leadT1ad

নড়াইলে বন্ধ সিনেমা হল ‘আল্পনা’ কি করে তাবলিগি মসজিদ

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
নড়াইল
আল্পনা সিনেমা হল ইজারা নিয়ে ব্যানার টাঙিয়ে দেয় আলমী শুরায়ী নেজামের কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

নড়াইলের এক সময়ের দর্শকে ঠাসা প্রেক্ষাগৃহগুলো (সিনেমা হল) একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বশেষ জেলার কালিয়া উপজেলায় বন্ধ ‘আল্পনা’ সিনেমা হলের ভবনে টাঙানো হয়েছে ‘কালিয়া উপজেলা তাবলীগি মার্কাজ মসজিদ’ নামে ব্যানার। চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ‘আলমী শুরায়ী নেজাম’ নামে একটি সংগঠন ব্যানার টানিয়ে ভবনটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজ শুরু করে।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে নড়াইলকে মহকুমার থেকে পূর্ণাঙ্গ জেলা ঘোষণা করা হয়। ওই বছরই কালিয়া উপজেলা শহরে ২০ শতাংশ জমির প্রায় অর্ধের জায়গার ওপরে একটি ‘টাউন হল’ ভবন তৈরি করে জেলা প্রশাসন। উদ্বোধনের কয়েক বছর পর আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি ভবনটি ইজারা নিয়ে চালু করা হয় ‘আল্পনা’ সিনেমা হল। তবে ২০০১ সালের পর সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেলে ভবনটির আর ব্যবহার হয়নি। প্রায় ২০ বছর পরিত্যক্ত পড়ে থেকে ভবনটি এখন জরাজীর্ণ।

একে একে বন্ধ সিনেমা হল

ছোট জেলা হলেও পুরোনো শহর হিসেবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নড়াইল বেশ সমৃদ্ধ। সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রসাশনিক সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার আগেই ১৯৭০ সালে শহরে প্রতিষ্ঠা হয় ‘চিত্রাবাণী’ সিনেমা হল। পরে ১৯৮২ সালে লোহাগড়ায় ‘সেভেন স্টার’ ও ‘সন্ধ্যা’, ১৯৮৫-৮৬ সালে কালিয়ায় ‘আল্পনা’, ২০০১ সালে সীমাখালী এলাকায় ‘গোলক’, গোবরা বাজারে ‘আশা’ সিনেমা হল চালু হয়। এক সময় ঈদ ও পূজায় নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি পেত এই হলগুলোতে। কিন্তু দর্শক সংকটে একে একে বন্ধ হয়ে যায় সব সিনেমা হল।

২০২১ সালের মার্চে জেলার সবচেয়ে পুরোনো চিত্রাবাণী সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হয়। সীমাখালীর ‘গোলক’ সিনেমা হলের জায়গায় হয়েছে মাদ্রাসা, লোহাগড়ার ‘সন্ধ্যা’ ভেঙে মার্কেট নির্মাণ হয়েছে। ‘আশা’ সিনেমা হলও ভেঙে সড়ক ও বাজারের অংশ হয়ে গেছে। ‘সেভেন স্টার’ ও ‘আল্পনা’ বহুদিন পরিত্যক্ত ছিল। সর্বশেষ আল্পনার স্থানে এখন তাবলীগি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হলো।

‘আল্পনা’ সিনেমা হলের স্মৃতিচারণ করে পাশের ব্যবসায়ী বাবর আলী বলেন, ‘আল্পনা হলটা আমাদের শৈশব-যৌবনের অনেক স্মৃতির জায়গা। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ঈদে নতুন ছবি দেখতে এখানে আসতাম। কী যে ভিড় হতো তখন! এখন সেই জায়গায় মসজিদ হয়েছে, ধর্মীয় কাজে ব্যবহার হচ্ছে, এতে আপত্তি নেই। তবে একটু কষ্টও লাগে, কারণ এই হলটা কালিয়ার সংস্কৃতির অংশ ছিল। প্রশাসন চাইলে অন্তত হলের নাম বা কিছু চিহ্ন সংরক্ষণ করে রাখতে পারত।’

