leadT1ad

ঢাকার রাজপথ থেকে বিশ্বরাজনীতি, চারদিকে কেন রহস্যময় বিদেশি এজেন্টের ছায়া

বর্তমান বিশ্বে বিদেশি প্রভাব ও গুপ্তচরবৃত্তির প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এনায়েত করিম চৌধুরীর গ্রেপ্তার ঘটনাটি আবারও সামনে এনেছে এই বিতর্ককে। ঢাকার মিন্টো রোডে গাড়ি থামানো থেকে শুরু হওয়া নাটকীয় এই ঘটনা এখন আলোচনায় ছড়িয়ে পড়েছে আদালত, রাজনীতি ও কূটনীতির টেবিল পর্যন্ত। মূল প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—বিদেশি এজেন্ট আসলে কে?

তুফায়েল আহমদ
স্ট্রিম গ্রাফিক

রাজধানী ঢাকার মিন্টো রোডের এক শান্ত সকাল; এই সড়কটি দেশের ক্ষমতাধরদের চলাচলের জন্য পরিচিত। পুলিশ ‘সন্দেহজনক গতিবিধি’ অভিযোগ করে একটি গাড়ি থামাল। গাড়ির ভেতরে থাকা ৫৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীর জন্য এটি মোটেও সিনেমার কোনো দৃশ্য ছিল না। বরং ছিল এক বাস্তব নাটকের শুরু, যা তাকে পরে জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। রাজপথের এই ঘটনাটি দ্রুতই বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার, জেল হেফাজত ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে রূপ নেয়।

এনায়েত করিম চৌধুরীর গ্রেপ্তার নতুন করে সার্বভৌম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি প্রভাবের ধোঁয়াশা ও সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। চৌধুরীকে ঢাকার একটি আদালতে হাজির করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্তের তথ্য পেয়েছে তারা। যদিও চৌধুরীর মামলার নির্দিষ্ট বিবরণ এখনো তদন্তাধীন। তবে এই গ্রেপ্তার বৈশ্বিক রাজনীতির এক জটিল খেলার বিজ্ঞাপনের মতো আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।

‘বিদেশি সংস্থার এজেন্ট’ পরিভাষাটি আমাদের পরিচিত গুপ্তচর বা স্পাইয়ের ধারণার চেয়েও ব্যাপক। এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একটি দেশের জনমত বা নীতিকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে জনসংযোগ, লবিং ও তহবিল সংগ্রহের কাজে অংশ নেয়।

বিদেশি সংস্থার এজেন্ট আসলে কে

‘বিদেশি সংস্থার এজেন্ট’ শব্দটি শুনলেই জেমস বন্ড সদৃশ কোট-টাই পরা চরিত্রের কথাই মনে পড়ে। থ্রিলার কিংবা এস্পিওনাজ (স্পাই) সিনেমার চরিত্রের নায়কদের কথা মনে পড়ে। যদিও গুপ্তচরবৃত্তি বিদেশি সংস্থার এজেন্টদের একটা মৌলিক কাজ। কিন্তু এর বাইরেও একটি দেশে প্রভাব খাটানোর ব্যাপারটা অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং সুদূরপ্রসারী।

‘বিদেশি সংস্থার এজেন্ট’ হলো এমন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা, যে অন্য কোনো দেশের অনুরোধে বা নির্দেশনায় বা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এই বিদেশি শক্তি হতে পারে কোনো দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, কোম্পানি বা সংস্থা কিংবা একক ব্যক্তিও।

‘বিদেশি সংস্থার এজেন্ট’ পরিভাষাটি আমাদের পরিচিত গুপ্তচর বা স্পাইয়ের ধারণার চেয়েও ব্যাপক। এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একটি দেশের জনমত বা নীতিকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে জনসংযোগ, লবিং ও তহবিল সংগ্রহের কাজে অংশ নেয়।

বাংলাদেশের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ অনুযায়ী, ‘বিদেশি এজেন্ট’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে যিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজে বিদেশি শক্তির দ্বারা নিযুক্ত হয়েছেন বা নিযুক্ত হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হয়। এই আইন অনুসারে, কোনো বিদেশি এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

যদিও অনেক দেশেই এই ধরনের শব্দবন্ধ প্রায়ই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে এমন অভিযোগও আছে।

বিদেশি শক্তিগুলো নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।

প্রভাব বিস্তারের পদ্ধতি: প্রকাশ্য প্রচারণা থেকে গোপন অভিযান

একটি দেশে বিদেশি প্রভাব বিস্তার করার প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। প্রকাশ্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে নিবন্ধিত লবিস্ট, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের দেশের স্বার্থের পক্ষে প্রচারণা চালায়। বিদেশি সরকার ও তাদের প্রতিনিধিরা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে এবং সফট পাওয়ার গড়ে তুলতে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি, সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এবং গণমাধ্যম প্রচারণায় অংশ নেন। তবে প্রকাশ্য নয় বরং গোপন প্রভাবগুলোই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ।

ডিজিটাল যুগ বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বিভিন্ন ট্রল ফার্ম ও মিডিয়া আধুনিক যুগে তথ্য যুদ্ধের ভয়ংকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রল ফার্ম বলতে বোঝায় যেসব গ্রুপ বা দল অর্থের বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছড়ানোর জন্য কাজ করে। তারা শুধু জনমত প্রভাবিত করে না, বরং মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সমাজে বিভেদ তৈরি করে। যা দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। উদাহরণ হিসেবে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের কিছু ‘মূলধারার গণমাধ্যম’ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেজ ও আইডি থেকে মিলিতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এসব অপপ্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করা।

অন্যদিকে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার এমন হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছিল।

বিদেশি শক্তিগুলো নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। তাদের এই হস্তক্ষেপের একটি পরীক্ষিত কৌশল হলো নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা প্রতিবাদ-আন্দোলনকে গোপনে বা প্রকাশ্যে আর্থিক কিংবা সরঞ্জামগত (লজিস্টিক) সহায়তা প্রদান করা। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয় বরং ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

প্রচলিত গুপ্তচরের ধারণাকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে এমন উদাহরণের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি এবং ইসরায়েলের মোসাদ সবচেয়ে পরিচিত। কেজিবি কেবল অর্থের বিনিময়ে গুপ্তচর নিয়োগ করত না বরং আদর্শগত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য দেশীয় এজেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৪৮ সালে ইতালির নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টিকে পরাজিত করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও প্রচারণাগত সহায়তা দিয়েছিল। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে একইভাবে সমর্থন দিত। চিলি, নিকারাগুয়া ও গুয়াতেমালার মতো দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থবিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থানে মদদ দিয়েছে এবং বিরোধী পক্ষকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

প্রভাব বিস্তারের জন্য সোর্স নিয়োগ, সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সেই তথ্য ব্যবহার করার মতো ক্লাসিক গোয়েন্দা কার্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত আছে।

প্রচলিত গুপ্তচরের ধারণাকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে এমন উদাহরণের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি এবং ইসরায়েলের মোসাদ সবচেয়ে পরিচিত। কেজিবি কেবল অর্থের বিনিময়ে গুপ্তচর নিয়োগ করত না বরং আদর্শগত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য দেশীয় এজেন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ বা সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের অনেকেই নিজেদের গুপ্তচর ভাবতেন না, বরং মনে করতেন তাঁরা একটি মহৎ আদর্শের পক্ষে কাজ করছেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই দেশের নীতি ও জনমতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে প্রভাবিত করে ‘প্রভাবক এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।

অন্য দিকে, মোসাদও দেশীয় এজেন্ট তৈরিতে ভিন্নধর্মী কৌশলের জন্য পরিচিত। তাদের একটি বিখ্যাত পদ্ধতি হলো ‘সায়ানিম’ নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের বেশির ভাগই ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবক, যারা সরাসরি গুপ্তচরবৃত্তিতে অংশ নেয় না। বরং বিভিন্ন দেশে মোসাদের এজেন্টদের লজিস্টিক সহায়তা—যেমন বাসা ভাড়া করে দেওয়া, গাড়ি সরবরাহ করা বা আর্থিক লেনদেনে সাহায্য করে থাকে। আনুগত্যের জায়গা থেকে করা এই ছোট ছোট কাজগুলোই মোসাদের গোপন অভিযানগুলোকে সফল করতে বড় ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বিদেশি নাগরিকদেরও তারা টার্গেট করে।

অর্থনৈতিক শক্তি প্রভাব বিস্তারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। একটি দেশের নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য অনুকূল বাণিজ্য চুক্তি, বিনিয়োগ বা উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হতে পারে। আবার নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার হুমকিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপ এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা তীব্রভাবে দাবি করেছেন যে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল একটি ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: অভিযোগের দীর্ঘ ইতিহাস

দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান এবং উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থের এক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র।

বছরের পর বছর ধরে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রভাবের ক্রমাগত বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, ‘র’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দীর্ঘস্থায়ী সরকারকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমালোচকদের অভিযোগ, এই সমর্থনের লক্ষ্য ছিল ঢাকায় একটি ভারতপন্থী সরকার নিশ্চিত করা এবং এই অঞ্চলে নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থ এগিয়ে নেওয়া।

সম্প্রতি বিদেশি হস্তক্ষেপের আখ্যান একটি নতুন মোড় নিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা তীব্রভাবে দাবি করেছেন যে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল একটি ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’। হাসিনা তাঁর ক্ষমতাচ্যুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করেছেন।

এর বাইরেও বিভিন্ন বিনোদনকর্মী, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, ইউটিউবারদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ উঠেছে বিদেশি শক্তির হয়ে কাজ করার। যদিও চাক্ষুষ প্রমাণ সামনে আসেনি, তবে বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে অনেকের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের ধোঁয়াশা একেবারেই কাটেনি। বরং দিনকে দিন শুধু বেড়েই চলেছে।

এমনকি বাংলাদেশের অনেক স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যম, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে প্রায়শই এই অভিযোগ তোলা হয় যে তাঁরা নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর ন্যারেটিভ প্রচারণার মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতিতে ওই শক্তির প্রভাব বজায় রাখতে সফট পাওয়ারের ভূমিকা পালন করেন। তবে এই ধরনের অভিযোগ অনেক সময় কেবল ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিদেশি এজেন্টের ছায়া

বিশ ও একুশ শতকের ইতিহাসজুড়ে শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য বারবার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই বিশ্বজুড়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এবং সরকার উৎখাত করতে ব্যাপক গোপন অভিযানে লিপ্ত ছিল।

তবে বিদেশি প্রভাবের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বারবার সার্বভৌম দেশগুলোর রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই আজকের দিনে হস্তক্ষেপের অভিযোগগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়, বাড়ায় সংশয়।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে লাতিন আমেরিকায় কমিউনিজম মোকাবিলা করার লক্ষ্যে অসংখ্য প্রকাশ্যে ও গোপন অভিযান চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে গুয়াতেমালায় ১৯৫৪ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থান, যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জ্যাকোবো আরবেঞ্জকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৭৩ সালে চিলিতে মার্কিন-সমর্থিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে সালভাদর আলিয়েন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, এই ঘটনার মধ্য দিয়েই দেশটিতে অগাস্তো পিনোশের নৃশংস একনায়কতন্ত্রের শুরু হয়েছিল।

উপনিবেশ-পরবর্তী আফ্রিকায়, প্রভাব ও সম্পদের লড়াই একই ধরনের হস্তক্ষেপের জন্ম দেয়। কঙ্গোর প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বার হত্যাকাণ্ডে বেলজিয়াম এবং সিআইএ উভয়েই যুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জায়ারের (বর্তমানে ডিআরসি) মতো দেশে স্বৈরশাসক মোবুতু সেসে সেকোকে কেবল এই কারণে সমর্থন করেছিল যে তারা কমিউনিস্ট-বিরোধী। স্বৈরশাসকদের সমর্থন দেওয়া এবং জনপ্রিয় নেতাদের দুর্বল করার এই ইতিহাস মহাদেশজুড়ে গভীর অবিশ্বাসের এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের কার্যক্রমের পদ্ধতি হয়তো বদলেছে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে। চীনের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের জন্য তার অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার এবং ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতিতে’ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বারবার।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রভাবের বাইরেও বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে নিজেদের মতবাদ অন্য দেশে চাপানোর চেষ্টার ক্ষেত্রেও ‘এজেন্ট’ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

কেন বিদেশি সংস্থার এজেন্ট সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে

বিদেশি এজেন্টদের উপস্থিতি ও কার্যকলাপ একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে। এমন এজেন্টদের মূল উদ্দেশ্যই হলো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বাইরের কোনো শক্তির স্বার্থে প্রভাবিত করা। এই এজেন্টদের চূড়ান্ত আনুগত্য থাকে তাদের নিয়োগকারী বিদেশি শক্তির প্রতি। এর ফলে তারা দেশের নীতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং জনগণের স্বাধীন ইচ্ছাকে বিদেশি শক্তির এজেন্ডা দিয়ে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করে। আজকের পরস্পর সম্পর্কিত অর্থনীতির বিশ্বে বড় দেশগুলো ছোট দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে, এটা স্বাভাবিক। তবে বৈধ কূটনৈতিক সম্পর্ক আর জনগণের ইচ্ছাকে পদদলিত করে গোপনে দেশের ভেতর হস্তক্ষেপ করার মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিদেশি এজেন্টরা ঠিক এই দ্বিতীয় ক্ষতিকর কাজটিই করে থাকে, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হলো এই জটিল বাহ্যিক চাপগুলোকে সামাল দেওয়া। এনায়েত করিম চৌধুরীর গ্রেপ্তারের ফলাফল যাই হোক না কেন, বাংলাদেশকে ভাবতে হবে কী করে বিদেশি প্রভাবের ছায়া দীর্ঘ এবং বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে মুক্ত রাখা যায়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ যখন তার পথ নির্ধারণ করছে, তখন এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে অযাচিত বিদেশি প্রভাব থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেই প্রশ্নটি আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে। এর জন্য যেমন প্রয়োজন শক্তিশালী কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স ও আইনি কাঠামো, একইসঙ্গে প্রয়োজন সচেতন নাগরিক সমাজ, যারা প্রকৃত রাজনৈতিক আলোচনা এবং বাইরে থেকে তৈরি করা প্রোপাগান্ডার মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম।

তথ্যসূত্র: এসিই ইলেকটোরাল নলেজ নেটওয়ার্ক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস, কাউন্সিল অব ইউরোপ, বিবিসি, পলিটিকো ও আল-জাজিরা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত