leadT1ad

আজ আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিন

একজন আইয়ুব বাচ্চু ও আমাদের স্মৃতিকাতরতার আখ্যান

আজ আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিন। ব্যান্ড সংগীতকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এক প্রজন্মের রুচি, সংগীতবোধ আর অ্যাটিটিউড তৈরি হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুদের হাত ধরে।

হাসনাত শোয়েব
হাসনাত শোয়েব
স্ট্রিম গ্রাফিক

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবরের সকালটা এতটাই জীবন্ত যে দিনটা বোধহয় কখনোই ভোলার নয়। সেদিনের সকালটা শুরু হয়েছিল খুবই অদ্ভুতভাবে। ঘুম ভাঙতেই কেমন যেন বিপন্ন লাগছিল। সকালের স্নিগ্ধতার মাঝেও কোথাও যেন একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ ফেসবুকে একজনের পোস্ট দেখলাম, আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। প্রথমে মনে হলো ভুয়া খবর। পরে কোনো একটা টিভি চ্যানেল খুলতেই চোখে পড়ল ব্রেকিং নিউজ, ‘জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন’।

একজন কিংবদন্তিকে এভাবে ‘জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীত শিল্পী’ডিসকোর্সে বেঁধে ফেলাটা কেন জানি মানতে পারছিলাম না। আইয়ুব বাচ্চু কোনো ‘যেন-তেন’ শিল্পী না। নব্বই দশককে শাসন করেছেন যে কজন ‘মায়েস্ত্রো’, আইয়ুব বাচ্চু তাঁদের একজন। এক প্রজন্মের রুচি, সংগীতবোধ আর অ্যাটিটিউড তৈরি হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুদের হাত ধরে।

আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম 'কষ্ট'। সংগৃহীত ছবি
আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম 'কষ্ট'। সংগৃহীত ছবি

এসব ভাবতে ভাবতেই মনটা কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে গেল। কত স্মৃতি, কত মুহূর্ত আমরা রক মিউজিককে উৎসর্গ করেছি। আর এই পথে যারা পাহাড়ের মতো অনুপ্রেরণা হয়ে ছিলেন, তাঁদের একজন আইয়ুব বাচ্চু, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘এবি’ নামেও অনেকের কাছে পরিচিত হন। একটা সময় ছিল, তাঁর কনসার্ট দেখার জন্য আমরা পাগলের অপেক্ষা করতাম। গিটার বাজানোর সময় তাঁর আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

সেই গল্প কবে শুরু হয়েছিল? মানুষের একটাই তো জীবন। ছোট্ট জীবন। সে জীবনে কেউ কাউকে প্রভাবিত করতে পারাটা সহজ কথা নয়। আইয়ুব বাচ্চুরা আমাদের প্রভাবিত করেছিল। তবে সত্যিই মনে করা কঠিন, প্রথম কবে আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনেছি। হয়তো তখন গান কী সেটা বুঝতেও শিখিনি, যখন থেকে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সঙ্গে পরিচয়। ভাগ্যিস আশপাশে কয়েকজন বড় ভাই পেয়েছিলাম। তাঁদের কাছ থেকে আমাদের মিউজিক্যাল বায়াত।

মনে পড়ে ফখরুল ভাইয়ের কথা। আমার এই মামাতো ভাই যখন গিটার নিয়ে প্রথম বাড়িতে আসেন, আমি জানালা দিয়ে তাঁর গিটার দেখতে গিয়েছিলাম। যেন রূপকথার কোনো গল্প শুনছি। লোডশেডিংয়ের সময় তাঁর কণ্ঠেই প্রথম ‘সেই তুমি/চলো বদলে যাই’ শোনা। এভাবে আমাদের অনেকেরই ছোটখাট লাইভ কনসার্টে হাতেখড়ি। এর আগে পর্যন্ত ছিল কেবল ক্যাসেটের ফিতা। প্রথমে মামার দুবাই থেকে পাঠানো একটি রেডিও। এরপর আমার এক বন্ধু একটা ওয়াকম্যান উপহার দিয়েছিল কোনো এক জন্মদিনে। তখন সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেই ওয়াকম্যানই যেন আমার জীবন বদলে দিল।

তবে সত্যিই মনে করা কঠিন, প্রথম কবে আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনেছি। হয়তো তখন গান কী সেটা বুঝতেও শিখিনি, যখন থেকে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সঙ্গে পরিচয়।

স্কুল থেকে ফিরে এসে গান, স্কুলে যাওয়ার আগে গান, ঘুম থেকে উঠে গান, ঘুমানোর আগে গান। কী শুনিনি তখন! আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া আমার পছন্দের গানের কথা ভাবছিলাম। আসলে অনেকগুলো গান সমান পছন্দের। তবে একটা সময় বুঁদ হয়েছিলাম, ‘এখন অনেক রাত’ আর ‘ভাঙা মন নিয়ে তুমি’ গানে। পরে ‘হাসতে দেখো, গাইতে দেখো,’ ‘মেয়ে’, ‘গতকাল রাতে’ কিংবা ‘রূপালি গিটার’সহ আরও বেশকিছু গান আমার অনেক ভালো লাগার।

আর একজন গিটারিস্ট হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর কথা বলার মতো যোগ্যতা কজনের আছে! গিটার বাজানোয় বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন এবি। তাঁকে দেখে গিটার হাতে তুলে নিয়েছে অসংখ্য তরুণ। সত্যি নাকি মিথ কখনো যাচাই করে দেখিনি, তবে তখন মফস্বলে শুনতাম খুব, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গিটারিস্ট নাকি আইয়ুব বাচ্চু। এসব আমরা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম।

সে সময় মাইকেল জ্যাকসনের অ্যালবাম পেয়েছিলাম মাসুদের কাছ থেকে। আর শাকিল ভাই, ফখরুল ভাইদের থেকে পেলাম বাচ্চু, জেমস, সোলস, রেনেসাঁ, দলছুট, ফিডব্যাক, ওয়ারফেজ আর অঞ্জন দত্তসহ অনেকের গান। আর কিছুদিন বাদে আমার কানে এল আর্টসেল, অর্থহীন, শিরোনামহীন, মেটালিকা, সিস্টেম অব ডাউন, বব ডিলান, বব মার্লে, কোহেন, গানস অ্যান্ড রোজেসের গান। তারপর কানে এল মেঘদল, ভাইব, মনোসরণিরা।

কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু। সংগৃহীত ছবি
কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু। সংগৃহীত ছবি

এসব কিছুর জন্য আমি আমার শৈশবের কাছে কৃতজ্ঞ। মফস্বলে বেড়ে ওঠার সুযোগ আমি কড়ায়-গন্ডায় কাজে লাগিয়েছিলাম। এরপর যুক্ত হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন। উন্মাতাল করা সেসব দিন। তীব্র গরমের মধ্যে ট্রেনের বগিতে গলা ফাটিয়ে একটার পর একটা গান করতে করতে ষোলোশহর থেকে ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস থেকে ষোলোশহর। এভাবেই গেছে পাঁচটা বছর।

আমি মিউজিশিয়ান হতে পারিনি। কিন্তু জার্নিটা তো মিথ্যা নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কোনো কিছু না বুঝেই ব্যান্ড গঠন করেছিলাম। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত মিউজিক নিয়ে চেষ্টাটা অব্যাহত ছিল। হতে হতেও হলো না, এ আক্ষেপ সব সময় থাকবে। তবু যাত্রাটা তো আর মিথ্যা নয়।

আমি কখনো লেখালেখি করব ভাবিনি। কিন্তু মিউজিক করব, রকস্টার হব সেটা সব সময় ভেবেছি। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে যায়, কে বা জানে! তবে এই অভিজ্ঞতা ছাড়া রকের ভাষা, চিৎকারের ভাষাটা কীভাবে উপলব্ধি করতাম। এই ভাষা যারা শিখিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু তাঁদের অন্যতম।

আমি মিউজিশিয়ান হতে পারিনি। কিন্তু জার্নিটা তো মিথ্যা নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কোনো কিছু না বুঝেই ব্যান্ড গঠন করেছিলাম। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত মিউজিক নিয়ে চেষ্টাটা অব্যাহত ছিল। হতে হতেও হলো না, এ আক্ষেপ সব সময় থাকবে। তবু যাত্রাটা তো আর মিথ্যা নয়।

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর কয়েকটা দিন সবকিছু এলোমেলো লাগছিল। স্মৃতিকাতরতায় বেশ কয়েকটা রাত নির্ঘুম কেটেছিল। বাচ্চুর মৃত্যুর রাতে কনসার্টে জেমসের কান্নার ভিডিও দেখে যে অসহায়ত্ব ভর করেছিল, তা যেন বারবার তাড়া করছিল। একজন কিংবদন্তির জন্য একজন কিংবদন্তির এভাবে স্টেজে দাঁড়িয়ে কান্না, অদ্ভুত এক দৃশ্য! আগে কখনোই দেখিনি। জেমসের এ কান্না বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আমাদের সোনালি সময়টা অতীত হয়ে গেছে। বহু দিন হলো নতুন একটা অ্যালবামের জন্য পাগলের মতো আর অপেক্ষা করি না।

‘সুরের ঝংকার’ দোকানে গিয়ে আর কখনো কাগজে গানের নাম লিখে দিয়ে আসা হবে না। ফিতার এক পিঠে জেমস, অন্য পিঠে আইয়ুব বাচ্চু। হ্যাঁ, এটা তো ঠিক যে নতুন গান তাঁরা আর দিতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা নিজেদের নাম বিশেষ একটা সময়ে খোদাই করে দিয়েছেন। যা আরও অনেক অনেক দিন থেকে যাবে। এসব গানের কাছে চুপ করে বসে থাকা যাবে আরও অনেক দিন। আমার সৌভাগ্য নব্বই এবং লেট নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে বড় হয়েছি। একটা পালাবদলের সাক্ষী হয়েছি। এ আনন্দটুকু অনবদ্য।

সেই আনন্দকে ফিরে পেতেই যেন এখনো হুটহাট আইয়ুব বাচ্চুর গানের কাছে ফিরে আসি। কোথাও তাঁর গান বাজতে শুরু করলে সব বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকি সেই গান। মনে পড়ে, আমাদের একজন রকের মায়েস্ত্রো ছিলেন। যিনি গিটার হাতে কনসার্ট মাতিয়ে তোলা একজন চিরস্থায়ী রকস্টার। বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে যিনি চিরন্তনও।

Ad 300x250

সম্পর্কিত