নড়াইলের এক সময়ের আল্পনা সিনেমা হল এখন মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত
নড়াইলের এক সময়ের আল্পনা সিনেমা হল এখন মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

কেন বদলে গেল ‘আল্পনা’

প্রথমে ‘টাউন হল’, পরে ‘আল্পনা’ সিনেমা হল কেন্দ্র করে গত শতকের আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধেই কালিয়ার ওই এলাকায় বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠে। সেই সব দোকানপাট থাকলেও হারিয়ে গেছে সিনেমা হল। বর্তমানে সেসব দোকান ভাড়া আকারে ভেদে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। তবে পুরোনো ভবনসহ সাবেক টাউন হলের ২০ শতাংশ জমি বার্ষিক ইজারা দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪ হাজার টাকায়।

‘আলমী শুরায়ী নেজাম’ সংগঠনের নেতা ও উপজেলা ওলামা পরিষদের সভাপতি হাফিজুর রহমান জানান, প্রশাসনের কাছ থেকে বছরে চার হাজার টাকায় ভবনটি ইজারা নিয়েছেন তাঁরা। এখানে তাবলিগ কার্যক্রম শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত তাবলিগ জামাতগুলো প্রথমে এখানে অবস্থান করবে, পরে স্থানীয় মসজিদগুলোতে যাবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘ভবনটি অর্পিত সম্পত্তি (ভেস্টেড প্রোপার্টি)। এক সময় সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ ইজারা নিলেও প্রায় ২০ বছর ব্যবহার হয়নি। এতে ভবনটি মাদকসেবিদের আস্তানায় পরিণত হয়েছিল। তাই রাজস্ব আদায় ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে ইজারা দেওয়া হয়েছে।’

চার হাজার টাকায় পুরোনো ভবনসহ জায়গা ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও স্ট্রিমকে বলেন, ‘চলতি দোকানের সঙ্গে ইজারা দেওয়া জায়গার তুলনা করা চলে না। আর সিনেমা হল বলতে যা বোঝায়, এটা আসলে তেমন নয়। টিনশেড, পুরোনো ভবন। ২০ বছর ধরে বন্ধ। এখন ব্যবহার যোগ্য নয়। আমরা শুধু জায়গা ইজারা দিয়েছি, ভবন নয়। এখন সরকারি জায়গা দখল রাখা ও রাজস্ব নিয়মিত করার জন্য জমি নিয়মানুযায়ী বাৎসরিক ইজারা দেওয়া হয়েছে। গত বছরও কালিয়ায় ২ হাজার একর সরকারি জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে।’

কী বলছেন সাংস্কৃতিক কর্মী-রাজনীতিকরা

জেলার সিনেমা হলগুলোতে প্রতিদিন চারটি করে শো চলার পরও দর্শকের ভিড়ে টিকিট পাওয়া দুষ্কর ছিল। ফলে হলের ‘টিকিট ব্ল্যাকিং’ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। জেলার সিনেমা প্রেমিদের কাছে এসব কেবলই স্মৃতি। সেই স্মৃতির শেষ স্মারক হিসেবে বিলুপ্ত হচ্ছে কালিয়ার ‘আল্পনা’ সিনেমা হল।

আল্পনা সিনেমা হলের জায়গাটি সংরক্ষণ করে ইতিহাস ধরে রাখা যেত বলে মনে করেন সিপিবি নড়াইল জেলা সভাপতি জি এম বরকত উল্লাহর। জেলার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘নড়াইলে সিনেমা হল আর অবশিষ্ট নেই। চিত্রাবাণী, গোলক, আশা, সেভেন স্টার, সন্ধ্যা ও আল্পনা— সবই এখন ইতিহাস।’

নড়াইলের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যকর্মী শুভ সরকার বলেন, ‘সিনেমা হলগুলো শুধু বিনোদনের জায়গা ছিল না, এগুলো ছিল সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে আসতেন, সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো। একে একে সব সিনেমা হল হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া, সংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে যাওয়া। জেলা শহরে একটি আধুনিক সিনেমা হল বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত