চরম ডানপন্থী ধারণা মূলত বিভিন্ন ওপেন ও ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে ছড়ায়। দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের মুসলিম ও অভিবাসীবিরোধী দাঙ্গায় অনলাইনে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রোফাইল ফেসবুকের অন্তত ১৬টি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মাহবুবুল আলম তারেক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে চরম ডানপন্থী মতাদর্শ বেড়েছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ, অভিবাসনবিরোধিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস এবং নানা ষড়যন্ত্রমূলক ধারণা। আগে এসব মতাদর্শ মূলত ইন্টারনেটের প্রান্তিক প্ল্যাটফর্ম বা সংগঠিত গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এগুলো মূলধারার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে। ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে এসব ধারণা ক্রমে স্বাভাবিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এর বিস্তার সবসময় প্রকাশ্য চরমপন্থার মাধ্যমে ঘটে না। বরং দৈনন্দিন সাধারণ অনলাইন কমিউনিটির ভেতরেই ধীরে ধীরে তা প্রভাব বিস্তার করছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশদভাবে আলোচিত হয়। গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভ্রান্ত তথ্য, দলগত প্রভাব ও অ্যালগরিদমের ভূমিকা এসব মতাদর্শ ছড়াতে সহায়তা করছে। এর ফল বাস্তব দুনিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে— যেমন ২০২৪ সালের যুক্তরাজ্যের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে হামলা, ইউরোপের বিক্ষোভ ইত্যাদি।
দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বিশ্বজুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী ধারণার জন্ম ও বিস্তারের প্রধান ক্ষেত্র। টেলিগ্রাম বা ফোর চ্যানের মতো নামহীন প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ফেসবুক বা এক্স এক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। কারণ এগুলো বেশি পরিচিত ও কমিউনিটি-ভিত্তিক। যেমন, পাড়া-মহল্লার আলোচনা গ্রুপ বা আগ্রহভিত্তিক ফোরাম।
গ্রুপ নেটওয়ার্ক ও সদস্যপদ: চরম দক্ষিণপন্থী ধারণা মূলত বিভিন্ন ওপেন ও ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে ছড়ায়। দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের মুসলিম ও অভিবাসীবিরোধী দাঙ্গায় অনলাইনে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রোফাইল ফেসবুকের অন্তত ১৬টি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এসব গ্রুপে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ সদস্য ছিল। গ্রুপগুলো একই ধরনের অ্যাডমিন, মডারেটর ও বিষয়বস্তু শেয়ার করে। এতে একটি ‘ইকো চেম্বার’ তৈরি হয়, যেখানে একই মতাদর্শ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। শিরোনামগুলোতে প্রায়ই ডানপন্থী ব্যক্তিদের প্রশংসা করা হয়। পোস্টে দাঙ্গাকারীদের সমর্থন দেওয়া হয়, যেখানে দাবি করা হয় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইনগত বৈষম্য করা হচ্ছে।
একই ধারা বিশ্বব্যাপীও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাউড বয়েজ ও অল্ট-রাইট নেটওয়ার্কও ফেসবুক ও এক্স ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ‘আইডেন্টিটারিয়ান’ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের যোগসূত্র আছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে এই গোষ্ঠীগুলো ভাষাগত সীমা পেরিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সহযোগিতা করছে।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের যেভাবে আকৃষ্ট করা হয়: অনেকেই কৌতূহল, অর্থনৈতিক ক্ষোভ বা বন্ধুর আমন্ত্রণে এসব গ্রুপে যোগ দেন। সবাই চরমপন্থী নন। কেউ কেউ নিরপেক্ষ পোস্ট করেন বা বর্ণবাদকে সমালোচনা করেন। তবু পরিবেশ তাদের ক্রমশ উগ্র বক্তব্যের মুখোমুখি করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এইভাবে আসা-যাওয়া ও অংশগ্রহণ চরমপন্থাকে তাদের কাছে স্বাভাবিক করে তোলে।
ব্রাজিলে বলসোনারো সমর্থকরা হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপ ব্যবহার করে নির্বাচনকালে সাধারণ মানুষকে টেনে নেয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্কগুলো ফেসবুক ও টুইটারে সাংস্কৃতিক গৌরবের পোস্ট দিয়ে শুরু করে। পরে তা ধীরে ধীরে মুসলিম বা সংখ্যালঘু-বিরোধী বক্তব্যে রূপ নেয়। এভাবে একটি সাধারণ পোস্ট, যেমন সরকারের অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা, ধীরে ধীরে অভিবাসনবিরোধী ঘৃণাত্মক আলোচনায় পরিণত হয়। ফলে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিমুখ হওয়া ব্যবহারকারীরা এসব গোষ্ঠীতে আকৃষ্ট হন।
দ্য গার্ডিয়ান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের তিনটি বড় ফেসবুক গ্রুপের ৫১ হাজারের বেশি পোস্ট বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে বারবার উঠে এসেছে চরম দক্ষিণপন্থার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অভিন্ন বিষয়।
মূলধারার প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস: যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ পোস্টে সরকার, গণমাধ্যম, পুলিশ এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকেও সমালোচনা করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের প্রায়ই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘অবাঞ্ছিত’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এতে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার ক্ষয় হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যান্ডার ভ্যান ডার লিন্ডেন বলেন, এটি আসলে ফ্যাসিবাদী কৌশল— মূলধারার প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বিকল্প বয়ান চাপিয়ে দেওয়া।
এই অবিশ্বাস রিফর্ম ইউকে’র মতো দলগুলোর জন্য লাভজনক হয়। তারা জনগণের এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগায়। প্রভাবশালী অনলাইন ব্যক্তিত্ব ও জিবি নিউজের মতো গণমাধ্যম এ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বিশ্বব্যাপীও একই প্রবণতা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প আমলে গণমাধ্যমকে ‘ভুয়া খবর’ আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ডিপ স্টেট’ বলে আক্রমণ করা হয়। ইলন মাস্কের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এ ধরনের বয়ান বাড়িয়ে তুলেছেন। হাঙ্গেরিতে অরবান সরকারের অধীনে এই অবিশ্বাস চরম দক্ষিণপন্থী নীতি সমর্থনে ভূমিকা রাখছে।
অভিবাসীবিরোধিতা ও নেটিভিজম: যুক্তরাজ্যে দেখা যায়, প্রায় ১৪ শতাংশ পোস্ট অভিবাসনবিষয়ক। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পোস্টে অভিবাসীদের অমানবিক ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ‘পরজীবী’, ‘আক্রমণকারী’, যা ব্রিটিশদের প্রতি হুমকির ধারণা দেয়। নেটিভিস্ট পোস্টগুলো (৪ শতাংশ) দাবি করে যে স্থানীয় সাদা ব্রিটিশরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হয়ে পড়েছে। এতে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে অভিবাসনকে সাংস্কৃতিক ধ্বংস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের জুলিয়া এবনার বলেন, অপরকে এই ধরনের অপমান মনস্তাত্ত্বিকভাবে এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ফিউশন’ তৈরি করে। এতে নিজ গোষ্ঠীর প্রতি অতি দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে, যা অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ন্যায্য বলে মনে করতে সাহায্য করে।
একই ধরনের বয়ান ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালি পার্টি ব্যবহার করছে মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। জার্মানির এএফডি দল টুইটার নেটওয়ার্কে এমন প্রচারণা চালায়, যা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। ভারতে অনলাইনে মুসলমানদের ‘আক্রমণকারী’ আখ্যা দেওয়া হয়, যা ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার মতো সহিংসতা উসকে দিয়েছে।
‘ফার-রাইট’ তকমা প্রত্যাখ্যান: যুক্তরাজ্যের অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেন তারা ‘চরম দক্ষিণপন্থী নন, কেবল ডানপন্থী।’ তারা নিজেদের মতামতকে দেশপ্রেম বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে দেখাতে চান। এতে নেতিবাচক তকমা থেকে দূরে থেকে তাদের প্রভাব বাড়ে। পোস্টগুলোতে লুসি কনোলির মতো দাঙ্গাকারীদের সমর্থন করা হয়েছে। তিনি আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলে অগ্নিসংযোগ উসকে দেওয়ার দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এসব পোস্টে তাকে কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত দমননীতির শিকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের ‘সাধারণ’ প্রতিবাদকারী হিসেবে দেখাতে পারে। এভাবে কলঙ্ক থেকে দূরে থেকে আন্দোলন আরও ছড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রে এমএজিএ সমর্থকেরাও নিজেদের ‘চরম ডানপন্থী’ বলতে অস্বীকার করেন, যদিও মতাদর্শ প্রায় একই। ব্রাজিলে বলসোনারো সমর্থকরা নিজেদের ‘দুর্নীতিবিরোধী দেশপ্রেমিক’ হিসেবে তুলে ধরেন।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাঁধন হিসেবে ব্যবহার: যুক্তরাজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ পোস্টে ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার, ‘গ্রেট রিসেট’ (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মাধ্যমে অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণের দাবি) বা কিউঅ্যাননের মতো ষড়যন্ত্রমূলক ধারণা ছিল।
হোপ নট হেটের অ্যানকি দিও বলেন, এগুলো এক ধরনের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে কাজ করে। অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মুখোমুখি হন। স্যান্ডার ভ্যান ডার লিন্ডেন ব্যাখ্যা করেন, ‘ভ্রান্ত সত্যের’ প্রভাব এখানে কাজ করে। বারবার একই তথ্য দেখলে তা সত্য মনে হয়। গ্রুপের সম্মিলিত সমর্থন এ ভ্রান্ত ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে।
যুক্তরাষ্ট্রে কিউঅ্যানন ফেসবুক ও এক্সে দ্রুত ছড়ায় এবং ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলায় প্রভাব ফেলে। ইউরোপে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ মিম ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যালগরিদমের ভূমিকা: এসব বিষয় নতুন নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম এগুলোর বিস্তারকে দ্রুততর করে তুলেছে। ব্যবহারকারীরা এক ধরনের কন্টেন্ট দেখলে অ্যালগরিদম একই ধরনের আরও কন্টেন্ট দেখায়। এতে একটি ‘র্যাডিকালাইজেশন ইঞ্জিন’ তৈরি হয়, যা সাধারণ অসন্তুষ্টি থেকে মানুষকে ধীরে ধীরে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়।
যুক্তরাজ্যের উদাহরণ কেবল স্থানীয় প্রেক্ষাপট বোঝায়। তবে চরম দক্ষিণপন্থী ধারণা কেবল একটি দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। এটি আন্তঃদেশীয় একটি প্রবণতা। অনলাইন নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন এসব ধারণাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্দোলনেই নেটিভিজম, কর্তৃত্ববাদ ও জনতুষ্টিবাদ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চরম দক্ষিণপন্থাকে আরও উসকে দিয়েছে। অল্ট-রাইট গোষ্ঠী প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্ব ছড়িয়েছে। সিপ্যাক (সিপিএসি)-এর মতো সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের ডান নেতাদের বিশ্বব্যাপী সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত করছে। ইলন মাস্কের অধীনে এক্স প্ল্যাটফর্ম অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য আরও বিস্তার করেছে। এর বাস্তব প্রভাব দেখা যায় ২০২১ সালের ক্যাপিটল হামলায়।
ইউরোপ (যুক্তরাজ্যের বাইরে): জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি দল টুইটারে সক্রিয় থেকে সীমান্তের ওপারেও ধারণা ছড়ায় এবং ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালির সঙ্গে কাজ করে। ফ্রান্সে ডিসকর্ড ও টিকটক তরুণদের চরমপন্থায় টেনে নিচ্ছে। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে চরম দক্ষিণপন্থী সরকারগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদকে স্বাভাবিক করে তুলছে।
ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকা: বলসোনারোর উত্থানে হোয়াটসঅ্যাপ নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যেখানে ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো হয়। সিপ্যাক সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চরম দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। আর্জেন্টিনার ডান নেতা মিলেই একই ধরনের প্রতিষ্ঠাবিরোধী বক্তব্য অনলাইনে ছড়ান।
ভারত: মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ছড়ায়। মুসলমানদের দোষারোপ করা হয় এবং ইসলামকে ‘সাংস্কৃতিকভাবে মুছে ফেলা’র বয়ান প্রচার করা হয়। এর ফল বাস্তব সহিংসতা পর্যন্ত গড়ায়। ভারতে হিন্দুত্বের বিস্তার এখন একটি পরিণত ও রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ ভুয়া তথ্য প্রচারের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ: ‘ফার-রাইট’ বলতে পশ্চিমে যে ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ, অভিবাসবিরোধিতা, নেটিভিজম, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ ও বিশ্বায়ন-বিরোধিতা বোঝায় বাংলাদেশে তেমন ধরনের চরমপন্থার অনলাইন উপস্থিতি নেই। তবে ইসলামি চরমপন্থার উপস্থিতি আছে। এই চরমপন্থী গ্রুপগুলো কঠোর শরিয়াহ আইনের প্রচারণা চালায়, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেয় এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এতে কিছু ফার-রাইট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন কর্তৃত্ববাদ এবং ভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করা। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুদের ‘শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বব্যাপী ফার-রাইট নেটওয়ার্কের মতো বাংলাদেশি চরমপন্থীরাও ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ ব্যবহার করে প্রচারণা চালায়।
অন্যান্য অঞ্চল: দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কে চরম দক্ষিণপন্থী কার্যক্রম অনলাইনে আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত হয়। পশ্চিমা গবেষণায় এগুলো প্রায় উপেক্ষিত থাকে। রাশিয়া থেকে ভ্রান্ত তথ্য প্রচারণা বিশ্বব্যাপী বিভাজন বাড়ায়।
স্ক্যান্ডজা ফোরামের মতো আন্তঃদেশীয় সম্মেলন এসব গোষ্ঠীকে একত্রিত করছে। একই সঙ্গে ইলন মাস্কের মতো ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা এই বিস্তারকে আরও জোরদার করছে।
চরম দক্ষিণপন্থার বিস্তার আকস্মিক নয়। এটি মানুষের মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনের গতিশীলতায় বৃদ্ধি পায়।
ইকো চেম্বার ও কনফার্মেশন বায়াস: ক্লোজড গ্রুপগুলোতে সহমত হওয়াই প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে ‘সামাজিক সমর্থন’ তৈরি হয়। ব্যবহারকারীরা মনে করেন চরম দক্ষিণপন্থী মতাদর্শই সামাজিক ঐকমত্য, যদিও বাস্তবে তা নয়। সমাজ মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক স্যানডার ভ্যান ডার লিন্ডেন ব্যাখ্যা করেছেন, অফলাইনে মানুষের নেটওয়ার্ক সীমিত। কিন্তু অনলাইনে হাজারো একইমতের মানুষ যুক্ত হওয়ায় ভুল ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করে ।
র্যাডিকালাইজেশনের পথ: উগ্রপন্থা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. জুলিয়া এবনার সতর্ক করেছেন যে স্বাভাবিকীকৃত চরম বক্তব্য আসলে একটি ‘বিষাক্ত মিশ্রণ’ তৈরি করে। এর ফল বাস্তব কার্যক্রমে দেখা যায়। যেমন—যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির হামলা।
নেতৃত্ব ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব: ট্রাম্প, লে পেন বা মোদির মতো নেতারা এসব বক্তব্যকে আরও ছড়িয়ে দেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যবয়সী ব্যবহারকারীরা জীবনের নানা চাপের কারণে এ ধরনের প্রভাবের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
এই বিস্তারের বাস্তব প্রভাবও স্পষ্ট। যুক্তরাজ্যের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্রের ৬ জানুয়ারি হামলা, ফ্রান্সের বিক্ষোভ ও ভারতের সহিংসতায় এর ছাপ রয়েছে। অনলাইনে ছড়ানো ভ্রান্ত তথ্য এসব ঘটনাকে উসকে দিয়েছে। এর বৃহত্তর ফল হলো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার ক্ষয়, রাজনীতিতে বিভাজন এবং গণতন্ত্রের অবনতি— যেমন হাঙ্গেরি, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে।
নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিকর পোস্ট টিকে থাকে। তাই মেটা ও এক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম সমালোচনার মুখে। আবার নীতি পরিবর্তন বা দুর্বলতা উগ্রপন্থীদের আরও সাহসী করে তোলে। এভাবে বিশ্বব্যাপী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চরম দক্ষিণপন্থী ধারণাকে মূলধারায় নিয়ে আসছে। যদিও সবাই চরমপন্থায় জড়িয়ে পড়ে না, তবে পরিবেশ অনেককেই টেনে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এভাবে চলতে থাকলে গণতন্ত্র ও সামাজিক সংহতি গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, গ্লোবাল এক্সট্রিমিজম ডট ওআরজি, ডয়চে ভেলে, টাইম
