leadT1ad

বঙ্গীয় বদ্বীপ থেকে বাংলাদেশ: ঐতিহাসিক শেকড়

বঙ্গীয় বদ্বীপের সমাজ, রাজনীতি ও মতাদর্শ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে আমরা ফিরে তাকিয়েছি বাংলাদেশের গত দুই হাজার বছরের পথপরিক্রমায়। জানার চেষ্টা করেছি, কীভাবে গড়ে উঠেছে এ জনপদের সমাজ, রাজনীতি ও মতাদর্শ। এই লেখায় উঠে এসেছে বঙ্গীয় বদ্বীপের পূর্বাংশ, অর্থাৎ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের রূপরেখা।

বেলাল এহসান বাকী
বেলাল এহসান বাকী

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ২১: ১৬
বঙ্গীয় বদ্বীপ থেকে বাংলাদেশ: ঐতিহাসিক শেকড়। স্ট্রিম গ্রাফিক

একটি জাতির জন্ম হয় গভীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে। আবার একটি জাতির ইতিহাস তার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়েরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাতির টিকে থাকা নির্ভর করে জাতীয় পরিচয় ও ঐক্যের শক্তির উপর। এই শক্তিই বর্তমান বিশ্বের নানা সংকট ও চাপে জাতিকে ধরে রাখে। জাতির ইতিহাস কেবল বড় ঘটনাপঞ্জি নয়। এতে থাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এছাড়া সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও ধর্মীয় বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে একটি নবীন রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস সবার জানা ও বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

এই প্রবন্ধে গত দুই হাজার বছরের ইতিহাস সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য কেবল তথ্য দেওয়া নয়। বরং সেই ইতিহাসের আলোকে সমাজের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো— বাংলাদেশ কেন একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তুলনামূলকভাবে একজাতিক জনসংখ্যার দেশ। এখানে আরেকটি বিষয়ও মনে রাখা দরকার। কোনো জাতি যদি নিজের ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়, তারা বারবার একই ভুল করে।

প্রাচীন যুগে বাংলাদেশ (প্রাগৈতিহাসিক সময় – খ্রিস্টপূর্ব ৩০০)

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে আর্যদের ভারত আক্রমণ শুরু হয়। প্রথম এক হাজার বছর তারা পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। আর্য সমাজের ভিত্তি ছিল হিন্দু ধর্ম, যা বর্ণব্যবস্থা, ব্রাহ্মণ শ্রেণির প্রাধান্য এবং সংস্কৃতভাষায় রচিত বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে তারা স্থায়ী গ্রাম স্থাপন করে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলে। বর্তমান পূর্ববঙ্গ এলাকায় তখন আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং কিছু বিচ্ছিন্ন আর্য বসতি ছিল। মহাভারতের (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০) কাহিনীতে প্রথমবার বাংলার উল্লেখ পাওয়া যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বাংলা রাজ্যও অংশ নিয়েছিল।

বৌদ্ধ যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ – খ্রিস্টীয় ১১০০)

গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। পূর্ববঙ্গের সভ্যতায় এর গভীর প্রভাব পড়ে। বৌদ্ধধর্ম ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। এটি বর্ণব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ শ্রেণিকে প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে পূর্ববঙ্গে এক ভিন্নধর্মী সমাজ গড়ে ওঠে। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের দিকে এ অঞ্চলের মানুষ প্রথম বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। এতে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব থেকে স্পষ্ট বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় এবং একটি বর্ণগত ভেদহীন সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়। বাংলার পাল সাম্রাজ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শক্তি।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পাল রাজবংশীয় বাংলার সভ্যতা বিশ্বের নানা অঞ্চলের বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর মধ্য দিয়ে সমকালীন বাংলাদেশ ক্রমাগত বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগে ছিল। আরব ও পারসিক বণিকদের যাত্রাতেও দক্ষিণ সিল্ক রোড ব্যবহৃত হতো।

পাল সাম্রাজ্য (৭৫০ – ১১৬১ খ্রি.)

পাল সাম্রাজ্যের উত্থানের আগে বাংলায় মাৎসন্যায় বা অরাজকতার কাল বিরাজ করছিল। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে স্থানীয় প্রধানরা সকলে মিলে তাদের মধ্য থেকে গোপাল নামের একজনকে নেতা নির্বাচিত করেন। তিনিই পাল রাজবংশ ও পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পালরা প্রথমবারের মতো পূর্ববঙ্গকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পালদের শাসন বাংলার পাশাপাশি বিহার ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তারা দ্রুত এক প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়।

৭০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ছিল বিশ্ব বৌদ্ধধর্মের অন্যতম কেন্দ্র। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন থেকে সন্ন্যাসীরা নিয়মিত ময়নামতি (কুমিল্লা) ও মহাস্থানগড় (রংপুর) বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে আসতেন। পাল রাজারা শিল্প, সাহিত্য ও শিক্ষার বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিক্রমশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শাসনামলে সমৃদ্ধ হয়। পাল যুগকে পূর্ববঙ্গের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ শিখর ধরা হয়।

পাল যুগে মহাস্থানগড়, ভিটাগড়, বিক্রমপুর, এগারসিন্ধুর ও সোনারগাঁও ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ডেল্টা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। পাল যুগে আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নতির মূলভিত্তি ছিল এই শক্তিশালী অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলার কেন্দ্রীয় ভূমিকা।

হিন্দু সেন রাজবংশ (১০৯৭ – ১২২৫ খ্রি.)

সেন শাসকেরা দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র অঞ্চল থেকে এসে পূর্ববঙ্গ জয় করেন। তখন কয়েক শতাব্দীর বৌদ্ধ প্রভাব হিন্দুধর্মকে দুর্বল করে রেখেছিল। সেনরা পুনরায় হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। বল্লাল সেন (১১৫৮–১১৭৯) কানৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আনেন। বহু বাঙালি ব্রাহ্মণ তাদের বংশপরিচয় এই সময় থেকে খুঁজে পান। তারা বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন চালালেও উল্লেখযোগ্য ধর্মান্তর হয়নি। মুসলিম যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ মূলত বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অধীনেই ছিল।

সুলতানি আমল (১২০২ – ১৪৯৪ খ্রি.)

১২০২ সালে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি নদীয়া থেকে লক্ষ্মণ সেনকে উৎখাত করেন। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লক্ষ্ণৌতিতে নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। এরপর ১৩৫২ সালে সমগ্র বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন।

সুলতান সিকান্দার শাহ ১৩৭৫ সালে আদিনা মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি তখনকার দিল্লি সুলতানদের মসজিদগুলোর থেকেও বড় ছিল এবং ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মসজিদে পরিণত হয়।

১৪১৫ সালে সুলতান ইব্রাহিম সার্কির চাপের মুখে রাজা গণেশ তার পুত্র যদুকে ইসলাম গ্রহণ করিয়ে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম দেন। তিনি মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন।

কিন্তু ইব্রাহিম সার্কি বাংলার বাইরে গেলে রাজা গণেশ পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পুত্রকে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন। ১৪১৮ সালে গণেশের মৃত্যুর পর জালালুদ্দিন আবার ইসলাম গ্রহণ করে সুলতান হিসেবে শাসন করেন।

বাংলার মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনের অনেক উত্তর ইসলাম দিয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলায় ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ শুরু হয়। ১৮ শতকের মধ্যে বাংলার জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলমান হয়ে ওঠে।

হোসেন শাহী রাজবংশ (১৪৯৪ – ১৫৩৮ খ্রি.)

আলা উদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৪–১৫১৯) বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান হিসেবে পরিচিত। তাঁর শাসনামলে বাংলায় সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটে। তিনি কামরূপ, কামতা, জাজনগর ও উড়িষ্যা জয় করেন এবং সুলতানাতের সীমানা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। এ সময় প্রথম পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামে আসে।

হোসেন শাহী আমলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। তাই এই যুগকে বাংলার সুলতানি আমলের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এই সময়ের শাসকেরা সাহিত্যচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয় এবং এটি আদালতের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এর আগে সংস্কৃত যেভাবে প্রাধান্য পেত, মুসলিম যুগে বাংলাভাষা সেই ভূমিকা নেয়।

নুসরাত শাহ (১৫১৯–১৫৩২) ছিলেন এই বংশের দ্বিতীয় শাসক। তিনি ইসলামি ও হিন্দু উভয় ঐতিহ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সংস্কৃত গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদের কাজ এই আমলে শুরু হয়। সাধারণ মানুষ এভাবে মহাভারতসহ নানা গ্রন্থ বাংলায় পড়তে সক্ষম হয়। নুসরাত শাহের সময়েই ১৬ শতকের শুরুর দিকে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।

মুঘল শাসন (১৫৭৬ – ১৭৬০ খ্রি.)

