বঙ্গীয়-বদ্বীপের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি তথা এই বদ্বীপ নিয়েই মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ফিরে তাকিয়েছি বাংলাদেশের গত দুই হাজার বছরের পথপরিক্রমায়। বঙ্গীয়-বদ্বীপ আমাদের বাংলা সাহিত্যে কীভাবে ধরা দিয়েছে? বিপুলায়তন বাংলা সাহিত্য এই বদ্বীপের ভাব ও তৎপরতাকে কি ধরতে পেরেছে?
সুমন সাজ্জাদ
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলা দেশ’–কী দারুণ এক কল্পনা; উত্তরে আকাশসমান হিমালয়, দক্ষিণে চোখের সম্পূর্ণ সীমানায় ধরা পড়ে আদিগন্ত সমুদ্র; দুই বিশালতার ঠিক মাঝখানে বাংলাদেশ। কবির কল্পনা আর ঐতিহাসিকের চোখে এইটুকুই ‘বঙ্গীয় বদ্বীপ’।
ভাবতে ভালো লাগে, এক আকস্মিক প্রাকৃতিক ঘটনায় জেগে উঠেছে হিমালয়; আর তার গা বেয়ে নেমে এসেছে শত-সহস্র নদী। বরফগলা সেই সব নদী ছুটে গেছে অগণিত ধারায়। তারপর জঙ্গল কেটে সাফসুতরো করে মানববসতি হলো। আধুনিক ইতিহাসের বিচারে ‘প্রকৃতি’র সঙ্গে দেখা হলো ‘সংস্কৃতি’র।
দাগ, নকশা আর কাঁটাতারঘেরা মানচিত্র সেখানে নেই। আছে শুধু অবিরল জলের প্রবাহ, মৌসুমি বাতাস, বৃষ্টি, পলিমাটির গন্ধ; আছে জঙ্গল, ঘাস, লতাগুল্ম, আকাশ ছুঁইছুঁই সবুজ গাছেদের সারি। এই বদ্বীপে নদী ভাঙে, নদী গড়ে; প্রবহমান স্রোত বয়ে আনে পলি, পলি জমে জমে গড়ে ওঠে ভূমি; ভূমিতে বসতি হয়, আবার ভেঙে যায়। ভারতীয় চিন্তা-ঐতিহ্যের পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, এ এক ‘ভবচক্র’–বাংলা অঞ্চলের মানুষের জন্য চিরায়ত এক প্রাকৃতিক সত্য।
প্রশ্ন হলো, বিপুলায়তন বাংলা সাহিত্য এই বদ্বীপের ভাব ও তৎপরতাকে কি ধরতে পেরেছে? সাহিত্যে কীভাবে আছে তার চিহ্ন? বদ্বীপ বলতে কি আমরা বাংলাদেশের সমুদয় ভূখণ্ডকে বুঝব? নাকি বিশেষভাবে বুঝব এ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকে, যেখানে নদীগুলো মিশে গেছে সমুদ্রে, মিঠা পানি মিতালি পাতিয়েছে নুনের দরিয়ায়। ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদের ভাষ্যে ‘বদ্বীপে’র নিখুঁত সংজ্ঞার্থ আমরা পাব। কিন্তু আপাতত দেখতে চাই সাহিত্যের সেই সীমা-সরহদ্দ, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ ও জনপদকে চিহ্নিত করা যায় বদ্বীপের প্রাকৃতিক ও আঞ্চলিক বিশিষ্টতায়।
এই সূত্রে বলতে হয়, বিদ্যমান প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে যে সমাজ আর সংস্কৃতিই গড়ে উঠুক না কেন তাকে বহন করতে হয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের চিহ্ন। এ কারণে বদ্বীপ অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিককে বলতে হয় নদী, পলিমাটি, চর, জল, ঝড় ও জঙ্গলের গল্প। একজন কবিকে হয়তো ধারণ করতে হয় হাজার পাখির কলধ্বনি। তাকে আঁকতে হয় ঝিঁঝিডাকা সন্ধ্যার নির্জনতাকে।
কিন্তু বদ্বীপের সাহিত্যমাত্রই কি দ্বীপভূমির প্রতিনিধিত্ব করে? তা কিন্তু নয়। কেননা অনেকের কাছে বদ্বীপের পটভূমি লেখালেখির ব্যক্তিক অনুষঙ্গমাত্র। মূলত আমরা এক বিশেষ সাহিত্যধারার কথা ভাবছি–যে সাহিত্যে বঙ্গীয় বদ্বীপের জল, মাটি, আবহাওয়া, প্রাণী, উদ্ভিদ আর মানুষের চলিষ্ণুতাকে ধারণ করেছে, বিশদ বিবরণে হাজির করেছে ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্যপট।
দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহমাখা সাহিত্য রচিত হলেও ‘লোকাল কালার’ বা আঞ্চলিক বর্ণগন্ধসমেত বঙ্গীয় বদ্বীপকেন্দ্রিক শক্তিশালী কোনো সাহিত্যধারা বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি; বলা ভালো, আমার এই মন্তব্য বিশেষভাবে আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একই সঙ্গে উল্লেখ্য যে মৌখিক সাহিত্যধারা ঐতিহ্যগতভাবেই অঞ্চল ও প্রকৃতির বিশেষ অনুগামী। এ কারণে লোকায়ত সাহিত্যে উঠে আসে বদ্বীপ অঞ্চলের জলজ জীবন ও অভিজ্ঞতার বয়ান।
যে সাহিত্য বদ্বীপ অঞ্চলের বিশিষ্টতাকে স্বতন্ত্রভাবে বুঝতে চাইবে তাকে অবশ্যই আঞ্চলিক ভূমিগঠন, বসতিস্থাপন, প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট, জলবায়ুর সঙ্গে মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে বুঝতে হবে। ভাবতে হবে, সাহিত্যে এসব উপস্থাপনের বিশিষ্ট ভঙ্গিমার কথাও। দেখতে পাই, বাংলাদেশের সাহিত্যে বদ্বীপীয় মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সম্পর্ককে খুব কম লেখকই বুঝতে চেয়েছেন।
যাঁরা খুব মনোযোগের সঙ্গে এ ভূমিকে লক্ষ করেছেন, তাঁদের লেখায় এসে পড়েছে বাংলার নদীর গল্প। সত্যিকার অর্থে, নদীকথা ছাড়া বদ্বীপের ইতিহাস হয় না। শত শত নদী মরে গেলেও বাংলাদেশের কথা বলতে গেলেই আগেভাগে উঠে আসে নদীর কথকতা। স্মৃতি আমাদের উসকানি দেয়–সেই কবে কত শত নদীর স্রোতে ভেঙেগড়ে তৈরি হয়েছে এই বঙ্গভূমি। মনসার ভাসান, গীতিকার পালায় সতত প্রবহমান নদী।
কে না জানে, এ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ নদীকে করেছে জীবনের সহচর। অথবা এদেশের মানুষ চিরকাল পলিমাটি আর জলের সহোদর। নদী মানে ঢেউ, স্রোত, ভাঙন। আর এদেশের মানুষের জীবন যেন তা-ই। বদ্বীপ অঞ্চলের সাহিত্যে তাই নদী আসে নানা মাত্রায়। এ অঞ্চলেই প্রবাদ হিসেবে তৈরি হয়েছে ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’।
এই বদ্বীপে আমরাই এক বেহুলাকে কল্পনা করেছি, মৃত স্বামীর শবদেহ নিয়ে যে ভেসে চলেছে গাঙুরের জলে। পেরিয়ে গেছে ঘাটের পর ঘাট। `পদ্মাপুরাণ’ কাব্যে বিজয় গুপ্ত এঁকেছেন সেই নদীবাহিত পথরেখা, জলজ জীবনের ছবি। দক্ষিণবঙ্গের এই জীবনচক্র নন্দনতাত্ত্বিক অভিনবত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য়। আধুনিকতাবাদী কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম দক্ষিণবঙ্গের প্রাণ ও প্রকৃতিকে দিয়েছেন চিরায়ত আসন। সৌন্দর্যের আধার হিসেবে তাঁর ‘রূপসী বাংলা’য় উঠে এল বঙ্গীয় বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন উপাদান–বৃক্ষ, লতাপাতা, পতঙ্গের নাম।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও প্রবলভাবে লেগেছিল এ অঞ্চলের হাওয়া। পূর্ববঙ্গে এসে ঘর থেকে মাত্র দুই পা ফেলেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন পদ্মার মতো প্রমত্তা নদী। আসলে পেয়েছিলেন ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় এক বদ্বীপভূমি; ভূগোলের ভাষা অন্তত তা-ই বলে। পদ্মা তখনও খরস্রোতা। কুষ্টিয়া, শিলাইদহ, সাজাদপুরে পদ্মার ঢেউ আঘাত হানে দুই পারের দুই তটভূমিতে। পূর্ববঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছে তার অবয়ব।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পদ্মা স্বয়ং এক চরিত্র। গম্ভীর-খরস্রোতা পদ্মা রবীন্দ্রজীবনে বইয়ে দিল সৃষ্টির বন্যা। পদ্মাবিধৌত বঙ্গের প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে চিনলেন তিনি। মহাবৈশ্বিক এক দার্শনিকতার আবরণে তিনি আঁকলেন তার ছবি। কিন্তু সৌন্দর্যের এই বয়ানের আড়ালে চাপা পড়ে ছিল অন্য কিছু; ভূসংস্থান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরে সেখানে আছে সামন্তবাদী শোষণের গল্প; চরদখলের আখ্যানে ভেতর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্প। পূর্ব বাংলার কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন সংগ্রামের দেখা পাব জসীম উদ্দীনের সাহিত্যে। ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট ’–এই দুই কাব্যকে অনায়াসে বলা চলে বঙ্গীয় বদ্বীপের এক কালচারাল টেক্সট বা সাংস্কৃতিক রচনা।
ইতিহাসের পরিকাঠামো দিয়ে মাপলে বোঝা যায়, জসীমউদ্দীন বদ্বীপের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। আর তাই দেখিয়েছেন সহাবস্থানের সামাজিক সত্তাকে ধ্বংস করতে চায় সামন্তবাদী ক্ষমতার সম্পর্ক। `সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘ কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে বহু চাষী মুসলমান ও নমশূদ্রের বাস। তাহাদের মাঝে সামান্য সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়।’ জসীম উদদীনের ভাষ্যে, ছোটখাটো বিবাদগুলোকে বড় করে তুলত বিত্তবান হিন্দু-মুসলমানেরা। তিনি সেটিকে বলেছেন, ‘সর্বনাশের পথে আগাইয়া’ দেওয়া। কৃষিনির্ভর জনপদের অভিজ্ঞতা থেকে জসীম উদ্দীন জানাচ্ছেন, ‘মহাজন ও জমীদারের মধ্যে কোন জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা পৃথিবীতে সকলেই এক জাতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগা নমশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয় তাহা চক্ষে দেখিলে অশ্রুসম্বরণ করা যায় না।’ আর এই বাস্তবতার দেখা মিলবে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ।