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে চরম ডানপন্থী মতাদর্শ বেড়েছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ, অভিবাসনবিরোধিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস এবং নানা ষড়যন্ত্রমূলক ধারণা। আগে এসব মতাদর্শ মূলত ইন্টারনেটের প্রান্তিক প্ল্যাটফর্ম বা সংগঠিত গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এগুলো মূলধারার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে। ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে এসব ধারণা ক্রমে স্বাভাবিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এর বিস্তার সবসময় প্রকাশ্য চরমপন্থার মাধ্যমে ঘটে না। বরং দৈনন্দিন সাধারণ অনলাইন কমিউনিটির ভেতরেই ধীরে ধীরে তা প্রভাব বিস্তার করছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশদভাবে আলোচিত হয়। গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভ্রান্ত তথ্য, দলগত প্রভাব ও অ্যালগরিদমের ভূমিকা এসব মতাদর্শ ছড়াতে সহায়তা করছে। এর ফল বাস্তব দুনিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে— যেমন ২০২৪ সালের যুক্তরাজ্যের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে হামলা, ইউরোপের বিক্ষোভ ইত্যাদি।
দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন বিশ্বজুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী ধারণার জন্ম ও বিস্তারের প্রধান ক্ষেত্র। টেলিগ্রাম বা ফোর চ্যানের মতো নামহীন প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ফেসবুক বা এক্স এক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। কারণ এগুলো বেশি পরিচিত ও কমিউনিটি-ভিত্তিক। যেমন, পাড়া-মহল্লার আলোচনা গ্রুপ বা আগ্রহভিত্তিক ফোরাম।
গ্রুপ নেটওয়ার্ক ও সদস্যপদ: চরম দক্ষিণপন্থী ধারণা মূলত বিভিন্ন ওপেন ও ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে ছড়ায়। দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের মুসলিম ও অভিবাসীবিরোধী দাঙ্গায় অনলাইনে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রোফাইল ফেসবুকের অন্তত ১৬টি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এসব গ্রুপে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ সদস্য ছিল। গ্রুপগুলো একই ধরনের অ্যাডমিন, মডারেটর ও বিষয়বস্তু শেয়ার করে। এতে একটি ‘ইকো চেম্বার’ তৈরি হয়, যেখানে একই মতাদর্শ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। শিরোনামগুলোতে প্রায়ই ডানপন্থী ব্যক্তিদের প্রশংসা করা হয়। পোস্টে দাঙ্গাকারীদের সমর্থন দেওয়া হয়, যেখানে দাবি করা হয় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইনগত বৈষম্য করা হচ্ছে।
একই ধারা বিশ্বব্যাপীও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাউড বয়েজ ও অল্ট-রাইট নেটওয়ার্কও ফেসবুক ও এক্স ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ‘আইডেন্টিটারিয়ান’ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের যোগসূত্র আছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে এই গোষ্ঠীগুলো ভাষাগত সীমা পেরিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সহযোগিতা করছে।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের যেভাবে আকৃষ্ট করা হয়: অনেকেই কৌতূহল, অর্থনৈতিক ক্ষোভ বা বন্ধুর আমন্ত্রণে এসব গ্রুপে যোগ দেন। সবাই চরমপন্থী নন। কেউ কেউ নিরপেক্ষ পোস্ট করেন বা বর্ণবাদকে সমালোচনা করেন। তবু পরিবেশ তাদের ক্রমশ উগ্র বক্তব্যের মুখোমুখি করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এইভাবে আসা-যাওয়া ও অংশগ্রহণ চরমপন্থাকে তাদের কাছে স্বাভাবিক করে তোলে।
ব্রাজিলে বলসোনারো সমর্থকরা হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপ ব্যবহার করে নির্বাচনকালে সাধারণ মানুষকে টেনে নেয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্কগুলো ফেসবুক ও টুইটারে সাংস্কৃতিক গৌরবের পোস্ট দিয়ে শুরু করে। পরে তা ধীরে ধীরে মুসলিম বা সংখ্যালঘু-বিরোধী বক্তব্যে রূপ নেয়। এভাবে একটি সাধারণ পোস্ট, যেমন সরকারের অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা, ধীরে ধীরে অভিবাসনবিরোধী ঘৃণাত্মক আলোচনায় পরিণত হয়। ফলে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিমুখ হওয়া ব্যবহারকারীরা এসব গোষ্ঠীতে আকৃষ্ট হন।
দ্য গার্ডিয়ান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের তিনটি বড় ফেসবুক গ্রুপের ৫১ হাজারের বেশি পোস্ট বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে বারবার উঠে এসেছে চরম দক্ষিণপন্থার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অভিন্ন বিষয়।
মূলধারার প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস: যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ পোস্টে সরকার, গণমাধ্যম, পুলিশ এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানকেও সমালোচনা করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের প্রায়ই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘অবাঞ্ছিত’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এতে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার ক্ষয় হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যান্ডার ভ্যান ডার লিন্ডেন বলেন, এটি আসলে ফ্যাসিবাদী কৌশল— মূলধারার প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বিকল্প বয়ান চাপিয়ে দেওয়া।
এই অবিশ্বাস রিফর্ম ইউকে’র মতো দলগুলোর জন্য লাভজনক হয়। তারা জনগণের এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগায়। প্রভাবশালী অনলাইন ব্যক্তিত্ব ও জিবি নিউজের মতো গণমাধ্যম এ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বিশ্বব্যাপীও একই প্রবণতা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প আমলে গণমাধ্যমকে ‘ভুয়া খবর’ আর প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ডিপ স্টেট’ বলে আক্রমণ করা হয়। ইলন মাস্কের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এ ধরনের বয়ান বাড়িয়ে তুলেছেন। হাঙ্গেরিতে অরবান সরকারের অধীনে এই অবিশ্বাস চরম দক্ষিণপন্থী নীতি সমর্থনে ভূমিকা রাখছে।
অভিবাসীবিরোধিতা ও নেটিভিজম: যুক্তরাজ্যে দেখা যায়, প্রায় ১৪ শতাংশ পোস্ট অভিবাসনবিষয়ক। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পোস্টে অভিবাসীদের অমানবিক ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ‘পরজীবী’, ‘আক্রমণকারী’, যা ব্রিটিশদের প্রতি হুমকির ধারণা দেয়। নেটিভিস্ট পোস্টগুলো (৪ শতাংশ) দাবি করে যে স্থানীয় সাদা ব্রিটিশরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হয়ে পড়েছে। এতে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে অভিবাসনকে সাংস্কৃতিক ধ্বংস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের জুলিয়া এবনার বলেন, অপরকে এই ধরনের অপমান মনস্তাত্ত্বিকভাবে এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ফিউশন’ তৈরি করে। এতে নিজ গোষ্ঠীর প্রতি অতি দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে, যা অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ন্যায্য বলে মনে করতে সাহায্য করে।
একই ধরনের বয়ান ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালি পার্টি ব্যবহার করছে মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। জার্মানির এএফডি দল টুইটার নেটওয়ার্কে এমন প্রচারণা চালায়, যা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। ভারতে অনলাইনে মুসলমানদের ‘আক্রমণকারী’ আখ্যা দেওয়া হয়, যা ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার মতো সহিংসতা উসকে দিয়েছে।
‘ফার-রাইট’ তকমা প্রত্যাখ্যান: যুক্তরাজ্যের অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেন তারা ‘চরম দক্ষিণপন্থী নন, কেবল ডানপন্থী।’ তারা নিজেদের মতামতকে দেশপ্রেম বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে দেখাতে চান। এতে নেতিবাচক তকমা থেকে দূরে থেকে তাদের প্রভাব বাড়ে। পোস্টগুলোতে লুসি কনোলির মতো দাঙ্গাকারীদের সমর্থন করা হয়েছে। তিনি আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলে অগ্নিসংযোগ উসকে দেওয়ার দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এসব পোস্টে তাকে কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত দমননীতির শিকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের ‘সাধারণ’ প্রতিবাদকারী হিসেবে দেখাতে পারে। এভাবে কলঙ্ক থেকে দূরে থেকে আন্দোলন আরও ছড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রে এমএজিএ সমর্থকেরাও নিজেদের ‘চরম ডানপন্থী’ বলতে অস্বীকার করেন, যদিও মতাদর্শ প্রায় একই। ব্রাজিলে বলসোনারো সমর্থকরা নিজেদের ‘দুর্নীতিবিরোধী দেশপ্রেমিক’ হিসেবে তুলে ধরেন।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাঁধন হিসেবে ব্যবহার: যুক্তরাজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ পোস্টে ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার, ‘গ্রেট রিসেট’ (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মাধ্যমে অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণের দাবি) বা কিউঅ্যাননের মতো ষড়যন্ত্রমূলক ধারণা ছিল।
হোপ নট হেটের অ্যানকি দিও বলেন, এগুলো এক ধরনের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসেবে কাজ করে। অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মুখোমুখি হন। স্যান্ডার ভ্যান ডার লিন্ডেন ব্যাখ্যা করেন, ‘ভ্রান্ত সত্যের’ প্রভাব এখানে কাজ করে। বারবার একই তথ্য দেখলে তা সত্য মনে হয়। গ্রুপের সম্মিলিত সমর্থন এ ভ্রান্ত ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে।
যুক্তরাষ্ট্রে কিউঅ্যানন ফেসবুক ও এক্সে দ্রুত ছড়ায় এবং ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলায় প্রভাব ফেলে। ইউরোপে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ মিম ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যালগরিদমের ভূমিকা: এসব বিষয় নতুন নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম এগুলোর বিস্তারকে দ্রুততর করে তুলেছে। ব্যবহারকারীরা এক ধরনের কন্টেন্ট দেখলে অ্যালগরিদম একই ধরনের আরও কন্টেন্ট দেখায়। এতে একটি ‘র্যাডিকালাইজেশন ইঞ্জিন’ তৈরি হয়, যা সাধারণ অসন্তুষ্টি থেকে মানুষকে ধীরে ধীরে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়।
যুক্তরাজ্যের উদাহরণ কেবল স্থানীয় প্রেক্ষাপট বোঝায়। তবে চরম দক্ষিণপন্থী ধারণা কেবল একটি দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। এটি আন্তঃদেশীয় একটি প্রবণতা। অনলাইন নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন এসব ধারণাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আন্দোলনেই নেটিভিজম, কর্তৃত্ববাদ ও জনতুষ্টিবাদ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চরম দক্ষিণপন্থাকে আরও উসকে দিয়েছে। অল্ট-রাইট গোষ্ঠী প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ তত্ত্ব ছড়িয়েছে। সিপ্যাক (সিপিএসি)-এর মতো সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের ডান নেতাদের বিশ্বব্যাপী সহযোগীদের সঙ্গে যুক্ত করছে। ইলন মাস্কের অধীনে এক্স প্ল্যাটফর্ম অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য আরও বিস্তার করেছে। এর বাস্তব প্রভাব দেখা যায় ২০২১ সালের ক্যাপিটল হামলায়।
ইউরোপ (যুক্তরাজ্যের বাইরে): জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি দল টুইটারে সক্রিয় থেকে সীমান্তের ওপারেও ধারণা ছড়ায় এবং ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালির সঙ্গে কাজ করে। ফ্রান্সে ডিসকর্ড ও টিকটক তরুণদের চরমপন্থায় টেনে নিচ্ছে। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে চরম দক্ষিণপন্থী সরকারগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদকে স্বাভাবিক করে তুলছে।
ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকা: বলসোনারোর উত্থানে হোয়াটসঅ্যাপ নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যেখানে ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো হয়। সিপ্যাক সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চরম দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। আর্জেন্টিনার ডান নেতা মিলেই একই ধরনের প্রতিষ্ঠাবিরোধী বক্তব্য অনলাইনে ছড়ান।
ভারত: মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ছড়ায়। মুসলমানদের দোষারোপ করা হয় এবং ইসলামকে ‘সাংস্কৃতিকভাবে মুছে ফেলা’র বয়ান প্রচার করা হয়। এর ফল বাস্তব সহিংসতা পর্যন্ত গড়ায়। ভারতে হিন্দুত্বের বিস্তার এখন একটি পরিণত ও রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ ভুয়া তথ্য প্রচারের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ: ‘ফার-রাইট’ বলতে পশ্চিমে যে ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ, অভিবাসবিরোধিতা, নেটিভিজম, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ ও বিশ্বায়ন-বিরোধিতা বোঝায় বাংলাদেশে তেমন ধরনের চরমপন্থার অনলাইন উপস্থিতি নেই। তবে ইসলামি চরমপন্থার উপস্থিতি আছে। এই চরমপন্থী গ্রুপগুলো কঠোর শরিয়াহ আইনের প্রচারণা চালায়, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেয় এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এতে কিছু ফার-রাইট বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন কর্তৃত্ববাদ এবং ভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করা। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুদের ‘শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বব্যাপী ফার-রাইট নেটওয়ার্কের মতো বাংলাদেশি চরমপন্থীরাও ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ ব্যবহার করে প্রচারণা চালায়।
