leadT1ad

পাকিস্তানে যেভাবে গড়ে উঠছে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ

পাকিস্তান বহু দশক ধরে নাগরিকদের ওপর নজরদারি করে আসছে। আর আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন একে আরও সহজ করেছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৩৯
স্ট্রিম গ্রাফিক

উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তান তার পুরোনো রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণকে রূপ দিচ্ছে এক জটিল ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায়। এতে গোপনীয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

জাতীয় ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশাধিকার সীমিতকরণ, উন্নত ডেটা ইন্টারসেপ্ট সিস্টেম ব্যবহার করে অধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের নজরদারি, বিদেশি কোম্পানি থেকে কেনা প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি সক্ষমতা বাড়ানো—এসবই এখন পাকিস্তানের ডিজিটাল বাস্তবতা।

এই প্রযুক্তিগুলো মূলত বিদেশি কোম্পানি থেকে আনা হয়েছে। সরকার এগুলোকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ব্যবহার করছে। সমালোচকরা বলছেন, এগুলো আসলে বিরোধী মতকে দমন করার হাতিয়ার।

১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রীয় নজরদারিকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত বলেছিল, এটি সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করে, যেখানে গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই মামলাটি ছিল বিচারক, শীর্ষ কর্মকর্তাদের ও রাজনীতিকদের ফোনে আড়িপাতা নিয়ে। আর তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্দেশে করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধান

সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ‘শ্যাডো অব কন্ট্রোল: সেন্সরশিপ অ্যান্ড ম্যাস সার্ভেইলেন্স ইন পাকিস্তান’ শিরানামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ৪০ লাখের বেশি নাগরিককে নজরদারিতে রেখেছে। এ জন্য তারা বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন চীনের গিজ নেটওয়ার্ক থেকে প্রযুক্তি কিনেছে।’

পাকিস্তানের নজরদারি ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি শক্তিশালী সিস্টেম। একটি হলো ওয়েব মনিটরিং সিস্টেম (ডব্লিউএমএস ২.০), যা জাতীয় ফায়ারওয়ালের মতো কাজ করে। এটি ইন্টারনেট, ভিপিএন এবং নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট বন্ধ করতে পারে। অন্যটি হলো ল’ফুল ইন্টারসেপ্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলআইএমএস), যা টেলিকম কোম্পানির মাধ্যমে ফোনকল, ম্যাসেজ, ইন্টারনেট ব্যবহার এবং এমনকি অবস্থানের তথ্যও সংগ্রহ করতে পারে।

এলআইএমএস জার্মান কোম্পানি উতিম্যাকো এবং আমিরাতভিত্তিক ডেটাফিউশন সরবরাহ করেছে। উতিমাকো-র প্রযুক্তি টেলিকম কোম্পানি থেকে গ্রাহকের তথ্য বিশ্লেষণ করে।

এই ধারা নতুন নয়। পাকিস্তান ১৯৯০-র দশক থেকেই নজরদারি শুরু করে। তখনই নজরদারির কারণে একাধিক সরকার গঠিত ও পতিত হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নজরদারি আরও বেড়েছে।

ডিজিটাল রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নিঘাত দাদ দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘গবেষণা ও প্রতিবেদনগুলো দেখায় যে গত এক দশকে পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য নজরদারি সক্ষমতা তৈরি করেছে।’

১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রীয় নজরদারিকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত বলেছিল, এটি সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করে, যেখানে গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই মামলাটি ছিল বিচারক, শীর্ষ কর্মকর্তাদের ও রাজনীতিকদের ফোনে আড়িপাতা নিয়ে। আর তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্দেশে করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল। আদালত রায়ে বলেছিল, গোপনীয়তা একটি মৌলিক অধিকার, যা কেবল ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়।

ইচ্ছাকৃত নজরদারি নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানে কিছু আইন রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ দুর্বল। এসব আইন নাগরিকদের ইন্টারনেট-অধিকারেরও পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে পারে না।

কর্তৃপক্ষ বারবার টিকটক নিয়েও পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা মনে করে, এই অ্যাপ অনৈতিকতা ছড়ায়। সম্প্রতি পাঞ্জাব পরিষদে একজন আইনপ্রণেতা নৈতিকতার অজুহাতে স্থায়ীভাবে টিকটক নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেন।

যুক্তি এবং লক্ষ্যবস্তু

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকার লঙ্ঘনের জন্য নানা অজুহাত তুলে ধরে। কখনও তারা নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা বলে। আবার কখনও নৈতিকতা বা সামাজিক কারণ দেখায়। তবে অনেকের আশঙ্কা, এসব পদক্ষেপ আসলে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের হাতিয়ার।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ‘এক্স’ নিষিদ্ধ করে। তখন অনেকেই ভিপিএন ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে প্রবেশ করেন। এর পর পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি ভিপিএন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা নেয়।

সরকার দাবি করে, জঙ্গিগোষ্ঠীর অপব্যবহারের কারণে ভিপিএন নিয়ন্ত্রণও জরুরি। তবে বাস্তবে তখন ইমরান খান নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর কর্মীরা প্রতিবাদ সংগঠনে এক্স ব্যবহার করছিলেন।

কর্তৃপক্ষ বারবার টিকটক নিয়েও পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা মনে করে, এই অ্যাপ অনৈতিকতা ছড়ায়। সম্প্রতি পাঞ্জাব পরিষদে একজন আইনপ্রণেতা নৈতিকতার অজুহাতে স্থায়ীভাবে টিকটক নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেন।

