বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান তুরস্কের ‘এশিয়া অ্যানিউ’ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন গড়তে সহায়ক।
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকায় আজ (৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার) চতুর্থ বাংলাদেশ-তুরস্ক ফরেইন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বা পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকটি তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিনসি গতকাল সোমবার সকালে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম।
এই বৈঠক নিঃসন্দেহে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আলোচনায় মূলত রাজনৈতিক সংলাপ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি দুই দেশের মধ্যে এমন ধরনের চতুর্থ বৈঠক এবং পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম বৈঠক।
সফরের প্রথম দিনে (সোমবার) একিনচি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। আজকের বৈঠকের পর তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই দেশ ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ জোরদারে আগ্রহী। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে ভিত্তি করে এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান তুরস্কের ‘এশিয়া অ্যানিউ’ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন গড়তে সহায়ক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের শিকড় মধ্যযুগে প্রোথিত— যখন বঙ্গীয় ব্যবসায়ী ও পণ্ডিতরা সামুদ্রিক পথে অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আধুনিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর একটি। তুরস্ক তখন মানবিক সহায়তাও পাঠায়।
দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা, ইসলামী ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে (যেমন ওআইসি) পারস্পরিক সমর্থন সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উচ্চপর্যায়ের সফর এই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল ২০১০ সালে এবং প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ২০১৭ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। এসব সফরে রোহিঙ্গা সংকটসহ মানবিক ইস্যুতে ঐক্য ও সংহতির বার্তা উঠে আসে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বর্তমানে দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশেই দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে এবং এফওসি বৈঠকের মাধ্যমে নিয়মিত পরামর্শ চলছে। উভয় দেশ বহুপাক্ষিক পরিসরেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ওআইসি’র রোহিঙ্গা বিষয়ক যোগাযোগ গ্রুপের সহ-সভাপতি এবং ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে একযোগে কাজ করছে।
তুরস্ক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আঙ্কারা বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা প্রশাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে।
আজকের এফওসি বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ ও সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধীরে ধীরে বাড়ছে, যদিও এখনো সম্ভাবনার তুলনায় কম। বাংলাদেশ তুরস্ককে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের সেতু হিসেবে দেখে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪৯৫.৮১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের মধ্যে প্রস্তুত তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাটজাত দ্রব্য প্রধান। অপরদিকে, তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ ৩৮০.৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য ও যানবাহন উল্লেখযোগ্য।
২০২৪ সালে তুরস্কের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৭.৯৮ মিলিয়ন ডলারে, যা মূলত মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ফল। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৬৭% বেশি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭৪ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে মোট ৬৩৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
প্রধান উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-তুরস্ক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং টেক্সটাইল ও জাহাজ নির্মাণ খাতে যৌথ বিনিয়োগ। আজকের এফওসি বৈঠকে বিনিয়োগ সহায়তা ও যৌথ প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হবে। তুরস্কের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পোশাক ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা
২০২১ সালের পর থেকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে তুরস্কের তৈরি অস্ত্রের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন বাইকার (ড্রোন) ও রকেটসান (মিসাইল)—বাংলাদেশকে উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থা সরবরাহ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন ও সাঁজোয়া যান।
২০২৫ সালের জুনে দুই দেশ বাংলাদেশে যৌথ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেয়, যেখানে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে আত্মনির্ভরতা বাড়াবে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প বিভাগের প্রধান হালুক গোরগুনের ঢাকা সফর এই সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করে। এ সময় বাংলাদেশ সেনাপ্রধান ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানান।
এই সহযোগিতা বাংলাদেশের সেনা আধুনিকায়ন কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একই সঙ্গে এটি তুরস্ককে দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান শক্ত করার সুযোগ দিচ্ছে।
সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও মানবিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মানুষে-মানুষে সম্পর্ক প্রাণবন্ত ও আন্তরিক। প্রতিবছর তুরস্কে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। এদের অনেকে ইউনুস এমরে ইনস্টিটিউট ও তুরস্কের সহযোগিতা সংস্থা টিআইকেএ-র বৃত্তিতে পড়াশোনা করছে।
দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ও সক্রিয়। তুর্কি টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলো বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দুই দেশ যৌথভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে, যেখানে ঐতিহাসিক বন্ধন ও অভিন্ন ঐতিহ্য উদযাপিত হয়।
মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আমফান ও পরবর্তী বন্যায় তুরস্ক জরুরি সহায়তা পাঠায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তুরস্কের অব্যাহত সমর্থন বাংলাদেশের কাছে প্রশংসিত। ২০২৫ সালে টিআইকেএ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণে অর্থায়ন করেছে।
সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করেনি; বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততা আরও বাড়িয়েছে। তুরস্ক বর্তমানে বাংলাদেশকে এক অস্থির অঞ্চলে স্থিতিশীল অংশীদার হিসেবে দেখে।
সাম্প্রতিক এফওসি বৈঠকে দুই দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে যৌথ উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে—যেমন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের রূপান্তর এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার অনিশ্চয়তা। তবুও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক আজ এক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ নিচ্ছে, যেখানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও বাস্তবমুখী স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর নতুন চুক্তি ও যৌথ উদ্যোগের পথ প্রশস্ত করতে পারে, যা দুই দেশের পারস্পরিক সমৃদ্ধিকে আরও সুদৃঢ় করবে।
আজকের বৈঠকের মূল আলোচ্যসূচি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করা হবে। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা জোরদার করাও আলোচ্যসূচির শীর্ষে রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। খসড়া আলোচূসূচিতে রয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, রাজনৈতিক সংলাপ, উন্নয়ন ও কৃষি সহায়তা, স্বাস্থ্য, অভিবাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ সম্প্রসারণ।
দুই দেশ নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করবে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায়। অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান।
আঞ্চলিক আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি, বিশেষত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, গুরুত্ব পাবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডি-৮, ওআইসি ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ফোরামে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থন জোরদারের বিষয়েও আলোচনা হবে।
ঢাকায় আজ (৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার) চতুর্থ বাংলাদেশ-তুরস্ক ফরেইন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বা পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকটি তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বেরিস একিনসি গতকাল সোমবার সকালে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম।
এই বৈঠক নিঃসন্দেহে দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আলোচনায় মূলত রাজনৈতিক সংলাপ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি দুই দেশের মধ্যে এমন ধরনের চতুর্থ বৈঠক এবং পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম বৈঠক।
সফরের প্রথম দিনে (সোমবার) একিনচি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। আজকের বৈঠকের পর তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুই দেশ ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ জোরদারে আগ্রহী। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনকে ভিত্তি করে এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান তুরস্কের ‘এশিয়া অ্যানিউ’ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধন গড়তে সহায়ক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের শিকড় মধ্যযুগে প্রোথিত— যখন বঙ্গীয় ব্যবসায়ী ও পণ্ডিতরা সামুদ্রিক পথে অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আধুনিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর একটি। তুরস্ক তখন মানবিক সহায়তাও পাঠায়।
দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা, ইসলামী ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে (যেমন ওআইসি) পারস্পরিক সমর্থন সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উচ্চপর্যায়ের সফর এই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল ২০১০ সালে এবং প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ২০১৭ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। এসব সফরে রোহিঙ্গা সংকটসহ মানবিক ইস্যুতে ঐক্য ও সংহতির বার্তা উঠে আসে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বর্তমানে দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশেই দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে এবং এফওসি বৈঠকের মাধ্যমে নিয়মিত পরামর্শ চলছে। উভয় দেশ বহুপাক্ষিক পরিসরেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ওআইসি’র রোহিঙ্গা বিষয়ক যোগাযোগ গ্রুপের সহ-সভাপতি এবং ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে একযোগে কাজ করছে।
তুরস্ক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আঙ্কারা বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা প্রশাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় কারিগরি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে।
আজকের এফওসি বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ ও সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ধীরে ধীরে বাড়ছে, যদিও এখনো সম্ভাবনার তুলনায় কম। বাংলাদেশ তুরস্ককে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের সেতু হিসেবে দেখে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪৯৫.৮১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের মধ্যে প্রস্তুত তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাটজাত দ্রব্য প্রধান। অপরদিকে, তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ ৩৮০.৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য ও যানবাহন উল্লেখযোগ্য।
২০২৪ সালে তুরস্কের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৭.৯৮ মিলিয়ন ডলারে, যা মূলত মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ফল। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৬৭% বেশি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭৪ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে মোট ৬৩৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
প্রধান উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-তুরস্ক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং টেক্সটাইল ও জাহাজ নির্মাণ খাতে যৌথ বিনিয়োগ। আজকের এফওসি বৈঠকে বিনিয়োগ সহায়তা ও যৌথ প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হবে। তুরস্কের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পোশাক ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা
২০২১ সালের পর থেকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে তুরস্কের তৈরি অস্ত্রের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন বাইকার (ড্রোন) ও রকেটসান (মিসাইল)—বাংলাদেশকে উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থা সরবরাহ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন ও সাঁজোয়া যান।
২০২৫ সালের জুনে দুই দেশ বাংলাদেশে যৌথ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেয়, যেখানে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে আত্মনির্ভরতা বাড়াবে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প বিভাগের প্রধান হালুক গোরগুনের ঢাকা সফর এই সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করে। এ সময় বাংলাদেশ সেনাপ্রধান ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানান।
এই সহযোগিতা বাংলাদেশের সেনা আধুনিকায়ন কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একই সঙ্গে এটি তুরস্ককে দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান শক্ত করার সুযোগ দিচ্ছে।
সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও মানবিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মানুষে-মানুষে সম্পর্ক প্রাণবন্ত ও আন্তরিক। প্রতিবছর তুরস্কে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। এদের অনেকে ইউনুস এমরে ইনস্টিটিউট ও তুরস্কের সহযোগিতা সংস্থা টিআইকেএ-র বৃত্তিতে পড়াশোনা করছে।
দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ও সক্রিয়। তুর্কি টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলো বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দুই দেশ যৌথভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে, যেখানে ঐতিহাসিক বন্ধন ও অভিন্ন ঐতিহ্য উদযাপিত হয়।
মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আমফান ও পরবর্তী বন্যায় তুরস্ক জরুরি সহায়তা পাঠায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তুরস্কের অব্যাহত সমর্থন বাংলাদেশের কাছে প্রশংসিত। ২০২৫ সালে টিআইকেএ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণে অর্থায়ন করেছে।
সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করেনি; বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততা আরও বাড়িয়েছে। তুরস্ক বর্তমানে বাংলাদেশকে এক অস্থির অঞ্চলে স্থিতিশীল অংশীদার হিসেবে দেখে।
সাম্প্রতিক এফওসি বৈঠকে দুই দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে যৌথ উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে—যেমন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের রূপান্তর এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার অনিশ্চয়তা। তবুও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক আজ এক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ নিচ্ছে, যেখানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও বাস্তবমুখী স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর নতুন চুক্তি ও যৌথ উদ্যোগের পথ প্রশস্ত করতে পারে, যা দুই দেশের পারস্পরিক সমৃদ্ধিকে আরও সুদৃঢ় করবে।
আজকের বৈঠকের মূল আলোচ্যসূচি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈঠকে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করা হবে। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা জোরদার করাও আলোচ্যসূচির শীর্ষে রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে। খসড়া আলোচূসূচিতে রয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, রাজনৈতিক সংলাপ, উন্নয়ন ও কৃষি সহায়তা, স্বাস্থ্য, অভিবাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ সম্প্রসারণ।
দুই দেশ নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যও নির্ধারণ করবে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায়। অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান।
আঞ্চলিক আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি, বিশেষত গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, গুরুত্ব পাবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডি-৮, ওআইসি ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ফোরামে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থন জোরদারের বিষয়েও আলোচনা হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগেই চীন তাদের প্রোটোটাইপ ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের অস্ত্র প্রতিযোগিতার এমন একটি নতুন ধাপ দেখাচ্ছে, যেখানে নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা পারমাণবিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
১৯ ঘণ্টা আগেবৈশ্বিক চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এখানে ক্যানসার কেবল বাড়ছেই না, বরং এক নীরব মহামারির মতো কেড়ে নিচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে নতুন শনাক্ত হওয়া প্রতি তিনজন ক্যানসার রোগীর মধ্যে দুজনেরই মৃত্যু হচ্ছে।
১ দিন আগেপাকিস্তান বহু দশক ধরে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করে আসছে। আর আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন একে আরও সহজ করেছে।
২ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার দুই বছরের যুদ্ধ শেষ করতে ২০ দফার একটি প্রস্তাব ঘোষণা করেন গত ২৯ সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো— হামাসের হাতে আটক সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করা, যুদ্ধবিরতি এবং গাজার পুনর্গঠন ও প্রশাসনের ভিত্তি তৈরি করা।
২ দিন আগে