কিন্তু বঙ্গীয় বদ্বীপের আখ্যান তো আরও দীর্ঘ–তার শরীরে জড়িয়ে থাকা নদীর মতোই তা বিসর্পিল। এই গল্প দীর্ঘায়িত পরিসরে উঠে এসেছে বেশ কিছু উপন্যাসে–যে গল্পের রেখাচিত্র নেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রদের আখ্যানে। কেননা তাঁরা বসত গাঁড়েননি নদীর শেষ প্রান্তে কিংবা নদী ও সমুদ্রের মিলন-মোহনায়। ভৌগোলিক দিক থেকে তাঁরা সবাই মৃত অথবা নিষ্ক্রিয় বদ্বীপের বাসিন্দা। পূর্ব বাংলার মানুষ প্রাকৃতিক দানে পেয়ে গেছে পলি মাটি, স্রোতোস্বিনী নদী। পূর্ববঙ্গের গল্প-আখ্যানে তাই স্থান পেয়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংস্কৃতি এবং ভূমি-বন্দোবস্তের বৃত্তান্ত।
অদ্বৈতমল্লবর্মণ যখন তিতাস নদীর গল্প সাজান, তখন সেই গল্পের খাতে প্রবেশ করে নদীবাহিত জীবনের ভাঙাগড়ার ইতিহাস। ওই অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা লোকাচার, বিশ্বাস ও কৃত্যের সমাবেশ ঘটান তিনি। অদ্বৈতের হাতে নদী হয়ে উঠেছে জীবন্ত সত্তা। নদীর সঙ্গে নদীর তুলনায় তিনি লেখেন, ‘কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে–উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।’
আবু ইসহাক আমাদের নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’-এ। সেখানেও আছে বসতি-স্থাপন ও বসতি-লুপ্তির আখ্যান। উপন্যাসের বিবরণে তিনি লিখেছেন, ‘চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাঁই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, 'চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।’
এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে চরদখলের গল্প। ঢুকে পড়েছে থানা-পুলিশ, মামলা, আদালত। খোলা বইয়ের মতো উঠে আসে বদ্বীপের ঔপনিবেশিক পটভূমি। আবু ইসহাক যেমন লিখেছেন, ‘খুনাখুনির পরই চরটাকে ক্রোক করে সামায়িকভাবে সরকারি দখলে রাখার হুকুম দিয়েছিল আদালত। ভবিষ্যতে যাতে আবার শান্তিভঙ্গ না হয় জন্যই থানার পুলিস এ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছিল। পরে যে মামলায় জিতবে, সে-ই হবে চরের মালিক।’ বয়াতির গলায় গান হয়ে মূর্ত হয় আইন-শাসন ও চরকেন্দ্রিক জীবন, ‘লাঠির জোরে মাটিরে ভাই/ লাঠির জোরে মাটি,/ লাঠালাঠি কাটাকাটি,/ আদালতে হাঁটাহাঁটি,/ এই না হলে চরের মাটি/ হয় কবে খাঁটি… রে।’
এই বদ্বীপের স্থানিকতা ও আঞ্চলিকতাকে যিনি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণ করতে চেয়েছেন তিনি শামসুদ্দীন আবুল কালাম। সুন্দরবন ও দক্ষিণবঙ্গের ভূপ্রকৃতির প্রেক্ষাপটে তিনি বিন্যস্ত করেছেন তাঁর আখ্যান। যেমন ‘জায়জঙ্গল’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘নানা রকম বিরাটাকার বৃক্ষ, ঘন-ঘন বাঁশ-ঝাঁড়, অজস্র লতা ও গুল্ম, দশ-বারো হাত লম্ব হোগলাম হোগলা, গোলপাতা, নলখাগড়া, কাশ ও শণবন আশ্চর্য রকম জীবনীশক্তি লইয়া স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্যে অরণ্যকে এক মহামহিম রূপ দিয়াছে। নিচে লতা-পাতার নরম এবং জলজ আস্তরণ ফুঁড়িয়া-ওঠার তীক্ষ্ন শীর্ষ অগণন উদ্ভিদ-অঙ্কুরের জন্য পা ফেলিবার ঠাঁই পাওয়াও অসম্ভব মনে হয়; ওপর আর্দ্র ও উষ্ণ বাতাস এবং ঘন ডালপালা ও পত্রাদির অন্তরালে প্রখর সূর্য একরকম ঢাকা পড়িয়াই থাকে;… এই পরিবেশে কেবল অজস্ররকম প্রাণিকুলই। প্রাগৈতিহাসিককাল হইতে তাহাদের বসতি করিয়া চলিয়াছে। প্রায় দৃষ্টিরও অগোচর সূত্রাকৃতি জোঁক হইতে আরম্ভ করিয়া বিরাটাকার বাঘ, কুমির এবং অজগরের আপন রাজত্ব এইখানে এখনও অব্যাহত।’
শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর ‘সমুদ্রবাসর’ উপন্যাসের সূচনা ঘটিয়েছেন একইভাবে, ‘সমুদ্রকূলবর্তী সেই সমতল ভূমি ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। নানা ধরনের শ্বাপদসঙ্কুল হইলেও লোকালয়গুলি আরও গভীরে। কোন উপকূলবর্তী বালুভরা তটভূমিক পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া ঘন তালতমাল নারিকেল সুপারি বনের প্রহরীর কাছে থাকিয়া গিয়াছে। সম্মুখে বিশাল সমুদ্র ক্রমাগত রুখিয়া ফুঁসিয়া ওঠা জীবজগৎকে বক্ষে লইয়া কখনও শান্ত, কখনও উন্মত্ত হইয়া প্রায় লোকালয় পর্যন্ত ধাওয়া করিয়া আসেই। সেই কারণেই কাছাকাছি লোকালয় বসতিও নাই।’
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গীয় বদ্বীপকে কেন্দ্র করে শামসুদ্দীন আবুল কামাল রচনা করছেন এক ধরনের ‘ফিকশনাল হিস্টি’; চরিত্রগুলো ওই ইতিহাসের ভাবধারার ফসল। আঞ্চলিক উপন্যাসের বিষয়বিন্যাসে এই প্রবণতা থাকে। রাঢ়বঙ্গকে এভাবেই উপন্যাসের পাতায় তুলে এনেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাবনা জাগে, বাংলাদেশের ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’র যৌথতাকে সাহিত্যে কীভাবে ধারণ করা হলো, তার একটি নিবিড় পাঠ দরকার।
দেবেশ রায় একবার আক্ষেপের সুরে লিখেছিলেন, ‘সারা পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই বাংলার ওপর দিয়েই বয়ে যায় রহস্যময় এক সামুদ্রিক বাতাস যার নাম মৌসুমী বায়ু। অথচ আমাদের উপন্যাসে সে বিবরণ লেখা হলো না কোন খাত দিয়ে কী বাতাসে আমাদের গাছপালা দোলে। আর এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনী নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না।’
দেবেশ রায়ের আক্ষেপে কার্যকারণহীন নয়। সত্যিই তো, এই অঞ্চলের মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ, বৃষ্টির ধারা, জল ও কাদার গড়ন সাহিত্যে তেমন কোনো ব্যাপ্তি নিয়ে আসে নি। আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বাইরের উপকরণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিলেখকদের মধ্যে কাজ করেছে ‘প্রকৃতিকে জয় করে সভ্য ও সংস্কৃত’ হওয়ার ধারণা। বদ্বীপের বাস্তুতান্ত্রিক ইতিহাস তাই রয়ে গেছে অলক্ষ্যে। দিন যত এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের দিকে ততই একাকার হয়ে গেছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন। বদ্বীপ প্রবেশ করেছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন-উত্তর ইতিহাসে। অর্থাৎ বদ্বীপের লেখকদের সামনে তৈরি হয়েছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট।
সমস্যা হলো, কেবলই সৌন্দর্যের চশমা দিয়ে একে আর পাঠ করা যায় না। ইকোলজি ও ইকোসিস্টেমের ইতিহাসে বদ্বীপের মানুষ ও তার সাংস্কৃতিক রাজনীতিকেও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই বদ্বীপের সৌন্দর্যমুখী ভাষ্য উৎপাদন করা হলেও ইতিহাস ও ভূগোল-আশ্রিত বয়ান নির্মাণ করা হয় না।
সত্যিকার অর্থে, বঙ্গীয় বদ্বীপের ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’র সম্পর্ককে ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক কল্পনার মেলবন্ধনে খুব কম লেখকই পাঠ করেছেন। অথচ, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই বাংলাদেশের বদ্বীপীয় বিশেষত্ব স্বতন্ত্র সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেশন দাবি করে।
কিন্তু কে লিখবে? বঙ্কিমচন্দ্র থাকলে হয়তো বলতেন, তুমি লিখিবে, আমি লিখিব।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদেরই লিখতে হবে।
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলা দেশ’–কী দারুণ এক কল্পনা; উত্তরে আকাশসমান হিমালয়, দক্ষিণে চোখের সম্পূর্ণ সীমানায় ধরা পড়ে আদিগন্ত সমুদ্র; দুই বিশালতার ঠিক মাঝখানে বাংলাদেশ। কবির কল্পনা আর ঐতিহাসিকের চোখে এইটুকুই ‘বঙ্গীয় বদ্বীপ’।
ভাবতে ভালো লাগে, এক আকস্মিক প্রাকৃতিক ঘটনায় জেগে উঠেছে হিমালয়; আর তার গা বেয়ে নেমে এসেছে শত-সহস্র নদী। বরফগলা সেই সব নদী ছুটে গেছে অগণিত ধারায়। তারপর জঙ্গল কেটে সাফসুতরো করে মানববসতি হলো। আধুনিক ইতিহাসের বিচারে ‘প্রকৃতি’র সঙ্গে দেখা হলো ‘সংস্কৃতি’র।
দাগ, নকশা আর কাঁটাতারঘেরা মানচিত্র সেখানে নেই। আছে শুধু অবিরল জলের প্রবাহ, মৌসুমি বাতাস, বৃষ্টি, পলিমাটির গন্ধ; আছে জঙ্গল, ঘাস, লতাগুল্ম, আকাশ ছুঁইছুঁই সবুজ গাছেদের সারি। এই বদ্বীপে নদী ভাঙে, নদী গড়ে; প্রবহমান স্রোত বয়ে আনে পলি, পলি জমে জমে গড়ে ওঠে ভূমি; ভূমিতে বসতি হয়, আবার ভেঙে যায়। ভারতীয় চিন্তা-ঐতিহ্যের পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, এ এক ‘ভবচক্র’–বাংলা অঞ্চলের মানুষের জন্য চিরায়ত এক প্রাকৃতিক সত্য।
প্রশ্ন হলো, বিপুলায়তন বাংলা সাহিত্য এই বদ্বীপের ভাব ও তৎপরতাকে কি ধরতে পেরেছে? সাহিত্যে কীভাবে আছে তার চিহ্ন? বদ্বীপ বলতে কি আমরা বাংলাদেশের সমুদয় ভূখণ্ডকে বুঝব? নাকি বিশেষভাবে বুঝব এ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকে, যেখানে নদীগুলো মিশে গেছে সমুদ্রে, মিঠা পানি মিতালি পাতিয়েছে নুনের দরিয়ায়। ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদের ভাষ্যে ‘বদ্বীপে’র নিখুঁত সংজ্ঞার্থ আমরা পাব। কিন্তু আপাতত দেখতে চাই সাহিত্যের সেই সীমা-সরহদ্দ, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ ও জনপদকে চিহ্নিত করা যায় বদ্বীপের প্রাকৃতিক ও আঞ্চলিক বিশিষ্টতায়।
এই সূত্রে বলতে হয়, বিদ্যমান প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে যে সমাজ আর সংস্কৃতিই গড়ে উঠুক না কেন তাকে বহন করতে হয় প্রকৃতি ও প্রতিবেশের চিহ্ন। এ কারণে বদ্বীপ অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিককে বলতে হয় নদী, পলিমাটি, চর, জল, ঝড় ও জঙ্গলের গল্প। একজন কবিকে হয়তো ধারণ করতে হয় হাজার পাখির কলধ্বনি। তাকে আঁকতে হয় ঝিঁঝিডাকা সন্ধ্যার নির্জনতাকে।
কিন্তু বদ্বীপের সাহিত্যমাত্রই কি দ্বীপভূমির প্রতিনিধিত্ব করে? তা কিন্তু নয়। কেননা অনেকের কাছে বদ্বীপের পটভূমি লেখালেখির ব্যক্তিক অনুষঙ্গমাত্র। মূলত আমরা এক বিশেষ সাহিত্যধারার কথা ভাবছি–যে সাহিত্যে বঙ্গীয় বদ্বীপের জল, মাটি, আবহাওয়া, প্রাণী, উদ্ভিদ আর মানুষের চলিষ্ণুতাকে ধারণ করেছে, বিশদ বিবরণে হাজির করেছে ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্যপট।
দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহমাখা সাহিত্য রচিত হলেও ‘লোকাল কালার’ বা আঞ্চলিক বর্ণগন্ধসমেত বঙ্গীয় বদ্বীপকেন্দ্রিক শক্তিশালী কোনো সাহিত্যধারা বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি; বলা ভালো, আমার এই মন্তব্য বিশেষভাবে আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একই সঙ্গে উল্লেখ্য যে মৌখিক সাহিত্যধারা ঐতিহ্যগতভাবেই অঞ্চল ও প্রকৃতির বিশেষ অনুগামী। এ কারণে লোকায়ত সাহিত্যে উঠে আসে বদ্বীপ অঞ্চলের জলজ জীবন ও অভিজ্ঞতার বয়ান।
যে সাহিত্য বদ্বীপ অঞ্চলের বিশিষ্টতাকে স্বতন্ত্রভাবে বুঝতে চাইবে তাকে অবশ্যই আঞ্চলিক ভূমিগঠন, বসতিস্থাপন, প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট, জলবায়ুর সঙ্গে মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে বুঝতে হবে। ভাবতে হবে, সাহিত্যে এসব উপস্থাপনের বিশিষ্ট ভঙ্গিমার কথাও। দেখতে পাই, বাংলাদেশের সাহিত্যে বদ্বীপীয় মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সম্পর্ককে খুব কম লেখকই বুঝতে চেয়েছেন।
যাঁরা খুব মনোযোগের সঙ্গে এ ভূমিকে লক্ষ করেছেন, তাঁদের লেখায় এসে পড়েছে বাংলার নদীর গল্প। সত্যিকার অর্থে, নদীকথা ছাড়া বদ্বীপের ইতিহাস হয় না। শত শত নদী মরে গেলেও বাংলাদেশের কথা বলতে গেলেই আগেভাগে উঠে আসে নদীর কথকতা। স্মৃতি আমাদের উসকানি দেয়–সেই কবে কত শত নদীর স্রোতে ভেঙেগড়ে তৈরি হয়েছে এই বঙ্গভূমি। মনসার ভাসান, গীতিকার পালায় সতত প্রবহমান নদী।
কে না জানে, এ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ নদীকে করেছে জীবনের সহচর। অথবা এদেশের মানুষ চিরকাল পলিমাটি আর জলের সহোদর। নদী মানে ঢেউ, স্রোত, ভাঙন। আর এদেশের মানুষের জীবন যেন তা-ই। বদ্বীপ অঞ্চলের সাহিত্যে তাই নদী আসে নানা মাত্রায়। এ অঞ্চলেই প্রবাদ হিসেবে তৈরি হয়েছে ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’।
এই বদ্বীপে আমরাই এক বেহুলাকে কল্পনা করেছি, মৃত স্বামীর শবদেহ নিয়ে যে ভেসে চলেছে গাঙুরের জলে। পেরিয়ে গেছে ঘাটের পর ঘাট। `পদ্মাপুরাণ’ কাব্যে বিজয় গুপ্ত এঁকেছেন সেই নদীবাহিত পথরেখা, জলজ জীবনের ছবি। দক্ষিণবঙ্গের এই জীবনচক্র নন্দনতাত্ত্বিক অভিনবত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য়। আধুনিকতাবাদী কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম দক্ষিণবঙ্গের প্রাণ ও প্রকৃতিকে দিয়েছেন চিরায়ত আসন। সৌন্দর্যের আধার হিসেবে তাঁর ‘রূপসী বাংলা’য় উঠে এল বঙ্গীয় বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন উপাদান–বৃক্ষ, লতাপাতা, পতঙ্গের নাম।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও প্রবলভাবে লেগেছিল এ অঞ্চলের হাওয়া। পূর্ববঙ্গে এসে ঘর থেকে মাত্র দুই পা ফেলেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন পদ্মার মতো প্রমত্তা নদী। আসলে পেয়েছিলেন ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় এক বদ্বীপভূমি; ভূগোলের ভাষা অন্তত তা-ই বলে। পদ্মা তখনও খরস্রোতা। কুষ্টিয়া, শিলাইদহ, সাজাদপুরে পদ্মার ঢেউ আঘাত হানে দুই পারের দুই তটভূমিতে। পূর্ববঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছে তার অবয়ব।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পদ্মা স্বয়ং এক চরিত্র। গম্ভীর-খরস্রোতা পদ্মা রবীন্দ্রজীবনে বইয়ে দিল সৃষ্টির বন্যা। পদ্মাবিধৌত বঙ্গের প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে চিনলেন তিনি। মহাবৈশ্বিক এক দার্শনিকতার আবরণে তিনি আঁকলেন তার ছবি। কিন্তু সৌন্দর্যের এই বয়ানের আড়ালে চাপা পড়ে ছিল অন্য কিছু; ভূসংস্থান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরে সেখানে আছে সামন্তবাদী শোষণের গল্প; চরদখলের আখ্যানে ভেতর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্প। পূর্ব বাংলার কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন সংগ্রামের দেখা পাব জসীম উদ্দীনের সাহিত্যে। ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট ’–এই দুই কাব্যকে অনায়াসে বলা চলে বঙ্গীয় বদ্বীপের এক কালচারাল টেক্সট বা সাংস্কৃতিক রচনা।
ইতিহাসের পরিকাঠামো দিয়ে মাপলে বোঝা যায়, জসীমউদ্দীন বদ্বীপের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। আর তাই দেখিয়েছেন সহাবস্থানের সামাজিক সত্তাকে ধ্বংস করতে চায় সামন্তবাদী ক্ষমতার সম্পর্ক। `সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘ কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে বহু চাষী মুসলমান ও নমশূদ্রের বাস। তাহাদের মাঝে সামান্য সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়।’ জসীম উদদীনের ভাষ্যে, ছোটখাটো বিবাদগুলোকে বড় করে তুলত বিত্তবান হিন্দু-মুসলমানেরা। তিনি সেটিকে বলেছেন, ‘সর্বনাশের পথে আগাইয়া’ দেওয়া। কৃষিনির্ভর জনপদের অভিজ্ঞতা থেকে জসীম উদ্দীন জানাচ্ছেন, ‘মহাজন ও জমীদারের মধ্যে কোন জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা পৃথিবীতে সকলেই এক জাতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগা নমশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয় তাহা চক্ষে দেখিলে অশ্রুসম্বরণ করা যায় না।’ আর এই বাস্তবতার দেখা মিলবে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ।
কিন্তু বঙ্গীয় বদ্বীপের আখ্যান তো আরও দীর্ঘ–তার শরীরে জড়িয়ে থাকা নদীর মতোই তা বিসর্পিল। এই গল্প দীর্ঘায়িত পরিসরে উঠে এসেছে বেশ কিছু উপন্যাসে–যে গল্পের রেখাচিত্র নেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রদের আখ্যানে। কেননা তাঁরা বসত গাঁড়েননি নদীর শেষ প্রান্তে কিংবা নদী ও সমুদ্রের মিলন-মোহনায়। ভৌগোলিক দিক থেকে তাঁরা সবাই মৃত অথবা নিষ্ক্রিয় বদ্বীপের বাসিন্দা। পূর্ব বাংলার মানুষ প্রাকৃতিক দানে পেয়ে গেছে পলি মাটি, স্রোতোস্বিনী নদী। পূর্ববঙ্গের গল্প-আখ্যানে তাই স্থান পেয়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংস্কৃতি এবং ভূমি-বন্দোবস্তের বৃত্তান্ত।