শুধু প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ নয়, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের ওপর ডিজিটাল নজরদারিও চালায়। সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে বেশি টার্গেটে থাকেন। কখনও বিরোধী রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত ভিডিও বা অডিও ফাঁস করা হয় এবং ব্ল্যাকমেইল করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া হয়। এই কৌশল পাকিস্তানি রাজনীতিতে বহুদিন ধরে চলছে।

ভি সংস্থার পরিচালক উসামা খিলজি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘পাকিস্তানে নজরদারির অজুহাত জাতীয় নিরাপত্তা হলেও আসল উদ্দেশ্য হলো বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করা। নজরদারির প্রধান শিকার হন রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মীরা।’

সামরিক বাহিনী প্রায়ই নজরদারি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে বিচার বিভাগ ও সংসদের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এজন্য সমানভাবে দায়ী। তারা এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।

খিলজি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ব্যাপক নজরদারিতে জড়িত। কারণ এটি ঘটে ব্যক্তির সম্মতি ও আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই।’

ফ্রিডম হাউস ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে পাকিস্তানকে ‘নট ফ্রি’ ঘোষণা করে। দেশটি ১০০-এর মধ্যে মাত্র ২৭ নম্বর পেয়েছে। একই সঙ্গে নাগরিকদের তথ্য অবৈধভাবে ব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।

বার বার ডিজিটাল অধিকার লঙ্ঘন

পাকিস্তানে ডিজিটাল দমন-পীড়নের দীর্ঘ ইতিহাসে এটি নতুন নয়। এক্স বন্ধ করা, ইন্টারনেট ব্যাহত করা, পিইসিএ আইনে সংশোধনী আনা—এসবের মাধ্যমে সরকার বারবার ডিজিটাল অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করেছে।

২০২৪ সালে পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি (পিটিএ) জানায়, ২০১৬ সালে পিইসিএ পাস হওয়ার পর থেকে তারা ১৪ লাখের বেশি ইউআরএল ব্লক করেছে। কেবল ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ১ লাখ ৯ হাজার ৭৭১টি ইউআরএল ব্লক করা হয়েছে। এর মধ্যে নৈতিকতার কারণে ৫৫ হাজার ৭২৩টি, জাতীয় নিরাপত্তার কারণে ৩৩ হাজার ৬৩৪টি এবং ধর্মভিত্তিক ঘৃণা ছড়ানোর কারণে ১৩ হাজার ৪২২টি ইউআরএল বন্ধ করা হয়। তবে আইনে এসব শব্দের সুনির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই।

২০২৩ সালে ৭৫ হাজার ৩৯৩ এবং ২০২২ সালে ১১ লাখ ৯১ হাজার ইউআরএল ব্লক করা হয়েছিল। এসব পদক্ষেপ পিটিএর অবারিত ক্ষমতারই প্রতিফলন। এ বছর পিইসিএ আইনে সংশোধনী এনে ইন্টারনেট স্বাধীনতা আরও সীমিত করা হয়। শাস্তি ও জরিমানাও বাড়ানো হয়। সাংবাদিক সমাজ ও নাগরিক সমাজ এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও কোনো ফল হয়নি।

সংশোধনীর পর একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে মানবাধিকারকর্মী জলিলা হায়দারের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। সাংবাদিকদের আগেও গ্রেপ্তার করা হতো। তবে ভুয়া খবর বা ভুল তথ্য ছড়ানোর অজুহাতে বাড়তি শাস্তি দেওয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়েছে। এতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ডিজিটাল সাংবাদিক শহিদ আহমদ দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘আগের মতো কাজ করতে পারি না। সবসময় ভয় কাজ করে—আমি বা আমার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। কেউ জানে না আসলে ভুয়া খবর কী? কারণ আইন স্পষ্ট নয়। যেকোনো সময় তারা আপনার পোস্ট অপছন্দ করলে আপনাকে টার্গেট করতে পারে।’

২০২৪ সালের জুলাইয়ে আদালতের আদেশে ২৭টি ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করা হয়। জাতীয় সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির আবেদনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, এসব চ্যানেল ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে এগুলো বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচালিত ছিল। এতে স্পষ্ট হয়, সরকারের মূল লক্ষ্য ভিন্নমত দমন।

পাকিস্তানের ইন্টারনেট পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিপ ইট অন নামের বৈশ্বিক মানবাধিকার জোটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অন্তত ৭৭ বার ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। এর মধ্যে শুধু ২০২৪ সালেই ২৪ বার। এতে বোঝা যায়, ইন্টারনেট বন্ধ করাকে সরকার ক্রমেই বেশি ব্যবহার করছে।

ফ্রিডম হাউস ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে পাকিস্তানকে ‘নট ফ্রি’ ঘোষণা করে। দেশটি ১০০-এর মধ্যে মাত্র ২৭ নম্বর পেয়েছে। একই সঙ্গে নাগরিকদের তথ্য অবৈধভাবে ব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।

কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের জাতীয় সাইবার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম (পিকেসিইআরটি) সতর্ক করে জানায়, ১৮ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য ও পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়েছে। তারা তাৎক্ষণিক সুরক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানায়।

পিকেসিইআরটি জানায়, একটি উন্মুক্ত ও এনক্রিপশনবিহীন ফাইলে ১৮ কোটি ৪০ লাখের বেশি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অল্প টাকায় এসব তথ্য বিক্রি হচ্ছিল। ৫০০ রুপিতে মোবাইল লোকেশন, ২ হাজার রুপিতে বিস্তারিত কল রেকর্ড, আর ৫ হাজার রুপিতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। এত সস্তায় তথ্য বিক্রি হওয়ায় মানুষ আতঙ্কিত। কেউ জানে না, এসব তথ্য কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে।
সূত্র: দ্য ডিপ্লোমেট অবলম্বনে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত