leadT1ad

কী আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ ও সাইবার সুরক্ষা অধ্যদেশ ২০২৫-এ

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

উদ্ভাবন, নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতার ভারসাম্যে একটি নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এই অধ্যাদেশ ও নির্দেশিকা। স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক হতে বলা হয়েছে। ওই আদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন দপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ)’ ও ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫’ মেনে চলার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু কী আছে এই দুই নির্দেশনায়?

বাংলাদেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দ্রুত বিকাশ যোগাযোগ, প্রশাসন ও দৈনন্দিন জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে। তবে এর সঙ্গে এসেছে কিছু ঝুঁকিও—যেমন ভুয়া তথ্য, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন ও সাইবার হামলার আশঙ্কা।

সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে—সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নির্দেশিকা ২০১৯ (সংশোধিত সংস্করণ) এবং সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ২০২৫। পরেরটি বিতর্কিত সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩-এর পরিবর্তে প্রণীত হয়।

নির্দেশিকাটি সরকারি খাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৈরি। এর উদ্দেশ্য হলো প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো, একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষা করা।

অন্যদিকে, ২০২৫ সালের অধ্যাদেশটি সাইবার অপরাধ দমনে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রণীত। এতে ২০২৩ সালের আইনের নয়টি দমনমূলক ধারা বাতিল করা হয়েছে—যেমন মানহানি বা জাতীয় প্রতীকের অবমাননা সংক্রান্ত বিধান, যা বাকস্বাধীনতা সীমিত করেছিল।

অধ্যাদেশটি ২১ মে ২০২৫ সালে কার্যকর হয়। এটি সাইবার নিরাপত্তায় তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর জোর দেয়—প্রতিরোধ, সুরক্ষা ও বিচারপ্রক্রিয়া।

নিচে সরকারি নথি ও বিশ্লেষণ থেকে সংগৃহীত এই দুটি উদ্যোগের মূল দিকগুলো তুলে ধরা হলো।

নির্দেশিকার মূল উদ্দেশ্য হলো—ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সচেতনতা বৃদ্ধি, সেবা প্রদান ও নাগরিক মতামত গ্রহণের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। পাশাপাশি, এর অপব্যবহার রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

১. সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নির্দেশিকা–২০১৯ (সংশোধিত সংস্করণ)

২০১৯ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রকাশিত এই নির্দেশিকাটি ২০১৬ সালের সংস্করণের হালনাগাদ রূপ। এটি সরকারি কর্মচারী, দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর জন্য প্রযোজ্য। নির্দেশিকার মূল উদ্দেশ্য হলো—ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সচেতনতা বৃদ্ধি, সেবা প্রদান ও নাগরিক মতামত গ্রহণের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। পাশাপাশি, এর অপব্যবহার রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

নির্দেশিকাটি ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি অধ্যায়ে নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং নৈতিক আচরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

কাঠামো ও প্রধান অধ্যায়সমূহ

ভূমিকা: সরকারি সেবা প্রদানে সামাজিক মাধ্যমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালের নির্দেশিকা হালনাগাদ করা হয়েছে।

উদ্দেশ্য ও এখতিয়ার: নাগরিক সম্পৃক্ততায় নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহারের নিশ্চয়তা। এটি সব সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় ও মাঠ প্রশাসনের জন্য প্রযোজ্য।

সোশ্যাল মিডিয়া নির্বাচনের নির্দেশনা: প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের সক্ষমতার ভিত্তিতে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম বাছাইয়ের পরামর্শ।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার: নেটওয়ার্ক গঠন, নীতি প্রচার, সেবায় উদ্ভাবন ও জনগণবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলার ওপর জোর।

অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা: সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ৩–৫ সদস্যের প্রশাসক দল গঠন, শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ও গোপনীয়তা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সতর্কতা ও দায়িত্বশীল আচরণ আবশ্যক।

কনটেন্ট ব্যবস্থাপনা: প্রকাশিত তথ্য হতে হবে সত্য, প্রাসঙ্গিক ও অ-ব্যক্তিগত। গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সংরক্ষণ ও অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সংযুক্তির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আপডেট ও প্রতিক্রিয়া: নিয়মিত পোস্টিং ও নাগরিক প্রশ্নের দ্রুত জবাব নিশ্চিত করার নির্দেশনা।

প্রযোজ্য আইনসমূহ: সব সরকারি আইন, বিধি ও সামাজিক মাধ্যমের শর্তাবলি এখানে প্রযোজ্য।

নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু: বিভাজনমূলক, বৈষম্যমূলক বা অশালীন কনটেন্ট প্রকাশ নিষিদ্ধ।

পর্যবেক্ষণ: প্রতি তিন মাসে ব্যবহারের মূল্যায়ন ও সচেতনতা প্রশিক্ষণ আয়োজনের নির্দেশ।

সরকারি স্পর্শকাতর বা গোপনীয় তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে, সংবেদনশীল দায়িত্ব পালনকারী কর্মচারীদের তাদের কাজের সঠিক ধরন, স্থান এবং অন্যান্য কার্যকলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।

করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ

করণীয়:

অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে সঠিক নাম, লোগো, ব্যানার ও লক্ষ্য/শ্রোতাবিষয়ক তথ্য ব্যবহার করতে হবে।

নিবেদিত অ্যাডমিন/মডারেটর দল গঠন ও দুই-ধাপ যাচাইকরণসহ শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে।

তথ্যভিত্তিক, সেবা-সম্পর্কিত পোস্ট দিতে হবে এবং নাগরিক প্রতিক্রিয়ার দ্রুত জবাব দিতে হবে।

সরকারি রেসপন্স সিস্টেম (জিআরএস)-এর সঙ্গে সমন্বয় ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

বর্জনীয়:

সরকারি অ্যাকাউন্টে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ছবি পোস্ট করা যাবে না। আত্মপ্রচার, লিঙ্গ বৈষম্য বা ভিত্তিহীন গুজব প্রচার নিষিদ্ধ।

ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো বিষয় শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা।

কোনোভাবেই সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো কন্টেন্ট (পোস্ট, ছবি, অডিও, ভিডিও) শেয়ার বা লাইক করা যাবে না।

জাতীয় ঐক্য ও চেতনার বিরোধী কোনো তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিভাজন, জাতিগত বৈষম্য বা অস্থিরতা উসকে দেওয়া যাবে না (লিখিত, অডিও বা ভিডিও আকারে)।

ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে গোপন তথ্য ফাঁস করা বা কর্মকর্তাদের অযথা ট্যাগ করা যাবে না।

সরকারি স্পর্শকাতর বা গোপনীয় তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে, সংবেদনশীল দায়িত্ব পালনকারী কর্মচারীদের তাদের কাজের সঠিক ধরন, স্থান এবং অন্যান্য কার্যকলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।

অজানা বা সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে এবং অপরিচিত উৎস থেকে আসা ফাইল ডাউনলোড করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

অন্যদের সম্মান করে এবং সম্মানজনক আচরণ করে অনলাইন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সাইবার বুলিং, হয়রানি বা ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

দায়িত্ব ও শাস্তি

সরকারি কর্মচারীরা নির্দেশিকা লঙ্ঘনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সরকারি আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—যেমন প্রশাসনিক তদন্ত বা সাময়িক বরখাস্ত।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ত্রৈমাসিকভাবে ব্যবহারের পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

এই নির্দেশিকাগুলো সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মতপ্রকাশ ও গোপনীয়তার স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনবিশ্বাস রক্ষা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে।

আগের আইনের ৯টি বিতর্কিত ধারা এই অধ্যাদেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানহানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় প্রতীকের প্রতি আক্রমণাত্মক কনটেন্ট প্রকাশ এবং মিথ্যা, হয়রানিমূলক বা হুমকিযুক্ত কনটেন্ট প্রচার। আগের আইনের এই ধারাগুলোতে করা সব মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

২. সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ-২০২৫

২০২৫ সালের ২১ মে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এই অধ্যাদেশ জারি করেন। এতে মোট ৫১টি ধারা রয়েছে। এটি বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ বাতিল করে নতুন কাঠামো প্রণয়ন করেছে, যার অপব্যবহারে সাংবাদিক ও কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৯৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল।

অধ্যাদেশটি একটি শক্তিশালী সাইবার সুরক্ষা কাঠামো তৈরি করেছে। এর অধীনে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা (এনসিএসএ)—যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন—এবং জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হয়েছে, যার সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা। এই সংস্থা সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধ, ফরেনসিক তদন্ত এবং ব্যাংক ও বিদ্যুৎ গ্রিডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো সুরক্ষায় দায়িত্বশীল থাকবে।

অধ্যাদেশে নতুন সংযোজন হিসেবে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সাংবিধানিক অধিকার, অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধকরণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ—যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় এই ক্ষেত্রে অগ্রগামী করেছে। বাতিল হওয়া আইনের অধীনে চলমান সব মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

আগের আইনের ৯টি বিতর্কিত ধারা এই অধ্যাদেশে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মানহানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় প্রতীকের প্রতি আক্রমণাত্মক কনটেন্ট প্রকাশ এবং মিথ্যা, হয়রানিমূলক বা হুমকিযুক্ত কনটেন্ট প্রচার। আগের আইনের এই ধারাগুলোতে করা সব মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

এই অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো এআই ব্যবহার করে সংঘটিত সাইবার অপরাধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এআই-এর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলিং, যৌন হয়রানি বা পর্নোগ্রাফি ছড়ানোর মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অনলাইন জুয়া বা বাজি, এর বিজ্ঞাপন, প্রচার বা সহায়তায় জড়িত থাকার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এর জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২০২৩ সালের আইনের তুলনায় শাস্তি সহনীয় ও অধিকাংশ অপরাধ জামিনযোগ্য করা হয়েছে (ক্ষুদ্র অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর)। সামাজিক মাধ্যম-সংক্রান্ত বিধানগুলো এখন হয়রানি ও ঘৃণাত্মক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীভূত, আগের মতো অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ নয়।

প্রধান ধারা ও অপরাধসমূহ

অধ্যাদেশটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি সাইবার হুমকিকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ২০২৩ সালের আইনের তুলনায় শাস্তি সহনীয় ও অধিকাংশ অপরাধ জামিনযোগ্য করা হয়েছে (ক্ষুদ্র অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর)। সামাজিক মাধ্যম-সংক্রান্ত বিধানগুলো এখন হয়রানি ও ঘৃণাত্মক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীভূত, আগের মতো অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ নয়।

১. হ্যাকিং ও অননুমোদিত প্রবেশ

অপরাধ: কম্পিউটার সিস্টেমে অবৈধ প্রবেশ, তথ্য চুরি বা ডিজিটাল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করা।

শাস্তি: ৫–৭ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা; জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত অপরাধে কঠোর শাস্তি।

২. প্রতারণা ও অর্থনৈতিক অপরাধ

অপরাধ: সাইবার জালিয়াতি, পরিচয় চুরি, অনলাইন প্রতারণা বা জুয়া প্রচার।

শাস্তি: ২–৫ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা; অনলাইন বেটিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

৩. সন্ত্রাস ও হুমকি

অপরাধ: সাইবার সন্ত্রাসবাদ, বিশেষত এআই-সহায়তায় জনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করা।

শাস্তি: ৭–১০ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা।

৪. হয়রানি ও গোপনীয়তা লঙ্ঘন

অপরাধ: সাইবার স্টকিং, প্রতিশোধমূলক পর্নো, অনুমতি ছাড়া অন্তরঙ্গ ছবি প্রচার, যৌন হয়রানি ইত্যাদি। নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা।

শাস্তি: ৩-৭ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা ৫–১০ লাখ টাকা জরিমানা; প্রতিশোধমূলক পর্নোর ক্ষেত্রে ‘ক্ষতির প্রমাণ’ প্রয়োজন নেই।

৫. ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য

অপরাধ: ধর্মীয় বা জাতিগত ঘৃণা ছড়ানো, মিথ্যা অভিযোগ প্রচার।

শাস্তি: ২-৫ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা; ভুয়া অভিযোগ দায়েরকারীরাও দণ্ডনীয়।

৬. সহায়তা ও ছদ্মবেশে অপরাধ

অপরাধ: অন্যকে অপরাধে সহায়তা বা ছদ্মবেশে অপরাধ সংঘটন।

শাস্তি: ১–৩ বছর কারাদণ্ড এবং/অথবা ২–৫ লাখ টাকা জরিমানা।

৭. সামাজিক মাধ্যম সংক্রান্ত বিধান

সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকে ঘৃণাত্মক বক্তব্য, হয়রানি বা ক্ষতিকর কনটেন্ট দ্রুত অপসারণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। তবে ২০২৩ সালের আইনের মতো সর্বাত্মক সেন্সরশিপ অনুমোদন করা হয়নি।

জরুরি অবস্থায় (যেমন—গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে সাইবার হামলার আশঙ্কা) ওয়ারেন্ট ছাড়া তদন্ত চালানোর অনুমতি রয়েছে। এছাড়া সীমান্ত-পারের সাইবার অপরাধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিতের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

সমালোচকরা মনে করেন ‘অশ্লীলতা’ বা ‘অবৈধ সম্পর্ক’-এর মতো অস্পষ্ট পরিভাষা ভবিষ্যতে ইচ্ছামতো প্রয়োগ ও মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

পূর্ববর্তী আইনের তুলনামূলক পরিবর্তন

২০২৩ সালের আইনে থাকা অস্পষ্ট ও বাকস্বাধীনতা-বিরোধী মোট ৯টি ধারা বাদ দিয়ে অধিকাংশ অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এখন মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে হ্যাকিং, তথ্য চুরি ও নিরাপত্তা হুমকির মতো প্রকৃত অপরাধে। ফলে হাজারো মামলা বাতিল হয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে।

আগের আইনের তুলনায় জনগণের অধিকার রক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন, কোনো কনটেন্ট অপসারণের পর আদালতের অনুমোদন নিতে হবে। আদালত যদি মনে করে যে কনটেন্টটি ভুলভাবে সরানো হয়েছে, তবে তা পুনরায় ইনস্টল করতে হবে।

অধ্যাদেশটি আগের আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য আনা হয়েছে, যেখানে নাগরিক সুরক্ষার বিধান অপর্যাপ্ত ছিল।

উদ্বেগ ও বিস্তৃত প্রভাব

সমালোচকরা মনে করেন ‘অশ্লীলতা’ বা ‘অবৈধ সম্পর্ক’-এর মতো অস্পষ্ট পরিভাষা ভবিষ্যতে ইচ্ছামতো প্রয়োগ ও মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

ওয়ারেন্টবিহীন তদন্ত ও সরকারি সংস্থার অতিরিক্ত তদারকি নজরদারির আশঙ্কা বাড়ায়, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাই বিচারিক তত্ত্বাবধান ও স্পষ্ট সংজ্ঞা সংযোজনের আহ্বান জানিয়েছে।

এই অধ্যাদেশ ও নির্দেশিকাগুলোর সমন্বিত লক্ষ্য হলো—উদ্ভাবন, নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতার ভারসাম্যে একটি নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত