leadT1ad

লুভর মিউজিয়ামে বারবার লুটেরাদের হানা, কিন্তু এবারের চুরি কেন আলাদা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ১১
লুভর মিউজিয়াম। ছবি: সংগৃহীত

প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে রোববার (১৯ অক্টোবর) সকালে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে সংঘটিত এক দুঃসাহসিক চুরি আবারও ইতিহাসের আলোচনায়। নেপোলিয়নের আমলের অমূল্য আটটি অলংকার চুরি করে নিয়ে গেছে একদল সশস্ত্র চোর। ট্রাক-মাউন্টেড মই ব্যবহার করে তারা পৌঁছে যায় মিউজিয়ামের দ্বিতীয় তলার ফরাসি রাজমুকুটের রত্নভান্ডার সংরক্ষিত অ্যাপোলোর গ্যালারিতে (গ্যালারি দ’অ্যাপোলো)।

সকাল সাড়ে ৯টায় মিউজিয়াম খোলার মাত্র আধঘণ্টা পরেই এই লুটের ঘটনা ঘটে। এখনো পর্যন্ত চোরদের খোঁজ মেলেনি এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে লুভর আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।

ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির রাজমুকুটটিও চোরেরা নিয়ে গিয়েছিল। তবে পালানোর সময় সেটি ফেলে যায় তারা। পরে মুকুটটি পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লুভর ছিল ফরাসি রাজপরিবারের প্রাসাদ। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে এই প্রাসাদকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। তখনকার রাজতান্ত্রিক ইতিহাসের স্মারকগুলো ছিল লুণ্ঠনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। লুভর মিউজিয়াম জনগণকে যেমন ওই সব ঐতিহ্যবাহী সম্পদ দেখার সুযোগ দেয়, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাজকীয় উত্তরাধিকার সংরক্ষণেরও প্রতিশ্রুতি নেয়।

তবু চোরেরা থেমে থাকেনি। ইতিহাসে একাধিকবার সাফল্যের সঙ্গে লুভর থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম চুরি হয়েছে।

১৯১১: মোনালিসা চুরি

১৯১১ সালের ২১ আগস্ট লুভর থেকে চুরি হয়ে যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা। এই চুরিকে ‘শতাব্দীর সেরা চুরি’ বলে আখ্যায়িত করেন অনেকেই।

তখন কিন্তু ‘মোনালিসা’ আজকের মতো বিশ্বখ্যাত ছিল না। এটি ছিল ভিঞ্চির তুলনামূলক কম পরিচিত কাজগুলোর একটি। ১৭৯৭ সাল থেকে লুভরের ‘সালোঁ ক্যারে’ কক্ষের দেয়ালে ঝুলছিল এই শিল্পকর্ম। অনেকে বলেন, এই চুরিই মোনালিসাকে আজকের কিংবদন্তি খ্যাতি এনে দিয়েছে।

লুভর থেকে ভিঞ্চির পেইন্টিং ‘মোনালিসা’ চুরি করেছিল ২৯ বছর বয়সী ইতালীয় অভিবাসী ভিনসেঞ্জো পেরুগিয়া। লুভরে স্বল্প সময়ের জন্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিল পেরুগিয়া। ২০ আগস্ট সন্ধ্যায় সে তার পুরোনো ইউনিফর্ম পরে সম্পূর্ণ বিনা বাধায় লুভরে প্রবেশ করে।

সারারাত মিউজিয়ামের একটি আলমারিতে (ক্লজেট) লুকিয়ে ছিল পেরুগিয়া। পরদিন সকালে মিউজিয়াম খোলার আগেই পেরুগিয়া আলমারি থেকে বেরিয়ে আসে। দেয়াল থেকে খুব সহজেই মোনালিসা পেইন্টিংটি নামিয়ে সাদা কাপড়ে মুড়ে নেয়। বেরিয়ে আসার সময় পেরুগিয়া দেখে সিঁড়ির দরজা বন্ধ। কিন্তু সন্দেহ করার পরিবর্তে, লুভরের একজন প্লাম্বার পেরুগিয়াকে সহকর্মী ভেবে সিঁড়ির দরজা খুলতে সাহায্য করে।

সেই সময়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। রক্ষণাবেক্ষণ বা ফটোগ্রাফির জন্য প্রায়ই চিত্রকর্মগুলোকে নিজের জায়গা থেকে সরানো হতো। ফলে একদিনেরও বেশি সময় ধরে দা ভিঞ্চির পেইন্টিংটির ‘উধাও’ হয়ে যাওয়াটা কেউ খেয়ালই করেনি।

অবশেষে স্যালন ক্যারেতে আরেক শিল্পী আঁকতে এসে ছবিটি না পেয়ে বিষয়টি লুভরের প্রহরীদের জানালে, তাঁরা তড়িঘড়ি করে পুলিশে খবর দেন। শুরু হয় ব্যাপক অনুসন্ধান ও গণমাধ্যমে তোলপাড়।

প্রথম দিকে পুলিশের হাতে তেমন কোনো সূত্র ছিল না। পূর্বে লুভরের কিছু চুরির সঙ্গে সংযোগ থাকা ‘অ্যাভঁ-গার্দ’ কবি গিয়োম আপোলিনেয়ারকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আপোলিনেয়ার মুক্তি পান। তবে তিনি সন্দেহের আঙুল তোলেন তরুণ পাবলো পিকাসোর (বিখ্যাত চিত্রশিল্পী) দিকে। পিকাসোকেও পরবর্তী সময়ে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পিকাসো অবশ্য মোনালিসা চুরির দায় থেকে মুক্তি পান। তবে তদন্তে জানা যায়, তিনি আগে লুভর থেকে চুরি হওয়া কিছু আইবেরীয় ভাস্কর্য কিনেছিলেন। পরে ঝামেলা এড়াতে পিকাসো সেগুলো লুভরে ফিরিয়ে দেন।

মোনালিসার সম্ভাব্য অবস্থান নিয়ে গুজব ও জল্পনা-কল্পনা বাড়তে থাকে। কিন্তু এই পুরোটা সময় মোনালিসা পেরুগিয়ার প্যারিসের ছোট্ট এক কামরার ঘরে লুকানো ছিল। দুই বছর পর ১৯১৩ সালে পেরুগিয়া ইতালির এক গ্যালারিতে ছবিটি বিক্রি করার চেষ্টা করে। গ্যালারির কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয় এবং ফ্লোরেন্সের এক হোটেল রুম থেকে পেরুগিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯১৪ সালে ছবিটি আবার ফিরে আসে লুভরে। পেরুগিয়া দাবি করে, জাতীয়তাবাদী গর্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে চুরি করেছে, কারণ পেইন্টিংটি ইতালি থেকে লুট করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দা ভিঞ্চি ছবিটি আঁকা ফ্রান্সেই সম্পন্ন করেছিলেন এবং ফরাসি রাজপরিবারের কাছে বিক্রি করেছিলেন।

১৯৪০-এর দশক: লুভর লুট করার নাৎসি প্রচেষ্টা

১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ফ্রান্সে প্রবেশ করলে তীব্র ঝুঁকিতে পড়ে লুভর মিউজিয়াম। কিন্তু তৎকালীন ফ্রান্সের জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক জ্যাক জজার্ড আগেভাগেই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১,৮০০-এর বেশি কাঠের বাক্সে ভরে মোনালিসাসহ লুভরের অমূল্য শিল্পকর্ম সরিয়ে নেন ফরাসি গ্রামীণ অঞ্চলে।

ফলে প্যারিস দখল করে নাৎসিরা যখন লুভরে প্রবেশ করে, তখন মিউজিয়ামটি কার্যত খালিই ছিল। এভাবে ফরাসি সংস্কৃতির এক বিশাল ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।

তবে ফ্রান্স দখলের পর নাৎসিরা বিপুল পরিমাণ ‘ইহুদি শিল্পকর্ম’ লুট করে। পরবর্তী দশকগুলোতে সেই শিল্পকর্মের বেশিরভাগই আবার ফেরত এসেছে ফ্রান্সে। ২০১৮ সালে শিল্পকর্মগুলো আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে লুভর বিশেষ প্রদর্শনী শুরু করে।

১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশক: আরও কিছু চুরি

১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লুভরের মালিকানাধীন পাঁচটি প্রাচীন অলংকার চুরি হয়। এগুলো ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে একটি মিউজিয়াম প্রদর্শনী শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্যারিসে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। গোয়েন্দারা পরে এক মুদি দোকানের ব্যাগে গহনাগুলো উদ্ধার করে এবং চোরাই মাল গ্রহণের জন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

১৯৯০ সালে লুভরের তৃতীয় তলা থেকে পিয়ের অগুস্ত রেনোয়ারের ‘পোর্ট্রেট অব আ সিটেড উওম্যান’ পেইন্টিংয়ের ফ্রেম থেকে কেটে চুরি করা হয়েছিল। একই সময়ে, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ আবিষ্কার করে, কিছু ছোট গহনাও উধাও হয়ে গেছে। ফ্রান্সের জাদুঘর বিভাগের তৎকালীন পরিচালক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে বলেন, ‘এগুলো তেমন মূল্যবান না হলেও বাজারে প্রায়ই দেখা যায়, তাই চুরি নতুন নয়।’ এই ছোট ছোট জিনিসগুলো কখনো উদ্ধার হয়েছে কি না, তা আজও অজানা।

এবারের চুরি কেন আলাদা

এই সপ্তাহের গয়না চুরি আগের সব বড় চুরির তুলনায় আলাদা। আগে যেসব চুরি হয়েছে, তার বেশিরভাগই ছিল চিত্রকর্মকে ঘিরে।

আমেরিকান শিল্প-ইতিহাসবিদ নোয়া চারনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘গয়না চুরির বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ এখানে চুরি হওয়া বস্তুটির নিজস্ব ভৌত মূল্যই অনেক বেশি।’

নোয়া চারনি আরও বলেন, ‘চিত্রকর্মের মূল্য সেটির উপকরণে নয়, বরং তার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয়। একটি ছবি তো আসলে ক্যানভাস আর রঙ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু গয়নাগুলো নিজেদের ধাতু ও রত্নের কারণেই স্বভাবতই অমূল্য। এমনকি যদি সেগুলো টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হয়, তবুও মূল্য অক্ষুণ্ণ থাকে।’

চারনির মতে, ‘চোরেরা সাধারণত গয়নার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত গুরুত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না—তারা কেবল বস্তুগত মূল্যটাই দেখে।’

তাহলে কি এসব গয়না উদ্ধার অসম্ভব?

প্রায় তাই। কারণ গয়না এমন এক বস্তু যা সহজেই ভেঙে, পুনরায় কেটে, বিক্রি করা যায়। ফলে আসল উৎসের কোনো চিহ্নই আর থাকে না। তাই এসব চুরি হওয়া রত্নের হদিস পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

গহনাগুলোকে যদি নতুন করে কাটা হয়, তাহলে কালোবাজারে বিক্রিরও প্রয়োজন হয় না। এই কারণে এগুলো উদ্ধার করা আরও দুঃসাধ্য।

চারনি বলেন, ‘পুলিশের কাছে একমাত্র পথ হচ্ছে, গয়নাগুলোর বাজার মূল্যের থেকে বেশি মূল্যের পুরস্কার ঘোষণা করা। এতে হয়ত চোরেরা সেগুলো ফেরত দিতে পারে।’

এমন প্রণোদনা দিলে চোরেরা হয়তো পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে কিছুটা সময় নেবে, আর সেই সুযোগে তদন্তকারীরা এগোতে পারবে।

চারনি সতর্ক করে বলেন, ‘নয়তো খুব একটা আশা নেই। সম্ভবত চুরি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গয়নাগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।’

• কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক্সপ্লেইনারের সংক্ষেপিত অনুবাদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত