা সাহায্য পৌঁছানোর পরিবর্তে ত্রাণ ব্যবস্থাকে সামরিকীকরণ করছে বলে অভিযোগ করে জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। জিএইচএফের তৈরি ‘এইড জোন’ বা ‘সাহায্য অঞ্চল’-গুলোকে ‘মৃত্যু ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের মতে, ২০২৫ সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭৬০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার জনই জিএইচএফ-এর ত্রাণকেন্দ্রের কাছে মারা গেছেন।
আবদু বলেন, ‘ইসরায়েলের কার্যকলাপ ও বিবৃতির দিকে তাকালে একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে—দীর্ঘদিনের অবরোধ, সীমান্ত বন্ধ করা, ত্রাণে বাধা দেওয়া, খাবারের গুদামে হামলা, কৃষিজমি ধ্বংস, মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ত্রাণ লুট, ত্রাণ সংগ্রহের লাইনে থাকা মানুষের ওপর হামলা, পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর আক্রমণ, বারবার অবৈধভাবে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ এবং এমনকি তথাকথিত “গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন” তৈরি করা। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত নীতি।
চলতি বছরের ২২ আগস্ট, ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে গাজার কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। এর মানে হলো চরম খাদ্য সংকট, তীব্র অপুষ্টি এবং অনাহারজনিত মৃত্যু—এই তিনটি সূচকই বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের কারণে কমপক্ষে ৪৬০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ১৫০ জনেরও বেশি শিশু।
এই সংকট এতটাই তীব্র যে গাজা শহরে প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
আবদু বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পরেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনে ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো উপেক্ষা করে চলেছে।’
আবদু আরও বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের স্বীকৃতি মূলত আইনি ও নৈতিক ঐক্যমত্যকে শক্তিশালী করে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)-এর মতো প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতার ভিত্তি তৈরি করে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখা একটি যুদ্ধাপরাধ। যেভাবে উদ্দেশ্য এবং পরিণতির প্রমাণ বাড়ছে, তাতে এই কাজগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে।’
সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে—ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে।
দুই বছর তদন্তের পর কমিশন জানায়, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনী ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি গণহত্যার মধ্যে চারটিই করেছে। যেমন—গণহত্যা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে জীবনযাত্রার ওপর আঘাত হানা এবং জন্ম প্রতিরোধ করা।
কমিশন তাদের রিপোর্টে বলে, ‘ইসরায়েল রাষ্ট্র গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ, গণহত্যা চালানো এবং এর জন্য দায়ীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী।’
১৬ সেপ্টেম্বরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই তার অনাহার নীতি বন্ধ করতে হবে, অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং মানবিক সাহায্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
আবদু জোর দিয়ে বলেন, ‘এই ঘোষণার একটি বড় গুরুত্ব থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।’
আবদু বলেন, ‘ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে প্রতিরোধ ও শাস্তির মতো বাধ্যবাধকতাগুলো কার্যকর হওয়া উচিত। এর মানে হলো, ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ও আইনি চাপ তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে, এর কিছুই করা হয়নি।’
তুরস্ক-ভিত্তিক সংবাদসংস্থা আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।
ইসরায়েল ধীরে ধীরে খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে—বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মত এমনটাই।
চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিকে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের করা দাবিকে স্বীকার করে নেয় জাতিসংঘ। এর এক মাস পরই, জাতিসংঘের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে।
এই ঘোষণার পরপরই জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান টম ফ্লেচারের মতো শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বারবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েলের ‘পরিকল্পিত বাধা’ বন্ধ করার আহ্বান জানান। কিন্তু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সরকার কখনোই এই অভিযোগ স্বীকার করেনি।
জেনেভা-ভিত্তিক ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের চেয়ারম্যান রামি আবদুর মতে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি জিনিসপত্র আটকে দেওয়ার এই নীতিই প্রমাণ করে, ইসরায়েল গাজাকে অনাহারে রেখে আরও ফিলিস্তিনিকে হত্যা করতে চায়।
