leadT1ad

চীনের ‘গোল্ডেন ডোম’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি শঙ্কিত

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১১
স্ট্রিম গ্রাফিক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগেই চীন তাদের প্রোটোটাইপ ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের অস্ত্র প্রতিযোগিতার এমন একটি নতুন ধাপ দেখাচ্ছে, যেখানে নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা পারমাণবিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

গত মাসে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ‘গোল্ডেন ডোম’-স্টাইলের বৈশ্বিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি কার্যকর প্রোটোটাইপ চালু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগেই তারা তা করতে সক্ষম হয়। এতে কৌশলগত প্রতিরক্ষায় দুই পরাশক্তির প্রযুক্তিগত ব্যবধান আরও স্পষ্ট হয়েছে।

নানজিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার লি জুদং এর নেতৃত্বে পিএলএ একটি ‘ডিস্ট্রিবিউটেড আর্লি ওয়ার্নিং ডিটেকশন বিগ ডেটা প্ল্যাটফর্ম’ স্থাপন করেছে। এটি একইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।

মহাকাশ, বিমান, সমুদ্র ও স্থলভিত্তিক সেন্সর ব্যবহার করে সিস্টেমটি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের বিচ্ছিন্ন তথ্য সংহত করে। এটি ওয়ারহেড ও নকল হেড আলাদা করতে পারে এবং উন্নত প্রোটোকল, যেমন কুইক ইউডিপি ইন্টারনেট কানেকশন (কিউইউআইসি) ব্যবহার করে নিরাপদ সামরিক নেটওয়ার্কে তথ্য প্রেরণ করে।

গবেষকরা বলছেন, এই প্ল্যাটফর্মটি প্রাথমিক সতর্কতার তথ্য একত্রিত করে পিএলএকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি একীভূতভাবে বুঝতে সহায়তা করে।

এর বিপরীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন ডোম, যা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মে মাসে উন্মোচন করেছিলেন, এখনো স্থির স্থাপত্য কাঠামো পায়নি। মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার সমস্যাও উল্লেখ করছেন।

চীনের দ্রুত গোল্ডেন ডোম-স্টাইলের প্রতিরক্ষা স্থাপন মহাকাশ প্রতিরক্ষা বাড়ানো এবং সামরিক সমতার লক্ষ্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই ব্যয়বহুল এবং ‘অপ্রমাণিত প্রতিরক্ষা ধারণা’-য় বিনিয়োগ করা হয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

জ্যাকব মেজি ২০২৪-এর আগস্টে আটলান্টিক কাউন্সিল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, চীনের কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের মিলিত প্রতিফলন।

মেজি বলেন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার (বিএমডি) বিকাশ ঘটলে চীনের ব্যালিস্টিক ও অ্যান্টি-স্যাটেলাইট (এএসএটি) প্রোগ্রামকে শক্তিশালী করবে। এটি চীনের নেতৃত্ব, কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল, পারমাণবিক বাহিনী ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে মার্কিন আগাম হামলা থেকে রক্ষা করবে। একই সঙ্গে ভারতীয় উন্নত মিসাইল ফোর্সের বিরুদ্ধে সক্ষমতা বাড়াবে। সেইসঙ্গে প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিএমডির সঙ্গে ব্যবধানও কমিয়ে আনবে।

জ্যাকব মেজি বলেন, চীনের সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্ভাব্য ‘লঞ্চ-অন-ওয়ার্নিং’ অবস্থাকে সমর্থন করে। এটি কৌশলগত সহনশীলতা বাড়ায়, প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা জটিল করে এবং সংকট স্থিতিশীলতা বাড়ায়।

হসিয়াও-হুয়াং শু ২০২১ সালে ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি রিসার্চ (আইএনডিএসআর)-এর জন্য একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, চীন কাইনেটিক হিট-টু-কিল প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। এছাড়া দীর্ঘ-পরিসরের রাডারের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত রেঞ্জে কাজ করতে সক্ষম।

শু বলেন, এই ক্ষমতা চীনের জন্য এশিয়ায় মার্কিন মধ্য-পরিসরের স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে প্রভাব তৈরি করে এবং ভারতের দ্রুত এগিয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি নিবারণ করতে সাহায্য করে।

তবে তিনি বলেন, চীনের বিএমডি সিস্টেম এখনও মূলত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও অবকাঠামো রক্ষা করতে সীমাবদ্ধ। যেমন বেইজিং, সাংহাই, বোহাই সি ইকোনমিক জোন ও থ্রি গর্জেস ড্যাম।

এই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, চীন একটি প্রোটোটাইপ প্রদর্শন করে ফেলেছে, যখন মার্কিন গোল্ডেন ডোম এখনও ধারণার স্তরে রয়ে গেছে।

মার্কিন গোল্ডেন ডোমের অনেক বিবরণ শ্রেণিবদ্ধ। গত আগস্টে টাইম রিপোর্ট করেছে, এটি চার-স্তরযুক্ত আর্কিটেকচারের সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম। এতে মহাকাশ-ভিত্তিক সেন্সর ও ইন্টারসেপ্টর এবং তিনটি স্থলভিত্তিক স্তর অন্তর্ভুক্ত।

রিপোর্ট অনুযায়ী, মহাকাশ স্তর প্রাথমিক সতর্কতা ও ট্র্যাকিংয়ের কাজ করে। উপরের স্থল স্তরে আছে নেক্সট জেনারেশন ইন্টারসেপ্টরস (এনজিআই), টার্মিনাল হাই অলটিচিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) এবং এয়েজিস সিস্টেম।

এর নিচে রয়েছে সীমিত এলাকা প্রতিরক্ষা স্তর, যেখানে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, উন্নত রাডার এবং একটি নতুন ‘কমন’ লঞ্চার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমে একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষেত্র ক্যালিফোর্নিয়া ও আলাস্কার গ্রাউন্ড-বেজড মিডকোর্স ডিফেন্স (জিএমডি) সাইটগুলোকে সম্পূরক হিসেবে সহায়তা করবে।

তবে গোল্ডেন ডোমের সক্ষমতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এ রামি স্কিব্বা উল্লেখ করেন, সমালোচকরা বলছেন সিস্টেমটি অস্পষ্ট, অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কৌশলগতভাবে অস্থিতিশীল।

সে দেশের রিপোর্টে ডেভিড রাইট বলেন, ‘ফ্লাই বিফোর ইউ বাই’ নিরাপত্তা বাদ দিয়ে গোল্ডেন ডোম বিপুল অপ্রমাণিত প্রযুক্তিতে কোটি কোটি ডলার ঝুঁকিতে ফেলে। তিনি সতর্ক করেন, পর্যাপ্ত তদারকি নেই এবং বিশেষ করে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম)-এর বিরুদ্ধে ইন্টারসেপ্টর প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়, যেখানে নকল হেড ও চাফ ব্যবহার করা হয়।

রামি স্কিব্বা লরা গ্রেগোকে উদ্ধৃত করে বলেন, গোল্ডেন ডোম বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ প্রযুক্তি নয়, বরং অর্থনীতি। স্কিব্বা বলেন, আইসিবিএম তৈরি করা যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় অনেক সস্তা।

আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি গত ফেব্রুয়ারিতে সতর্ক করে বলেছিল, ১০টি আইসিবিএম ধ্বংস করতে ১৬ হাজার ইন্টারসেপ্টরের প্রয়োজন। ২০২৪ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ (ডিওডি) জানিয়েছিল, চীনের কাছে ৪০০টি ইন্টারসেপ্টর রয়েছে। তবে চীনেরও একই সমস্যা হতে পারে, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪০০টি মিনুটম্যান থ্রি আইসিবিএম রয়েছে।

স্কিব্বা যোগ করেন, গোল্ডেন ডোমের লো আর্থ অরবিট (এলইও) স্যাটেলাইটগুলো ব্যয়বহুল প্রতিস্থাপন ছাড়া অকেজো হয়ে যাবে। এতে খরচ ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে। গ্রেগো সতর্ক করেন, একটি স্যাটেলাইটের ব্যর্থতা একটি পারমাণবিক হেডকে বাধাহীনভাবে ঢুকে যেতে দিতে পারে।

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার বাইরে রাজনৈতিক প্রভাবও বড়। বিশেষজ্ঞরা আর্কিটেকচার নিয়ে বিতর্ক করলেও মূল সমস্যা হলো প্রতিপক্ষের ধারণা। দুই পক্ষই একে অপরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে।

তং ঝাও তার ২০২০ সালের জুনে প্রকাশিত বই ‘ন্যারোয়িং দ্য ইউএস-চায়না গ্যাপ অন মিসাইল ডিফেন্স: হাউ টু হেল্প ফোরস্টল অ্যা নিউক্লিয়ার আর্মস রেস’-এ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি গভীর অনিশ্চয়তা ও পারস্পরিক সন্দেহ দিয়ে প্রভাবিত।

ঝাওয়ের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘দুবৃত্ত রাষ্ট্র’ যেমন উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে টার্গেট করে, চীনকে নয়। কিন্তু চীনের কাছে এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। চীন মনে করে মার্কিন পরিকল্পনা ক্রমশ তার পারমাণবিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করতে চাইছে।

ঝাও বলেন, চীনের বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তিগত ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগকে প্রায়শই এক করে দেখেন। তারা সতর্ক করে বলেন, চীনের কাছে থাড সিস্টেমের মতো মার্কিন স্থাপনাগুলো কেবল পারমাণবিক নয়, সামরিক ও আঞ্চলিক প্রভাবকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অন্যদিকে, ঝাও উল্লেখ করেন, মার্কিন বিশ্লেষকরা মনে করেন চীন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা হুমকি অতিরঞ্জিত করে দেখায়, যাতে পারমাণবিক আধুনিকীকরণকে যুক্তিসঙ্গত করা যায়। এর ফলে দুই পক্ষই নিরাপত্তা-দ্বন্দ্বের চক্রে আটকে যায়।

শেষ পর্যন্ত, প্রতিদ্বন্দ্বী গোল্ডেন ডোম তৈরি করার দৌড় কেবল প্রতিরক্ষা নিখুঁত করার জন্য নয়। এটি এমন একটি বিপজ্জনক চক্রকে উদ্দীপিত করছে, যেখানে নিরাপত্তার জন্য চেষ্টা পারমাণবিক হুমকিকে আরও গভীর করে তোলে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত