leadT1ad

স্ট্রিম এক্সপ্লেইনার/কী আছে সংশোধিত শ্রম আইনে

শ্রম আইন। স্ট্রিম গ্রাফিক

ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য শতকরা হারের জটিলতা দূর করে এখন সর্বনিম্ন ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতেই আবেদন করা যাবে। একইসঙ্গে, ১০০ বা ততোধিক শ্রমিক কর্মরত থাকা প্রতিষ্ঠানে ‘ভবিষ্যৎ তহবিল’ গঠনকে করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন ও বার্ষিক উৎসব ছুটি ১১ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৩ দিনে উন্নীত করা হয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় এমন সব যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) জারি করা হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’।

এই পদক্ষেপকে নিছক আইনি পরিবর্তন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমাগত চাপ ও ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

এই অধ্যাদেশ একদিকে যেমন দেশের শ্রমিকের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে, তেমনই অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাতের মালিক ও সরকারের জন্য এক নতুন পরীক্ষারও সূচনা করেছে।

প্রেক্ষাপট: কেন এই সংশোধন অপরিহার্য ছিল

এই অধ্যাদেশের শেকড় প্রোথিত আছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার গভীরে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ছিল প্রথম বৈশ্বিক সতর্কবার্তা। হাজারেরও বেশি শ্রমিকের সেই মর্মান্তিক মৃত্যু বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত করে দিয়েছিল। সেই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক ক্রেতা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশের ওপর কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। ইইউ-এর বাজারে জিএসপি প্লাস-এর মতো বাণিজ্য সুবিধা ধরে রাখার জন্য শ্রম আইনের সংস্কারকে অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়।

এই আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিভিন্ন সময়ে শ্রম আইন সংশোধন করা হলেও, সমালোচকদের মতে সেগুলো ছিল মূলত লোক দেখানো। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত জটিল করে রাখা হয়েছিল। একটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রমিকের স্বাক্ষর জোগাড় করা ও তা শ্রম অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়া ছিল প্রায় অসাধ্য এক কাজ। শ্রম পরিচালকের হাতে ইউনিয়ন নিবন্ধন বাতিল বা প্রত্যাখ্যান করার একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় মালিকপক্ষ প্রায়শই এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করত বলে অভিযোগ ছিল।

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ২০২৩ সালের শেষ দিকে। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা যখন রাস্তায় নেমে আসে, তখন তাদের ওপর নেমে আসে নির্মম দমন-পীড়ন। পুলিশের গুলিতে একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গণহারে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।

এই চাপা ক্ষোভ ও অধিকারহীনতার অনুভূতিই ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।

আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা অর্জন ও দেশের শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমনের জন্য শ্রম আইনের আমূল সংস্কার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই এই অধ্যাদেশ জারি করা হলো।

যা আছে সংশোধিত শ্রম আইনে

পুরনো আইনের খোলস পাল্টে শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে এই নতুন অধ্যাদেশ দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা করেছে।

ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও নিবন্ধন: এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী পরিবর্তনটি আনা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। এটি ছিল দশকের পর দশক ধরে শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। পূর্ববর্তী আইনে একটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য মোট শ্রমিকের ২০ শতাংশের সমর্থনের প্রয়োজন হতো। সংশোধিত অধ্যাদেশে এই হারকে স্তরভিত্তিক কাঠামোতে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা ইউনিয়ন গঠনকে বহুলাংশে সহজ করবে। যেমন, ৩০০ জন পর্যন্ত শ্রমিকের কারখানায় মাত্র ২০ জন শ্রমিকের সমর্থনই যথেষ্ট হবে।

এর চেয়েও বড় পরিবর্তন হলো, এখন থেকে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রত্যাখ্যান করার একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। কোনো ইউনিয়নের আবেদন যদি প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন দিতে বাধ্য থাকবেন। আবেদন বাতিল হলে, ইউনিয়ন নেতারা সরাসরি শ্রম আদালতে আপিল করতে পারবেন ও আদালতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।

এর পাশাপাশি, শ্রমিকদের ব্যক্তিগত তথ্য মালিকপক্ষের কাছে প্রকাশ না করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা ইউনিয়ন সংগঠকদের সুরক্ষা দেবে। এমনকি কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার পর তাকে অন্য কারখানায় চাকরি পেতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘ব্ল্যাক লিস্টিং’ বা কালো তালিকাভুক্ত করাকে ‘অসৎ শ্রম আচরণ’ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা: দ্বিতীয় বড় পরিবর্তন হলো কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা। রানা প্লাজার মতো ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে এই অধ্যাদেশে ‘কর্মস্থল সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে নতুন, স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা বলা হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষ কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই যেকোনো কারখানা পরিদর্শন করতে পারবে, অনিয়ম পেলে মোটা অঙ্কের জরিমানা আরোপ করতে পারবে, এমনকি কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখবে। 

এর পাশাপাশি, ৫০ জনের বেশি শ্রমিক আছে এমন প্রতিটি কারখানায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সমান প্রতিনিধিত্বসহ ‘নিরাপত্তা কমিটি’ গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো, কোনো শ্রমিক যদি মনে করেন যে তার কর্মপরিবেশ জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য আসন্ন ও গুরুতর বিপদ সৃষ্টি করছে, তবে তিনি সেই কাজ করতে অস্বীকার করার আইনি অধিকার পাবেন ও এর জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

শ্রমিক ছাঁটাই, লে-অফ ও ক্ষতিপূরণ: তৃতীয়ত, শ্রমিক ছাঁটাই, লে-অফ ও ক্ষতিপূরণের নিয়মে আনা হয়েছে মানবিক পরিবর্তন। এখন থেকে কোনো স্থায়ী শ্রমিক চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে, তিনি তার চাকরির মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছরের জন্য ৩০ দিন পর্যন্ত মজুরিসহ গ্র্যাচুইটি পাবেন, যা আগে ছিল অনেক কম। ‘লে-অফ’-এর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের নিয়ম আরও স্পষ্ট করা হয়েছে।

এছাড়া, অসদাচরণের অভিযোগে কোনো শ্রমিককে বরখাস্ত করা হলে, সেই অভিযোগ প্রমাণের সম্পূর্ণ দায়ভার মালিকপক্ষের ওপর বর্তাবে।

মাতৃত্বকালীন সুবিধা বৃদ্ধি ও জেন্ডার সমতা: চতুর্থত, নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে নারী শ্রমিকরা ১২০ দিন বা চার মাসের সবেতন ছুটি পাবেন। এই অধ্যাদেশে লিঙ্গীয় সমতার দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। আইন থেকে ‘মহিলা’ শব্দটি বাদ দিয়ে সর্বত্র ‘নারী’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই প্রথম ‘জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও হয়রানি’ ও ‘যৌন হয়রানি’-এর সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত সংজ্ঞা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের যৌন ইঙ্গিতমূলক আচরণ, মন্তব্য, পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন থেকে শুরু করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাকে শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নারী প্রধান করে ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি’ গঠন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এছাড়াও, এই অধ্যাদেশটি কৃষি শ্রমিক, গৃহকর্মী ও নাবিকদের মতো এতদিন ধরে আইনের আওতার বাইরে থাকা বিশাল সংখ্যক শ্রমিককে নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায়ের অধীনে এনে তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জবরদস্তিমূলক বা বাধ্যতামূলক শ্রমকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের জন্য জরিমানার পরিমাণও বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথচলা 

কাগজে-কলমে এই অধ্যাদেশ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে ইইউ-এর বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার পথ সুগম হবে ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থাও ফিরে আসবে। কিন্তু আসল পরীক্ষা শুরু হবে এখন, আর তার প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অধ্যাদেশ জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠনগুলো বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ—যৌথভাবে এই আইনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মূল অভিযোগ, চূড়ান্ত গেজেটে এমন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে যা সরকার, মালিক ও শ্রমিক—এই তিন পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপাক্ষিক পরামর্শ সভায় (টিসিসি) আলোচিত বা অনুমোদিত হয়নি। তারা দাবি করছেন,  একতরফাভাবে এই পরিবর্তনগুলোকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

একদিকে, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দেশের শ্রমিক শ্রেণির কাছে সংস্কারমুখী ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তি তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্যদিকে রয়েছে দেশের পোশাক খাতের মালিকরা, যারা দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ জোগান দেয় ও লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রেখেছে। তাদের এই প্রত্যাখ্যানকে উপেক্ষা করা সরকারের জন্য সহজ হবে না। এই পরিস্থিতি সরকারকে জটিল দোলাচলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে: তারা কি আন্তর্জাতিক অঙ্গিকার ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে অগ্রাধিকার দেবে, নাকি অর্থনৈতিক বাস্তবতার কথা ভেবে মালিকপক্ষের সঙ্গে আপোষ করবে? 

এর পাশাপাশি, নতুন ‘কর্মস্থল সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ কতটা স্বাধীনভাবে ও দুর্নীতিমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করছে কর্মপরিবেশের আসল উন্নয়ন। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন করা এক জিনিস, আর তাকে মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতার বলয়কে উপেক্ষা করে কার্যকর করা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা। 

যে অধ্যাদেশ শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে নতুন সামাজিক চুক্তি তৈরি করার কথা ছিল, সেটিই এখন জন্মলগ্নে এক বড় ধরনের অনাস্থার সম্মুখীন। এই সংঘাতের সমাধানই নির্ধারণ করে দেবে, বাংলাদেশ কি শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে, নাকি পুরনো ব্যবস্থার টানাপোড়েনের মধ্যেই আটকে থাকবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত