leadT1ad

নিয়াজির কলমে রাজাকারদের ‘বীরত্ব’

স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৯৮ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ২৭ বছর পর, পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করলেন লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার। তাঁর লেখা বইটির নাম ছিল—‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’।

এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম দিয়েছিল নতুন বিতর্কের। প্রথমত, বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যায় যে এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে এখানে কোন অনুতাপ নেই। এটা কেবলই পূর্ব পাকিস্তানের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র বয়ান।

বইটির শুরুতেই থাকা একটি তথ্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চলমান সব আলোচনা ও বিতর্ককে এক নিমিষেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কারণ, এই পাকিস্তানি জেনারেল কোনো রাখঢাক না রেখেই তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্রে সগৌরবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন সেই কুখ্যাত ও বিতর্কিত রাজাকার বাহিনীর প্রতি।

নিয়াজির কলমে রাজাকারদের ‘উৎসর্গ’

নিয়াজি এই উৎসর্গপত্রে কী লিখেছিলেন? এটি ছিল রাজাকার বাহিনীর অবস্থান এবং লক্ষ্যকে স্পষ্ট করে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক স্বীকারোক্তি। তিনি লিখেছেন:

‘বইটি উৎসর্গ করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, রাজাকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুজাহিদদের অকুতোভয় সদস্যদের প্রতি।’

কেন এই উৎসর্গ? নিয়াজির নিজের ভাষায়, এই বাহিনীগুলো সেই সব মানুষ:

‘যারা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে কঠোর সংগ্রাম করেছেন, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং অপমান সয়েছেন।’

রাজাকার ‘পাকিস্তানের বিশ্বস্ত সৈনিক’

এই একটি বাক্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি জটিল প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যায়। নিয়াজি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে স্বীকার করে নিলেন যে, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তির জন্য নয়, বরং তারা লড়েছিল অখণ্ড পাকিস্তানের স্বার্থে। তাদের মূল এবং একমাত্র লক্ষ্য ছিল—‘পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখা’। এর অর্থ দাঁড়ায়, তারা সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল।

এই উৎসর্গপত্র প্রমাণ করে যে, রাজাকাররা কখনোই পরিস্থিতির শিকার হওয়া কোনো বিভ্রান্ত দল ছিল না। বরং তারা ছিল পাকিস্তানের আদর্শ ও সামরিক লক্ষ্যের প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনুগত, পাকিস্তানের বিশ্বস্ত সৈনিক। যারা নিজেদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, সেই কঠিন সত্যটি নিয়াজির মতো একজন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার কলমেই অকপটে উঠে এসেছে।

সেনাবাহিনীর ‘চোখ ও কান’ হিসেবে রাজাকার

বইয়ের ভেতরের আলোচনাতেও নিয়াজি রাজাকারদের ভূমিকা ও গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত প্রশংসা করেছেন। তিনি এই বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘চোখ ও কান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, সামরিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও স্থানীয় পর্যায়ে অপারেশনের ক্ষেত্রে এই বাহিনী ছিল পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান সহায়ক শক্তি।

নিয়াজি আরও গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, রাজাকাররা মূলত ছিল ডানপন্থী ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্য। এর থেকেই বোঝা যায়, তাদের অনুগত্য ছিল আদর্শগত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি দৃঢ়ভাবে বদ্ধপরিকর। তারা শুধু সাধারণ মানুষ ছিল না, বরং রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

বিশ্বাসঘাতকতার অকাট্য প্রমাণ

পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির এই সগৌরব প্রশংসা আসলে রাজাকার বাহিনীর জন্য বুমেরাং হয়েছে। তিনি তাদের ‘ত্যাগ’ ও ‘বীরত্ব’ দেখাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এই বাহিনী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষেই যুদ্ধ করেছিল। তারা কোনো জোর-জুলুমের শিকার হয়ে বা বাধ্য হয়ে নয়, বরং স্বেচ্ছায় ও আদর্শিকভাবে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।

একজন পাকিস্তানি জেনারেলের পক্ষ থেকে এই ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, রাজাকাররা কখনোই নিরপেক্ষ বা শান্তিরক্ষী বাহিনী ছিল না। তারা ছিল জন্মভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা এক শক্তি। তাদের সচেতন উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়া। নিয়াজির বইটি ইতিহাসের পাতায় এই বিশ্বাসঘাতকতার এক অকাট্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত