leadT1ad

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের কৌশলগত ভাবনা

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ০০
স্ট্রিম গ্রাফিক

দীর্ঘ এক শীতলতার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক উষ্ণতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত এবং পরবর্তীকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার কারণে প্রায় দেড় দশক ধরে এই সম্পর্ক ছিল নিষ্ক্রিয়। ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের পাকিস্তান সফরের পর দু’দেশের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। তবে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে গতি এসেছে এবং অনেক বছর পর পাকিস্তানের কোনো চার তারকা জেনারেল বাংলাদেশ সফর করলেন।

পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা বর্তমানে বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আছেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী এই জেনারেল গত ২৫ আগস্ট ২০২৫, শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তাঁরা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন। যার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কৌশলগতভাবে এই অগ্রগতি কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, এটি বৃহত্তর আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য, বিশেষ করে ভারতের ‘আঞ্চলিক দাপট’ মোকাবিলা ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

ক. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সম্পর্কের বর্তমান বাঁক: ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দীর্ঘদিনের দাবি অমীমাংসিত থাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত-ঘনিষ্ঠ নীতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় স্থবির ছিল। ২০০৯ সাল থেকে এই সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানানোর পর। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে বহুমাত্রিক কূটনীতিতে মনোযোগী হয়েছে।

১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দীর্ঘদিনের দাবি অমীমাংসিত থাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি।

এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একারণে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের জাতিসংঘ ও ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বর্তমানে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

১. দীর্ঘ বিরতির পর উভয় দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে কূটনৈতিক অচলাবস্থা ভেঙে গেছে এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এ সময়ে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কূটনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন, যা গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ। ২৩-২৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটর মোহাম্মদ ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফর এই উষ্ণতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। সর্বশেষ সফরের প্রায় ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটি ছিল প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এর ফলে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি (কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য), বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিনিময়সহ বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ২০২৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা সফর করেন, যা ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের সফর। তাঁদের আলোচনায় উচ্চ পর্যায়ের সফরের পথ প্রস্তুত করা এবং অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়।

পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সফর করেন। দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে সফর করেন। তিনি বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে একটি যৌথ কমিশন গঠনের বিষয়ে একমত হন।

২. বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি পাকিস্তান বৃহৎ প্রতিবেশী চীনের পথ অনুসরণ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রনেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)-সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গেও প্রকাশ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তাদের আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।

২০০৩ ও ২০০৮ সালে হাইকোর্ট রায়ের মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, ১৯৭১ সালে যারা নাবালক ছিল বা পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। এই রায়ের ফলে এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ভোটাধিকার এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধা লাভ করে। তবে নাগরিকত্ব পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের ক্যাম্পের অস্থায়ী ঠিকানার কারণে পাসপোর্ট পাওয়া, সরকারি চাকরি ও মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার হন।

৩. সরকারি পর্যায়ে এসব ধারাবাহিক সফরের ফলে সম্প্রতি পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশি কূটনীতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালুর আগ্রহ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতীকী ও বাস্তব পদক্ষেপ। সফররত পাকিস্তানি জেনারেল দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং জনগণের মধ্যে ভাগ করা সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার পাকিস্তানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জেনারেল মির্জা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য, সংযোগ ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের বিশাল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের দুই দেশ একে অপরকে সমর্থন করবে।’ তিনি আরও বলেন, করাচি ও চট্টগ্রামের মধ্যে একটি দ্বিমুখী জাহাজ চলাচল রুট ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে, কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা-করাচি বিমান রুটও খুলবে আশা করা হচ্ছে।

খ. বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়ন ও তিন কৌশল: দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে প্রধানত তিনটি কৌশলগত কারণ কাজ করছে—

১. আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা: দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পর, বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই একপাক্ষিক নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ঢাকা এখন তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে অংশীদারদের মধ্যে ভারসাম্য আনতে চাইছে। আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রায়শই ভারত বা অন্য কোনো বৃহৎ শক্তির প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়’—এই মূলনীতিকে কার্যকর করার মাধ্যমে একটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের কথিত ‘দাদাগিরি’ এবং অতিরিক্ত প্রভাবমুক্ত হতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অপরিহার্য।

বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক সম্পর্ককে বহুমুখী করতে জাপান, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধি এই বৃহত্তর কৌশলেরই একটি প্রতিফলন। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হলে তা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে একটি বিকল্প শক্তির মেরুকরণ তৈরি করবে। তাছাড়া ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের মধ্যে ছোট দেশগুলোর (যেমন নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা) মতো বাংলাদেশও একমুখী পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগ দিতে চাইছে।

২. চীন ফ্যাক্টর ও অর্থনৈতিক করিডোর: চীন, যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েরই কাছেই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার, তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে, তা ভবিষ্যতে একটি সম্ভাব্য ত্রিপাক্ষিক কৌশলগত জোটে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা ভারতের জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। চীন চায় তার স্ট্র্যাটেজিক কৌশলের অংশ হিসেবে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকুক। তাই ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের নীরব সমর্থন বা উৎসাহ থাকা অস্বাভাবিক নয়, কারণ এটি আঞ্চলিকভাবে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত বিষয়গুলো স্থায়ীভাবে নিষ্পত্তির ওপর জোর দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, এই ইস্যুটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে এর সমাধান অপরিহার্য। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে ১৯৭১ ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে 'গভীর অনুশোচনা' জ্ঞাপন (যদি এখনই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা সম্ভব না হয়) এবং এই ঐতিহাসিক ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানে সামান্য হলেও উভয়পক্ষই এটিকে বাড়াতে আগ্রহী। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার, যা মূলত পাকিস্তানের অনুকূলে। বাংলাদেশ বর্তমানে পাকিস্তান থেকে তুলা, সুতা এবং কিছু কৃষি পণ্য আমদানি করে। এ কারণে বাংলাদেশের লক্ষ্য পাকিস্তানের বিশাল বাজারে তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজার ও বিনিয়োগের উৎসের প্রয়োজন।

অন্যদিকে, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানের জন্য শক্তিশালী অর্থনীতির বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং পাকিস্তানের কৃষি ও আইটি খাতে পারস্পরিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি আদান-প্রদানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে দুই দেশই জয়েন্ট ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করছে। দুই দশকেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জিইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই বৈঠকে বাণিজ্য বৃদ্ধি, শুল্ক হ্রাস ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরির সম্ভাবনা আছে।

৩. প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা: জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সাম্প্রতিক সফর মূলত ৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখ পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ধারাবাহিক সফর বিনিময়ের ফলাফল। যার শুরুটা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে, বাংলাদেশ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান ১৩-১৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পাকিস্তান সফর করেন।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এটিই ছিল প্রথম কোনো শীর্ষ বাংলাদেশি সেনাকর্মকর্তার বিরল পাকিস্তান সফর। এই সফরে তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটি জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁর সফরের পরপরই বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ফেব্রুয়ারি ২০২৫ মাসে পাকিস্তান সফর করেন।

দুই দেশের সামরিক বাহিনী প্রধানদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার অংশ হিসেবে তাঁর এই সফর অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আগস্ট ২০২৫ মাসে পাকিস্তান সফর করেন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত জেনারেল মির্জা-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। জেনারেল মির্জার এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালের সংগ্রাম ও ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ। ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়ার অর্থ হলো বাংলাদেশের জনগণের এই ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রীয় অর্জনকে পূর্ণ স্বীকৃতি না দেওয়া। এর ফলে জনগণের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকে, যা যেকোনো সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়।

ক. জেনারেল মির্জার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর ছাড়াও চলতি বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের আরও কয়েকটি সামরিক প্রতিনিধিদল সফর করে গেছেন, যা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের শীতল সামরিক সম্পর্ক ভেঙে নতুন করে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ বিনিময় ও কৌশলগত বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়, যেমন জানুয়ারি ২০২৫ মাসে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর মেজর জেনারেল শাহিদ আমির আফসার এবং মেজর জেনারেল আলম আমির আওয়ানসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করেন।

জুন ২০২৫ মাসে ০৩জন পাকিস্তানি সেনা ব্রিগেডিয়ার কক্সবাজারের রামুতে অবস্থিত ১০ম পদাতিক ডিভিশনের সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন। সর্বশেষ ৬-৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল তাবাসসুম হাবিব, ডিরেক্টর জেনারেল জয়েন্ট স্টাফ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সফর করেন। তখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এটি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের পাকিস্তানি সামরিক প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর। তাঁকে ঢাকাতে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই সফরগুলো বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধীনে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা কূটনীতিতে ভারসাম্য আনার নীতির প্রতিফলন।

খ. দুই দেশের সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের দ্বিপাক্ষিক সফর ছাড়াও সামরিক প্রশিক্ষণ, যেমন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বহুজাতিক সামরিক মহড়া ‘ইনডাস শিল্ড-২০২৪’-এ অংশগ্রহণ করেছে এবং নৌবাহিনী পাকিস্তানের বহুজাতিক মহড়া ‘আমান’-এ নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ তাঁর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য 'ফোর্সেস গোল-২০৩০' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পাকিস্তানের কাছ থেকে জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমানসহ সামরিক সরঞ্জাম কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা যায়। এই ধরনের সামরিক চুক্তি দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে।

গ. সামরিক ক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অফিসার বিনিময় কর্মসূচি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে জেনারেল মির্জা ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার, স্কুল অভ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাক্টিস, সিলেট সেনানিবাস থেকে রণকৌশল কোর্স করেন। এছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাডেট জান্নাতুল মাওয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ)-এর ২৬তম লেডি ক্যাডেট কোর্স থেকে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে কমিশন লাভ করেছেন। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পাশাপাশি, তিনি তার অসাধারণ সাফল্যের জন্য পাকিস্তান সামরিক একাডেমি থেকে ‘কমান্ড্যান্টস ওভারসিজ মেডেল’-এ ভূষিত হয়েছেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির তার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন।

ঘ. আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সামুদ্রিক নিরাপত্তা, জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানসহ যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতে একটি বহুমাত্রিকতা আসে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও আত্মনির্ভরশীলতা রক্ষায় সহায়ক।

অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানের জন্য শক্তিশালী অর্থনীতির বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং পাকিস্তানের কৃষি ও আইটি খাতে পারস্পরিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি আদান-প্রদানের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে দুই দেশই জয়েন্ট ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করছে।

পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য, সংযোগ ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের বিশাল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। তবে এই সম্পর্ক উন্নয়নে কিছু ঐতিহাসিক বোঝাপড়া ও অমীমাংসিত ইস্যু রয়ে গেছে—

ক। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত : বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি হলো ১৯৭১ সালের সংগ্রাম ও ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ। ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়ার অর্থ হলো বাংলাদেশের জনগণের এই ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রীয় অর্জনকে পূর্ণ স্বীকৃতি না দেওয়া। এর ফলে জনগণের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকে, যা যেকোনো সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়।

ক্ষমা না চাইলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে আবেগ ও আস্থার ঘাটতি থেকেই যাবে এবং এই অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ইস্যুটি সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এখনও প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনেকবার গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ও জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা এবং স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধের দাবি জানানো হয়েছে।

১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে পাকিস্তান এখনও অনিচ্ছুক। তারা এই ঘটনাগুলোকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করলেও, ‘ক্ষমা’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। যদিও পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ঘটনা নিয়ে ‘প্রতীকী আলোচনা’য় রাজি হয়েছে, কিন্তু এর মানে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া নয়। এটি মূলত কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার একটি কৌশল মাত্র।

খ। সম্পদের ভাগাভাগি: স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদ ও অর্থ-সহায়তার ন্যায্য ভাগাভাগি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৪.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক দাবি উত্থাপিত হয় যা এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। এই দাবির মধ্যে মূলত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত:

১. ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের বৈদেশিক সাহায্য: ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো ২০ কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তা, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঢাকা শাখা থেকে লাহোর শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছিল।

২. রিজার্ভ ও সরকারি তহবিল: অবিভক্ত পাকিস্তানের সরকারি তহবিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সঞ্চয়পত্র এবং বিদেশে সংরক্ষিত ব্যালান্সের ন্যায্য হিস্যা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ অবিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের ৫৬ শতাংশের এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান বিবেচনায় ৫৪ শতাংশের অংশীদার ছিল।

৩. সরকারি কর্মচারীদের পাওনা: স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশি সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রের আটকে থাকা অর্থ।

৪. বন্ড ও সঞ্চয়পত্রের দায়: বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পাকিস্তান সরকারের জারি করা প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র ও আয়কর বন্ডের মতো বিভিন্ন ঋণপত্রের দায়ভার বহন করার অর্থ।

ভিসা অব্যাহতি চুক্তি (কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য), বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিনিময়সহ বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ২০২৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা সফর করেন, যা ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের সফর। তাঁদের আলোচনায় উচ্চ পর্যায়ের সফরের পথ প্রস্তুত করা এবং অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়।

গ। বিহারি জনগোষ্ঠীর সমস্যা: বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় ২.৪ লাখ থেকে ৫ লাখ উর্দুভাষী মানুষ বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় অবস্থিত প্রায় ৬৬টি জরাজীর্ণ ক্যাম্পে (যেমন ঢাকার জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর, কালশী) অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। ক্যাম্পগুলো অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ, ছোট ছোট কক্ষে বহু মানুষ বসবাস করে। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও মৌলিক পরিষেবাগুলির চরম অভাব রয়েছে।

২০০৩ ও ২০০৮ সালে হাইকোর্ট রায়ের মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, ১৯৭১ সালে যারা নাবালক ছিল বা পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। এই রায়ের ফলে এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ভোটাধিকার এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধা লাভ করে। তবে নাগরিকত্ব পাওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাদের ক্যাম্পের অস্থায়ী ঠিকানার কারণে পাসপোর্ট পাওয়া, সরকারি চাকরি ও মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার হন। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের সমস্যাগুলো কেবল মানবিক নয়, বরং বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি বড় বাধা।

ঘ। ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি : সরাসরি শিপিং বা রেল সংযোগের অভাব দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে একটি বড় বাধা। কারণ ইতোপূর্বে দুই দেশের বন্দরের (করাচি ও চট্টগ্রাম) মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করত না। পণ্য পরিবহনের জন্য শ্রীলঙ্কার কলম্বো, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং-এর মতো তৃতীয় দেশের বন্দরে ট্রানশিপমেন্ট (জাহাজ পরিবর্তন) করতে হতো। এর ফলে স্বাভাবিক সময়ের (সরাসরি পথে প্রায় ১১ দিন) চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত বেশি সময় লাগত। উচ্চ পরিবহন খরচ শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ হতো, যা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের উপর চাপ সৃষ্টি করত।

এই সমস্যা দূরীকরণে নভেম্বর ২০২৪ মাসে করাচি বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। এছাড়াও আগে পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কাস্টমসে ১০০% শারীরিক পরিদর্শন (ফিজিক্যাল ইন্সপেকশন) বাধ্যতামূলক ছিল। এর ফলে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রিতা ও খরচ বৃদ্ধি পেত। সম্প্রতি এভাবে পরিদর্শন বাতিল করা হয়েছে। এটি পণ্য খালাসকে দ্রুত করেছে এবং বন্দর-ভোগান্তি কমিয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ করার ফলে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ককে বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একারণে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের জাতিসংঘ ও ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বর্তমানে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ঙ। ভারতের প্রতিক্রিয়া: ঢাকা-ইসলামাবাদ ঘনিষ্ঠতা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে ভারতের ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করবে, কেননা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান এবং পূর্ব সীমান্তে বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল। কিন্তু যদি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সামরিক বা কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ায়, তবে ভারত সামরিক ও নিরাপত্তা দিক থেকে দ্বিমুখী চাপের সম্মুখীন হতে পারে। ভারত মনে করে, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক তৎপরতার পেছনে চীনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। যদি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীন একটি কৌশলগত অক্ষ তৈরি করে, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে গুরুতরভাবে দুর্বল করবে। এছাড়াও বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম বা প্রযুক্তিগত সহায়তা গ্রহণ করলে তা ভারতের কাছে একটি 'রেড লাইন' হতে পারে। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে এসব চাপ বিভিন্ন উপায়ে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হতে পারে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, যা কৌশলগত বাস্তবতার নিরিখে পরিচালিত হচ্ছে। এই সম্পর্ক কেবল দুই দেশের জন্যই নয়, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যেও একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ বর্তমানে একক কোনো বৃহৎ শক্তির উপর নির্ভরশীল না থেকে ভারসাম্যপূর্ণ বহুমাত্রিক কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অন্যদিকে পাকিস্তান আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে। সম্পর্কের এই নতুন মোড় দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘদিনের শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে, যা ভারত, চীন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির জন্য গভীর কৌশলগত প্রভাব ফেলতে পারে। তবে বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পথ সুগম হলেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে অর্থনৈতিক লাভ-এর চেয়ে ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অনেক বেশি। যতক্ষণ না পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ১৯৭১-এর ভুল স্বীকার করা হচ্ছে, ততক্ষণ এই উষ্ণতা কেবল বাণিজ্যিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ১৯৭১ সালের অমীমাংসিত বিষয়গুলো স্থায়ীভাবে নিষ্পত্তির ওপর জোর দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, এই ইস্যুটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে এর সমাধান অপরিহার্য। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে ১৯৭১ ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে 'গভীর অনুশোচনা' জ্ঞাপন (যদি এখনই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা সম্ভব না হয়) এবং এই ঐতিহাসিক ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলে এবং তা কীভাবে মোকাবিলা করা হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে দক্ষিণ এশিয়ার আগামী দিনের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তবে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক দায় ও ক্ষমার বিষয়টি মীমাংসা না হলে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত