leadT1ad

পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডায় আল-বদর: যুদ্ধাপরাধের আত্মস্বীকৃত দলিল

‘আল বদর’ বইয়ের প্রচ্ছদ। স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রাক্কালে, যখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত, ঠিক সেই অন্তিম লগ্নে আল-বদর বাহিনীর নেতারা তাদের চূড়ান্ত বার্তা বা ‘আখেরি খিতাব’ দেন। এই বার্তাটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক এক ঘোষণা। পাকিস্তানি জামায়াতে ইসলামীর তরুণ সদস্য সেলিম মনসুর খালেদের লেখা বইয়ে আল-বদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সেই বিস্ফোরক ‘আখেরি খিতাবের’ কথা উল্লেখ আছে।

মুজাহিদ চরম দম্ভের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে, তারা তাদের ‘কাজের জন্য লজ্জিত নন’, বরং গর্বিত। তিনি আল-বদর সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘আজরাইল’ বা ‘মৃত্যুর দূত’ হিসেবে ঘোষণা করছেন। এই ঘোষণা এটাই প্রমাণ করে যে, আল-বদর বাহিনী কোনো সাধারণ সহযোগী দল ছিল না। তারা ছিল বাঙালি নিধনে বদ্ধপরিকর একটি সামরিক ইউনিট। এই একটি বক্তৃতাই বলে দেয়, ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা হঠকারিতা ছিল না। এটি ছিল সদ্য স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করার এক ঠান্ডা মাথার ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

প্রশংসার আড়ালে সত্য প্রকাশ: ‘আল-বদর’ বইয়ের পটভূমি

১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের লাহোর থেকে ‘আল-বদর’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এর লেখক ছিলেন সেলিম মনসুর খালেদ। তিনি নিজে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। এই বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিতর্কিত আল-বদর বাহিনীকে ‘পাকিস্তানের রক্ষক’ বা ‘বীর’ হিসেবে মহিমান্বিত করে ইতিহাসে অমর করে রাখা।

কিন্তু লেখকের এই প্রোপাগান্ডা চেষ্টা বুমেরাং হয়। প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি নিজের অজান্তেই আল-বদরদের যুদ্ধাপরাধের বিস্তারিত দালিলিক প্রমাণ দিয়ে ফেলেছেন। তিনি আল-বদরদের নৃশংস কাজগুলোকে ‘দেশপ্রেম’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফলস্বরূপ বইটি আজ তাদের অপরাধের অন্যতম শক্তিশালী ‘আত্মস্বীকৃত সাক্ষী’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’ এবং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান

বইটিতে লেখক গর্বের সঙ্গে লিখেছেন, আল-বদর ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর ‘অ্যাকশন সেকশন’। এই বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়েছিল ‘ইসলামি জামিয়াতে তালাবা’ বা জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে। তাদের ঘোষিত কাজ ছিল তথাকথিত ‘ভারতীয় এজেন্ট’ বা মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক বাঙালিদের হাত থেকে ‘অখণ্ড পাকিস্তান’কে রক্ষা করা।

এখানেই লেখক সবচেয়ে বড় সত্যটি ফাঁস করেছেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরাসরি আল-বদরদের তত্ত্বাবধান করত এবং তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করত। এই তথ্য নিশ্চিত করে যে, আল-বদর একটি স্বাধীন বা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী ছিল না; তারা ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরিকল্পিত ডেথ স্কোয়াড, যারা সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যুদ্ধাপরাধ করত।

টর্চার সেল যখন ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’

বইটিতে ১৯৭১ সালের কুখ্যাত মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ ক্যাম্পের প্রসঙ্গ এসেছে। এই স্থানটি ছিল আল-বদরদের হেডকোয়ার্টার। এই কলেজটি ছিল অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার এক ভয়াল টর্চার সেল।

অথচ লেখক এই ক্যাম্পটিকে ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ বলে প্রশংসা করেছেন। এই আপাত নিরীহ শব্দবন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমেও তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আল-বদররা কেবল মৌখিক বা রাজনৈতিক সমর্থন দেয়নি। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এবং সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। এই প্রশিক্ষণের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চিহ্নিত করা, অপহরণ করা এবং নির্মূল করা।

গণহত্যার নাম ‘জিহাদ’: হামুদুর রহমান কমিশনের সাক্ষ্য

সেলিম মনসুর খালেদ বুদ্ধিজীবী হত্যা ও সাধারণ গণহত্যাকে ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জিহাদ’ বলে সাফাই গাইতে চেয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের হত্যা করাকে আল-বদরদের ‘সাহসিকতা’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

বইটিতে নিহত আল-বদর সদস্যদের ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে তাদের জীবনবৃত্তান্ত লেখা হয়েছে। এই জীবনীগুলিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, তারা গ্রামগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর হামলা চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে। এই বর্ণনা সরাসরি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখিত পাকিস্তানি ও সহযোগী বাহিনীর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

ঘাতকদের আত্মস্বীকৃতির দলিল

লেখক হয়তো চেয়েছিলেন আল-বদরদের মহিমান্বিত করে তাদের কৃতকর্মকে জায়েজ করতে। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে, ‘আল-বদর’ বইটি এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের মুখোশ উন্মোচনের শক্তিশালী হাতিয়ার। বইটিতে কোনো রাখঢাক করা হয়নি। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আল-বদররা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘ডেথ স্কোয়াড’। তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল এই জনুগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ডকে সমূলে উৎপাটন করা।

তাই, ‘আল-বদর’ বইটি কেবল একটি পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা নয়। এটি ১৯৭১ সালের অপরাধের এক ‘আত্মস্বীকৃত দলিল’।

Ad 300x250

সম্পর্কিত