তুরস্ক-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে রামি আবদু বলেন, ‘গাজার দুর্ভিক্ষ অন্য দুর্ভিক্ষের চেয়ে আলাদা। এই দুর্ভিক্ষ শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক সংকটের ফল নয়। বরং, এটি খাদ্য ও জলকে যুদ্ধের অস্ত্র এবং গণহত্যার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একটি নীতি।’
আবদু জোর দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবে তাদের এই উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে আসছেন। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে “অনাহার/ক্ষুধা”কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা একটি যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু গাজায় এই অপরাধটি প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনেই করা হচ্ছে।’
২০২৩ সালের অক্টোবরের অনেক আগে থেকেই ইসরায়েল গাজার খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করে আসছিল।
২০০৬ সালে গাজার সমস্ত সীমান্ত পারাপারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ইসরায়েল একটি অবরোধ আরোপ করে। যার মাধ্যমে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জন্য প্রতিদিন কত ক্যালোরি খাবার বরাদ্দ হবে, সেটাও ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ হিসাব করে দিত।
আবদু জানান, ২০২৩ সাল নাগাদ গাজার প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনির মধ্যে চারজনই ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ এবং রক্তস্বল্পতার মতো অপুষ্টিজনিত রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আবদু আরও জানান, এই পরিকল্পনার কারণে গাজার বাসিন্দারা বিদেশি সাহায্যের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে তাদের আর কোনো উপায় থাকে না।
আবদু বলেন, ‘যখন ইসরায়েল সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেয়, তখন স্থানীয়ভাবে খাবারের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। একই সময়ে, গাজার খাদ্যের মূল উৎসের জমিগুলোতে ইসরায়েল বোমা ফেলে এবং বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর, যখন ইসরায়েল গাজার ওপর “সম্পূর্ণ অবরোধ” ঘোষণা করে এবং খাদ্য, জল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। রাতারাতি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, ত্রাণের গাড়িগুলো সীমান্তে আটকে পড়ে এবং সংকট আরও গভীর হয়। জ্বালানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রুটির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, জলের পাম্প অকেজো হয়ে পড়ে এবং ট্রাক চলাচল থেমে যায়। ফলে, খাবার তৈরি, সংরক্ষণ বা পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ জলের অভাবে রোগের প্রকোপ বাড়ে, যা ক্ষুধাকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।’
আবদু আরও বলেন, ‘কৃষিজমি ধ্বংস এবং মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল গাজার খাদ্যের উৎসগুলোকে ধ্বংস করার একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি পরিকল্পনার অংশ।’
আবদু’র মতে, ‘ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল, সেটাকেই তারা ধীরগতির বিনাশের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমা হামলার ফলে গাজায় ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভিড় বেড়েছে এবং সীমিত ত্রাণ সরবরাহের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে, প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি এই বিধ্বস্ত ভূখণ্ডে বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে।
আবদু বলেন, ‘হঠাৎ করে পালিয়ে যেতে হওয়ায় মানুষ প্রায়শই সবকিছু ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর সবচেয়ে মারাত্মক শিকার হয়েছে শিশু এবং গর্ভবতী মহিলারা। ক্ষুধা, রোগ এবং বিশুদ্ধ জলের অভাব—এই তিনটি মিলে খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের অধিকারের একটি ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে, গাজার প্রধান মানবিক সাহায্য সংস্থা জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর বিরুদ্ধে ইসরায়েল তাদের অভিযান আরও জোরদার করে।
বিভিন্ন দেশ সাহায্য স্থগিত করলে সংস্থাটি কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। তাদের গুদামে বোমা হামলা হয়, ত্রাণবাহী গাড়ি আটকে দেওয়া হয় এবং লুটপাটের খবরও পাওয়া যায়।
২০২৪ সালের শুরু থেকে ইসরায়েল উত্তর গাজায় ত্রাণ প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ করে দেয় এবং অক্টোবরের অভিযানের পর সেই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে।
২০২৪ সালের মে মাসে রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার সঙ্গে বাইরের বিশ্বের শেষ সংযোগটুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এক বছর পর, ২০২৫ সালের মে মাসে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) চালু করে।
কিন্তু এই সংস্থা সাহায্য পৌঁছানোর পরিবর্তে ত্রাণ ব্যবস্থাকে সামরিকীকরণ করছে বলে অভিযোগ করে জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। জিএইচএফের তৈরি ‘এইড জোন’ বা ‘সাহায্য অঞ্চল’-গুলোকে ‘মৃত্যু ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের মতে, ২০২৫ সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭৬০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার জনই জিএইচএফ-এর ত্রাণকেন্দ্রের কাছে মারা গেছেন।