অদ্বৈতমল্লবর্মণ যখন তিতাস নদীর গল্প সাজান, তখন সেই গল্পের খাতে প্রবেশ করে নদীবাহিত জীবনের ভাঙাগড়ার ইতিহাস। ওই অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা লোকাচার, বিশ্বাস ও কৃত্যের সমাবেশ ঘটান তিনি। অদ্বৈতের হাতে নদী হয়ে উঠেছে জীবন্ত সত্তা। নদীর সঙ্গে নদীর তুলনায় তিনি লেখেন, ‘কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে–উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।’
আবু ইসহাক আমাদের নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’-এ। সেখানেও আছে বসতি-স্থাপন ও বসতি-লুপ্তির আখ্যান। উপন্যাসের বিবরণে তিনি লিখেছেন, ‘চরের বসত আজ আছে, কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তারই খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাঁই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙেচুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনো দিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন। ফজলের বাবা এরফান মাতব্বর প্রায়ই একটা কথা বলে থাকে, 'চরের বাড়ি মাটির হাঁড়ি, আয়ু তার দিন চারি।’
এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে চরদখলের গল্প। ঢুকে পড়েছে থানা-পুলিশ, মামলা, আদালত। খোলা বইয়ের মতো উঠে আসে বদ্বীপের ঔপনিবেশিক পটভূমি। আবু ইসহাক যেমন লিখেছেন, ‘খুনাখুনির পরই চরটাকে ক্রোক করে সামায়িকভাবে সরকারি দখলে রাখার হুকুম দিয়েছিল আদালত। ভবিষ্যতে যাতে আবার শান্তিভঙ্গ না হয় জন্যই থানার পুলিস এ ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করেছিল। পরে যে মামলায় জিতবে, সে-ই হবে চরের মালিক।’ বয়াতির গলায় গান হয়ে মূর্ত হয় আইন-শাসন ও চরকেন্দ্রিক জীবন, ‘লাঠির জোরে মাটিরে ভাই/ লাঠির জোরে মাটি,/ লাঠালাঠি কাটাকাটি,/ আদালতে হাঁটাহাঁটি,/ এই না হলে চরের মাটি/ হয় কবে খাঁটি… রে।’
এই বদ্বীপের স্থানিকতা ও আঞ্চলিকতাকে যিনি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণ করতে চেয়েছেন তিনি শামসুদ্দীন আবুল কালাম। সুন্দরবন ও দক্ষিণবঙ্গের ভূপ্রকৃতির প্রেক্ষাপটে তিনি বিন্যস্ত করেছেন তাঁর আখ্যান। যেমন ‘জায়জঙ্গল’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘নানা রকম বিরাটাকার বৃক্ষ, ঘন-ঘন বাঁশ-ঝাঁড়, অজস্র লতা ও গুল্ম, দশ-বারো হাত লম্ব হোগলাম হোগলা, গোলপাতা, নলখাগড়া, কাশ ও শণবন আশ্চর্য রকম জীবনীশক্তি লইয়া স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্যে অরণ্যকে এক মহামহিম রূপ দিয়াছে। নিচে লতা-পাতার নরম এবং জলজ আস্তরণ ফুঁড়িয়া-ওঠার তীক্ষ্ন শীর্ষ অগণন উদ্ভিদ-অঙ্কুরের জন্য পা ফেলিবার ঠাঁই পাওয়াও অসম্ভব মনে হয়; ওপর আর্দ্র ও উষ্ণ বাতাস এবং ঘন ডালপালা ও পত্রাদির অন্তরালে প্রখর সূর্য একরকম ঢাকা পড়িয়াই থাকে;… এই পরিবেশে কেবল অজস্ররকম প্রাণিকুলই। প্রাগৈতিহাসিককাল হইতে তাহাদের বসতি করিয়া চলিয়াছে। প্রায় দৃষ্টিরও অগোচর সূত্রাকৃতি জোঁক হইতে আরম্ভ করিয়া বিরাটাকার বাঘ, কুমির এবং অজগরের আপন রাজত্ব এইখানে এখনও অব্যাহত।’
শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর ‘সমুদ্রবাসর’ উপন্যাসের সূচনা ঘটিয়েছেন একইভাবে, ‘সমুদ্রকূলবর্তী সেই সমতল ভূমি ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। নানা ধরনের শ্বাপদসঙ্কুল হইলেও লোকালয়গুলি আরও গভীরে। কোন উপকূলবর্তী বালুভরা তটভূমিক পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া ঘন তালতমাল নারিকেল সুপারি বনের প্রহরীর কাছে থাকিয়া গিয়াছে। সম্মুখে বিশাল সমুদ্র ক্রমাগত রুখিয়া ফুঁসিয়া ওঠা জীবজগৎকে বক্ষে লইয়া কখনও শান্ত, কখনও উন্মত্ত হইয়া প্রায় লোকালয় পর্যন্ত ধাওয়া করিয়া আসেই। সেই কারণেই কাছাকাছি লোকালয় বসতিও নাই।’
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গীয় বদ্বীপকে কেন্দ্র করে শামসুদ্দীন আবুল কামাল রচনা করছেন এক ধরনের ‘ফিকশনাল হিস্টি’; চরিত্রগুলো ওই ইতিহাসের ভাবধারার ফসল। আঞ্চলিক উপন্যাসের বিষয়বিন্যাসে এই প্রবণতা থাকে। রাঢ়বঙ্গকে এভাবেই উপন্যাসের পাতায় তুলে এনেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাবনা জাগে, বাংলাদেশের ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’র যৌথতাকে সাহিত্যে কীভাবে ধারণ করা হলো, তার একটি নিবিড় পাঠ দরকার।
দেবেশ রায় একবার আক্ষেপের সুরে লিখেছিলেন, ‘সারা পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই বাংলার ওপর দিয়েই বয়ে যায় রহস্যময় এক সামুদ্রিক বাতাস যার নাম মৌসুমী বায়ু। অথচ আমাদের উপন্যাসে সে বিবরণ লেখা হলো না কোন খাত দিয়ে কী বাতাসে আমাদের গাছপালা দোলে। আর এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনী নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না।’
দেবেশ রায়ের আক্ষেপে কার্যকারণহীন নয়। সত্যিই তো, এই অঞ্চলের মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ, বৃষ্টির ধারা, জল ও কাদার গড়ন সাহিত্যে তেমন কোনো ব্যাপ্তি নিয়ে আসে নি। আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বাইরের উপকরণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিলেখকদের মধ্যে কাজ করেছে ‘প্রকৃতিকে জয় করে সভ্য ও সংস্কৃত’ হওয়ার ধারণা। বদ্বীপের বাস্তুতান্ত্রিক ইতিহাস তাই রয়ে গেছে অলক্ষ্যে। দিন যত এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতের দিকে ততই একাকার হয়ে গেছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন। বদ্বীপ প্রবেশ করেছে উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন-উত্তর ইতিহাসে। অর্থাৎ বদ্বীপের লেখকদের সামনে তৈরি হয়েছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট।
সমস্যা হলো, কেবলই সৌন্দর্যের চশমা দিয়ে একে আর পাঠ করা যায় না। ইকোলজি ও ইকোসিস্টেমের ইতিহাসে বদ্বীপের মানুষ ও তার সাংস্কৃতিক রাজনীতিকেও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই বদ্বীপের সৌন্দর্যমুখী ভাষ্য উৎপাদন করা হলেও ইতিহাস ও ভূগোল-আশ্রিত বয়ান নির্মাণ করা হয় না।
সত্যিকার অর্থে, বঙ্গীয় বদ্বীপের ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’র সম্পর্ককে ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক কল্পনার মেলবন্ধনে খুব কম লেখকই পাঠ করেছেন। অথচ, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই বাংলাদেশের বদ্বীপীয় বিশেষত্ব স্বতন্ত্র সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেশন দাবি করে।
কিন্তু কে লিখবে? বঙ্কিমচন্দ্র থাকলে হয়তো বলতেন, তুমি লিখিবে, আমি লিখিব।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদেরই লিখতে হবে।
একটি জাতির জন্ম হয় গভীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে। আবার একটি জাতির ইতিহাস তার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়েরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাতির টিকে থাকা নির্ভর করে জাতীয় পরিচয় ও ঐক্যের শক্তির উপর।
১ ঘণ্টা আগেবঙ্গীয় বদ্বীপের সমাজ, রাজনীতি ও মতাদর্শ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে আমরা ফিরে তাকিয়েছি বাংলাদেশের গত দুই হাজার বছরের পথপরিক্রমায়। জানার চেষ্টা করেছি, কীভাবে গড়ে উঠেছে এ জনপদের সমাজ, রাজনীতি ও মতাদর্শ। এই লেখায় গবেষক ও লেখক তারিক ওমর আলির বই ‘আ লোকাল হিস্ট্রি অব গ্লোব
২ ঘণ্টা আগেসুন্দরবন এলাকায় লক্ষাধিক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ড্যানিয়েল হ্যামিলটন গড়ে তুলেছিলেন নিজের এস্টেট। হ্যামিলটন তাঁর ‘কল্পরাজ্যে’ বিজ্ঞানসম্মত কৃষি ও সমবায়ের সূচনা করেছিলেন। কেমন ছিল হ্যামিলটনের সেই এস্টেট?
৮ ঘণ্টা আগেপূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে, পুরো বদ্বীপের মানুষের মধ্যে কিছু জায়গায় ঐক্য রয়েছে–জীবনযাপন ও রাজনীতিতে। আবার কিছু ভিন্নতাও রয়েছে। যেমন, পশ্চিম বাংলার ভূমি যেখানে একটু অনুর্বর হয়েছে, সেখানে মানুষকে কৃষি বা অন্য পেশা বেছে নিতে হয়েছে।
১ দিন আগে