১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবরের সময় বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি ১৬১২ সালে চট্টগ্রাম ছাড়া পুরো বাংলাকে মুঘল শাসনের অধীনে আনেন।

সুলতানদের পতনের পর বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের উত্থান ঘটে। এদের মধ্যে সোনারগাঁওয়ের ইসা খান ছিলেন বিখ্যাত। তিনি মসনদ-ই-আলা উপাধি ধারণ করেন এবং দীর্ঘদিন মুঘলদের প্রতিরোধ করেন। তাঁর মৃত্যুর (১৫৯৯ খ্রি.) পর পুত্র মুসা খান নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরের আমলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতির কাছে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন।

মুঘল আমলেও বাংলা সমৃদ্ধ একটি প্রদেশে পরিণত হয় এবং সাম্রাজ্যের অংশ হলেও অনেকখানি স্বাধীনতা ভোগ করত।

দক্ষিণ সিল্ক রোড (১৩৫ খ্রিস্টপূর্ব–১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ) ও গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ

সিল্ক রোড ছিল একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যপথের সমষ্টি। এটি চীনের হান রাজবংশের আগেই চালু ছিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালে। এই বাণিজ্যপথ খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৪৫৩ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।

দক্ষিণ সিল্ক রোড চীনের চেংদু প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে কুনমিং অতিক্রম করে আসাম ও মিয়ানমারে প্রবেশ করত। অন্য একটি পথ ইরাবতী নদী ধরে মিয়ানমারে প্রবেশ করত, আরেকটি পথ যেত মান্দালয় হয়ে। এসব পথ শেষ পর্যন্ত মণিপুর, আসাম হয়ে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে পৌঁছাত। ফলে বদ্বীপ অঞ্চল দক্ষিণ সিল্ক রোডের প্রধান গন্তব্য ও ট্রানজিট কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পাল রাজবংশীয় বাংলার সভ্যতা বিশ্বের নানা অঞ্চলের বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর মধ্য দিয়ে সমকালীন বাংলাদেশ ক্রমাগত বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগে ছিল। আরব ও পারসিক বণিকদের যাত্রাতেও দক্ষিণ সিল্ক রোড ব্যবহৃত হতো। ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ইসলামের প্রথম সংযোগ এই পথেই বণিকদের হাত ধরে ঘটে।

পূর্ব বাংলায় ইসলাম : রূপান্তরের ইতিহাস (৬৮০–১৭৫০)

পূর্ব বাংলায় ইসলামে ধর্মান্তরের বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর একটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো—দক্ষিণ সিল্ক রোড ছিল মুসলিম বিশ্ব ও বাংলার মধ্যে বাণিজ্য ও ধর্মীয় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। আরব ও পারসিক বণিকেরা এই পথে ইসলাম প্রচার করেন এবং বহু আলেম ও সুফি পূর্ব বাংলায় আসেন। এখান থেকে ইসলাম মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়াতেও পৌঁছে।

পূর্ব বাংলার মানুষ প্রথমে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে তারা জাতিভেদ ও সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়। এতে তারা মূলত হিন্দুপ্রধান ভারতের বাকি অংশ থেকে নিজেদের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের লালমনিরহাটে, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম একটি মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয়, এটি ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত। কেউ কেউ বলেন, নবী মুহাম্মদের (সা.) সাহাবি সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৬৪৮ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এত দূরে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে মসজিদ নির্মাণের প্রমাণ আরব বণিকদের আগমনের ইঙ্গিত দেয়। পাহাড়পুর (রাজশাহী) ও ময়নামতি (কুমিল্লা) খননে আব্বাসীয় খেলাফতের (৭৫০–১২৫৮, ১২৬১–১৫১৭) মুদ্রা পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে অন্যতম প্রাচীন সুফি দরগা হলো চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর (৮০৪–৮৭৪) মাজার। এটি প্রায় ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। যদিও তাঁর আসল সমাধি ইরানে, চট্টগ্রামের মাজার তাঁর বা তাঁর অনুসারীদের আগমনের স্মৃতি বহন করে। এছাড়া বগুড়ায় সুলতান মাহমুদ (১০৪৭), ময়মনসিংহে মুহাম্মদ সুলতান রুমি (১০৫৩), এবং বিক্রমপুরে বাবা আদম (১১১৯)-এর মাজার রয়েছে।

এসব নিদর্শন প্রমাণ করে, মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার আগেই ইসলাম পূর্ব বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের অংশ হয়ে ওঠে এবং বৌদ্ধ ও হিন্দুদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তোলে। সেন রাজবংশের পতনের পর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলাম প্রচার আরও বিস্তৃত হয়।

বাংলার মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনের অনেক উত্তর ইসলাম দিয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলায় ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ শুরু হয়। ১৮ শতকের মধ্যে বাংলার জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলমান হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা ১৮৭২ সালে প্রথম জনগণনা চালায়। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার কেন্দ্রীয় জেলাগুলোতে মুসলমানের সংখ্যা ৭০ শতাংশেরও বেশি।

অনেকে মনে করেন, ইসলাম বাংলায় এসেছে ‘তলোয়ারের জোরে’। তারা দুটি কারণ দেখান—ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা এবং ১২০২ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়। কিন্তু সিল্ক রোড সম্পর্কিত গবেষণা প্রমাণ করে, এই ধারণা ঠিক নয়। ইসলাম বাংলায় প্রবেশ করে মূলত দক্ষিণ সিল্ক রোডের মাধ্যমে, যা মুসলিম শাসনেরও আগে।

ইসলাম বাংলার মানুষের জীবনধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ওঠে। বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম যেখানে সংসার থেকে বিমুখতার শিক্ষা দেয়, ইসলাম সেখানে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছে।

বাংলার মুসলমানেরা ইসলামকে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসইভাবে আত্মস্থ করে। এতে তারা বৈশ্বিক মুসলিম সমাজের অংশ হয় এবং ইসলামের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হয়।

আজকের বাংলাদেশেও ইসলাম মানুষের চেতনা ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে প্রোথিত। ইসলামে বৌদ্ধধর্মের মতো বৈরাগ্য নেই। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতে ইসলাম আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাবে।

ধর্ম পরিবর্তনের ইতিহাসে— হিন্দুধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্ম এবং মুসলিম জীবনধারায় উত্তরণ— পূর্ববঙ্গের মানুষের সচেতনতা ও বিচক্ষণতা দেখায়। তারা পুরনো রীতি, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক প্রথা ছেড়ে এমন জীবনধারা গ্রহণ করেছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেয়।

ব্রিটিশ শাসনকাল (১৭৫৭–১৯৪৭)

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পরিচয় ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। ব্রিটিশরা বাংলাসহ পুরো ভারতে মুসলিম শাসন ভেঙে নিজেদের তাদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তারা মুসলমানদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করত এবং নানা উপায়ে তাদের শক্তি দুর্বল করার চেষ্টা চালায়।

‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। তারা হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে। অথচ মুসলিম শাসনামলে প্রায় ছয় শতক ধরে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বসবাস করছিল।

১৮৩৭ সালে ব্রিটিশরা প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি চালু করে। এতে মুসলিম আলেমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ভেঙে পড়ে। তারা ধর্মীয় ক্ষেত্রের বাইরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখায় বাঙালি মুসলমানরা আরও পিছিয়ে পড়ে।

১৭৫৭ থেকে ১৮৬০-এর দশক পর্যন্ত প্রায় একশ বছর ধরে বাংলার মুসলমানদের কোনো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ছিল না। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও শিক্ষিত সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। মাদ্রাসা শিক্ষা দৈনন্দিন জীবনে অকার্যকর হয়ে পড়ে। অপরদিকে হিন্দু সমাজ শিক্ষায় ও সামাজিক উন্নয়নে অনেক এগিয়ে যায়। ফলে ১৯ শতকে এসে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা চরম দুর্বল হয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে। স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলি প্রমুখের উদ্যোগে মুসলিম সমাজে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৬০ সালের পর থেকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন চেতনার উত্থান ঘটে। সংস্কারকরা আধুনিক চিন্তা, বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলন করেন। একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে আপোষের পথ খোঁজা হয়।

এই সময়ে একটি বড় অর্জন ছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। এটি আধুনিক মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তি তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে তারাই বাংলার মুসলমান জনগণের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়।

ব্রিটিশ শাসন বাংলার অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ধ্বংস ডেকে আনে। একসময় সমৃদ্ধশালী এ অঞ্চলকে শোষণ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে তারা দারিদ্র্যের গভীরে নামিয়ে দেয়।

‘ভাগ কর, শাসন কর’ শাসন নীতি চালু করে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন গভীর করা হয়। স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে প্রাচীন পাঠশালা ও মাদ্রাসার পরিবর্তে পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। ফলে শিক্ষিত শ্রেণি নিজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৮৫৭–১৮৫৯ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ

১৮৫৭ সালে মুসলিম ও হিন্দুরা একসঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বড় বিদ্রোহ শুরু করে। বাংলার সৈন্যরা এতে মূল ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে এক লাখের বেশি মানুষ হত্যা করে। তার পরবর্তী এক দশকে মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও দমনপীড়নের ফলে প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।

ব্রিটিশরা মুসলিমদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এর ফলে বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। ১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশরা দিল্লি দখল করার পর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়। হাজারো মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়। অধিকাংশ মুসলমানকে হত্যা বা বহিষ্কার করা হয়। কেউ দিল্লিতে ফিরতে পারেনি দুই বছর পর্যন্ত। অন্যদিকে হিন্দুদের তুলনামূলক দ্রুত ফিরতে দেওয়া হয়।

বাংলা ভাষা (১২০৪–১৯৫২)

বাংলা ভাষা বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে একটি। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ষষ্ঠ ভাষা। বাংলা উদ্ভূত হয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত ও পূর্ব ভারতের কথ্য উপভাষা থেকে। বাংলা গঠনের ইতিহাস জটিল। এটি প্রাকৃত উপভাষা ও পালি ভাষার প্রভাব মিশ্রিত হয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে উদ্ভূত হয়। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পালিতে লেখা হয়। বাংলা মূলত মাগধী (পূর্ব) প্রাকৃত ও সংস্কৃতের মিশেল থেকে উদ্ভূত। বাংলার প্রথম লিখিত রূপে পাওয়া যায় চর্যাপদে, যা ১০–১২ শতকের বৌদ্ধ তান্ত্রিক গান।

তবে বাংলা ভাষার প্রধান বিকাশ ঘটে ১৪০০–১৮০০ সালে সুলতানি আমলে। এসময় বাংলা সুলতানদের আদালতে ব্যবহৃত হতো। ফারসি ছিল মূল প্রশাসনিক ও সরকারি ভাষা। আর স্থানীয় প্রশাসন ও কর আদায়ে ব্যবহৃত হতো বাংলা। কিছু ক্বাজির ফতোয়া বাংলায় অনূদিত হতো। সুলতানি মুদ্রায় আরবি/ফারসির পাশাপাশি বাংলা লিপিও দেখা যায়।

সুলতানি যুগের প্রচেষ্টাই আধুনিক বাংলার ভিত্তি তৈরি করে। হোসেন শাহি রাজবংশের শাসনে হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদান রাখে। মুসলিম শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষা তার স্বাতন্ত্র্য পায়। ফারসি ও আরবি শব্দভাণ্ডার সংযোজন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।

আধুনিক বাংলা ভাষা ব্রিটিশ শাসনের সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিকশিত হয়। ব্রিটিশ শাসক ও তাদের পণ্ডিতরা বাংলাকে সংস্কৃত শব্দবহুল করে গড়ে তোলে। হাজারো ফারসি ও আরবি শব্দ বাদ দেওয়া হয়।

বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন ব্রিটিশ শাসনের একটি পরিকল্পিত প্রকল্প ছিল। এর মধ্য দিয়ে হিন্দু পরিচয় শক্তিশালী করা ও মুসলিম অবদান কমানো লক্ষ্য ছিল। বাংলা ভাষার নেতৃত্ব হিন্দু বাঙালির হাতে চলে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক লেখা থেকে রবীন্দ্রনাথের উদার সাহিত্য পর্যন্ত এই প্রভাব দেখা যায়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) পরিচয়ের মূল উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বর্তমানে বাংলা ভাষার দুটি রূপ প্রচলিত— বাংলাদেশে ফারসি প্রভাবিত বাংলা, পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতভিত্তিক বাংলা। ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষা ব্যবহার করে।

বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ও মুসলিম পরিচয় উভয়ই প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কিছু বাঙালি মুসলমানের জন্য এক পরিচয় অন্যটির তুলনায় প্রাধান্য পায়। তবে, যেহেতু বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই ভবিষ্যতে দুটি পরিচয়ের সংমিশ্রণে গঠিত সমাজ প্রাধান্য পাবে।

পাকিস্তানি শাসনকাল (১৯৪৭–১৯৭১)

১৯৪৭ সালে ভারতের অধিকাংশ প্রদেশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলোর জন্য পাকিস্তান গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি ঘটে মূলত ১৯২০–৪০ দশকে মুসলিম বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থানের ফল হিসেবে।

পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি আসলে শহুরে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটায়। বড় জমিদারদের অধিকাংশ হিন্দু ছিলেন, যারা ১৯৪৭ সালের পর ভারত চলে যান। এই কারণে বাংলাদেশের সমাজ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সমতাভিত্তিক হয়।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক অসম ছিল। অর্থনীতি, প্রশাসন ও সামরিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য ছিল। ফলে দুই প্রান্তের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হতো। রপ্তানি আয় ও আর্থিক সম্পদ অসমভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত।

পূর্ব পাকিস্তান এই অসম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিরোধের প্রধান মাধ্যম হয়। এই লড়াই শেষ পর্যন্ত নতুন পরিচয়ের জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় ছাড়িয়ে নতুন জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে।

দুই প্রান্তের বৈষম্য দূর করার দাবিটি চূড়ান্তভাবে সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে। এর ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশের উদ্ভব (১৯৭১)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সমস্ত বাংলাদেশি অংশ নেন। তাদের ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা জাতিগত পরিচয় যাই হোক না কেন, সবাই সমান উদ্দীপনায় লড়াই করেন। মুক্তিযুদ্ধের ফলে একটি স্বাধীন দেশ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সকল মানুষ— ধর্ম, জাতি বা বিশ্বাস নির্বিশেষে— একত্রে এক জাতি হিসেবে বসবাস করতে পারে। সমাজের সকল স্তরের অবারিত বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ও মুসলিম পরিচয় উভয়ই প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কিছু বাঙালি মুসলমানের জন্য এক পরিচয় অন্যটির তুলনায় প্রাধান্য পায়। তবে, যেহেতু বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই ভবিষ্যতে দুটি পরিচয়ের সংমিশ্রণে গঠিত সমাজ প্রাধান্য পাবে।

উপসংহার

পূর্ববঙ্গের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। দুই শতকের ব্রিটিশ শাসন বিরোধী লড়াই, আর বৌদ্ধ ও মুসলিম যুগ মিলিয়ে দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই লড়াই চলে এসেছে।

বাংলাদেশের মূল পরিচয় একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গঠন থেকে উদ্ভূত, যা দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। প্রাচীন ভারতের বঙ্গ-সমতট-বরেন্দ্র অঞ্চল— বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ববঙ্গ—সবসময়ই ভারতের অন্যান্য অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় স্বতন্ত্র অঞ্চল ছিল।

ধর্ম পরিবর্তনের ইতিহাস— হিন্দুধর্ম থেকে বৌদ্ধধর্ম এবং মুসলিম জীবনধারায় উত্তরণ— পূর্ববঙ্গের মানুষের সচেতনতা ও বিচক্ষণতা দেখায়। তারা পুরনো রীতি, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক প্রথা ছেড়ে এমন জীবনধারা গ্রহণ করেছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দেয়।

আধুনিক যুগে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং সর্বশেষ জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এই সচেতনতা প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রতিটি বিপ্লবী পদক্ষেপ মানুষের অধিকারের জন্য এবং অত্যাচারী শাসকের শাসন থেকে মুক্তির জন্য নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এবং সেই সঙ্গে সমাজে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে শক্তিশালী জাতীয় পরিচয় প্রয়োজন। ইতিহাসের জ্ঞান জাতীয় পরিচয়ের মূল ভিত্তি।

দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যের সংযোগবিন্দু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সবসময় বিশ্ব সভ্যতার সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগে ছিল।

আন্তর্জাতিক পরিবেশে সাম্প্রতিক বিশাল পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এটি আবারও বিশ্বের বৈশ্বিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ফিরে আসতে পারে।

লেখক: সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক

Ad 300x250

সম্পর্কিত