আবদু বলেন, ‘ইসরায়েলের কার্যকলাপ ও বিবৃতির দিকে তাকালে একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে—দীর্ঘদিনের অবরোধ, সীমান্ত বন্ধ করা, ত্রাণে বাধা দেওয়া, খাবারের গুদামে হামলা, কৃষিজমি ধ্বংস, মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ত্রাণ লুট, ত্রাণ সংগ্রহের লাইনে থাকা মানুষের ওপর হামলা, পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর আক্রমণ, বারবার অবৈধভাবে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ এবং এমনকি তথাকথিত “গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন” তৈরি করা। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত নীতি।
চলতি বছরের ২২ আগস্ট, ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে গাজার কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। এর মানে হলো চরম খাদ্য সংকট, তীব্র অপুষ্টি এবং অনাহারজনিত মৃত্যু—এই তিনটি সূচকই বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের কারণে কমপক্ষে ৪৬০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ১৫০ জনেরও বেশি শিশু।
এই সংকট এতটাই তীব্র যে গাজা শহরে প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
আবদু বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পরেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনে ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো উপেক্ষা করে চলেছে।’
আবদু আরও বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের স্বীকৃতি মূলত আইনি ও নৈতিক ঐক্যমত্যকে শক্তিশালী করে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)-এর মতো প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতার ভিত্তি তৈরি করে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখা একটি যুদ্ধাপরাধ। যেভাবে উদ্দেশ্য এবং পরিণতির প্রমাণ বাড়ছে, তাতে এই কাজগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে।’
সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে—ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে।
দুই বছর তদন্তের পর কমিশন জানায়, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনী ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে সংজ্ঞায়িত পাঁচটি গণহত্যার মধ্যে চারটিই করেছে। যেমন—গণহত্যা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে জীবনযাত্রার ওপর আঘাত হানা এবং জন্ম প্রতিরোধ করা।
কমিশন তাদের রিপোর্টে বলে, ‘ইসরায়েল রাষ্ট্র গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ, গণহত্যা চালানো এবং এর জন্য দায়ীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী।’
১৬ সেপ্টেম্বরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই তার অনাহার নীতি বন্ধ করতে হবে, অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং মানবিক সাহায্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
আবদু জোর দিয়ে বলেন, ‘এই ঘোষণার একটি বড় গুরুত্ব থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।’
আবদু বলেন, ‘ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে প্রতিরোধ ও শাস্তির মতো বাধ্যবাধকতাগুলো কার্যকর হওয়া উচিত। এর মানে হলো, ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ও আইনি চাপ তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে, এর কিছুই করা হয়নি।’
তুরস্ক-ভিত্তিক সংবাদসংস্থা আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।
অবিলম্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধে মিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চুক্তি করতে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েল পরোক্ষভাবে এই আলোচনা করছে।
২ ঘণ্টা আগেফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা থামছেই না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবনা নিয়ে যখন হামাস আলোচনা করছে, ঠিক তখনো গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় ইসরায়েলের চালানো এ ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব থেকে দেশটিকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
৩ ঘণ্টা আগেএ মাসের শুরতে গাজাগামী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে আটক করে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। এটি ছিল একটি বেসামরিক মানবিক মিশন, যার উদ্দেশ্য ছিল গাজার ওপর ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙা। এতে প্রায় ৪৫০ জন আন্তর্জাতিক অধিকার কর্মী আটক হন। ইতালি, স্পেন, নিউজিল্যান্ড, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের কর্মীরা ফেরত গিয়ে অভিযোগ করেছেন, আটক অবস্
১৯ ঘণ্টা আগেএই বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন তিন গবেষক—মেরি ই. ব্রানকাও, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচি। ‘পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স’ সম্পর্কিত আবিষ্কারের জন্য তাঁরা এ সম্মানজনক পদকে ভূষিত হচ্ছেন।
২১ ঘণ্টা আগে