অন্যান্য অঞ্চল: দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কে চরম দক্ষিণপন্থী কার্যক্রম অনলাইনে আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত হয়। পশ্চিমা গবেষণায় এগুলো প্রায় উপেক্ষিত থাকে। রাশিয়া থেকে ভ্রান্ত তথ্য প্রচারণা বিশ্বব্যাপী বিভাজন বাড়ায়।
স্ক্যান্ডজা ফোরামের মতো আন্তঃদেশীয় সম্মেলন এসব গোষ্ঠীকে একত্রিত করছে। একই সঙ্গে ইলন মাস্কের মতো ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা এই বিস্তারকে আরও জোরদার করছে।
চরম দক্ষিণপন্থার বিস্তার আকস্মিক নয়। এটি মানুষের মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনের গতিশীলতায় বৃদ্ধি পায়।
ইকো চেম্বার ও কনফার্মেশন বায়াস: ক্লোজড গ্রুপগুলোতে সহমত হওয়াই প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে ‘সামাজিক সমর্থন’ তৈরি হয়। ব্যবহারকারীরা মনে করেন চরম দক্ষিণপন্থী মতাদর্শই সামাজিক ঐকমত্য, যদিও বাস্তবে তা নয়। সমাজ মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক স্যানডার ভ্যান ডার লিন্ডেন ব্যাখ্যা করেছেন, অফলাইনে মানুষের নেটওয়ার্ক সীমিত। কিন্তু অনলাইনে হাজারো একইমতের মানুষ যুক্ত হওয়ায় ভুল ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করে ।
র্যাডিকালাইজেশনের পথ: উগ্রপন্থা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. জুলিয়া এবনার সতর্ক করেছেন যে স্বাভাবিকীকৃত চরম বক্তব্য আসলে একটি ‘বিষাক্ত মিশ্রণ’ তৈরি করে। এর ফল বাস্তব কার্যক্রমে দেখা যায়। যেমন—যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির হামলা।
নেতৃত্ব ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব: ট্রাম্প, লে পেন বা মোদির মতো নেতারা এসব বক্তব্যকে আরও ছড়িয়ে দেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যবয়সী ব্যবহারকারীরা জীবনের নানা চাপের কারণে এ ধরনের প্রভাবের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
এই বিস্তারের বাস্তব প্রভাবও স্পষ্ট। যুক্তরাজ্যের দাঙ্গা, যুক্তরাষ্ট্রের ৬ জানুয়ারি হামলা, ফ্রান্সের বিক্ষোভ ও ভারতের সহিংসতায় এর ছাপ রয়েছে। অনলাইনে ছড়ানো ভ্রান্ত তথ্য এসব ঘটনাকে উসকে দিয়েছে। এর বৃহত্তর ফল হলো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার ক্ষয়, রাজনীতিতে বিভাজন এবং গণতন্ত্রের অবনতি— যেমন হাঙ্গেরি, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে।
নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিকর পোস্ট টিকে থাকে। তাই মেটা ও এক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম সমালোচনার মুখে। আবার নীতি পরিবর্তন বা দুর্বলতা উগ্রপন্থীদের আরও সাহসী করে তোলে। এভাবে বিশ্বব্যাপী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চরম দক্ষিণপন্থী ধারণাকে মূলধারায় নিয়ে আসছে। যদিও সবাই চরমপন্থায় জড়িয়ে পড়ে না, তবে পরিবেশ অনেককেই টেনে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এভাবে চলতে থাকলে গণতন্ত্র ও সামাজিক সংহতি গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, গ্লোবাল এক্সট্রিমিজম ডট ওআরজি, ডয়চে ভেলে, টাইম
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ‘সাতটি অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধ করেছেন। তিনি নিজেকে জাতিসংঘের চেয়ে বড় শান্তির দূত হিসেবেও তুলে ধরেন। এমনকি নিজেকে একাধিকবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য বলেও দাবি করেন।
৪ ঘণ্টা আগে২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধের অবসানের জন্য ২০ দফার প্রস্তাব ঘোষণা করেন। প্রস্তাবটি হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশ করা হয়।
১ দিন আগেএই পদক্ষেপে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের অচলাবস্থাও আরও তীব্র হয়েছে। যদিও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শেষ মুহূর্তে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তবুও নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যায়নি।
১ দিন আগেগবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হার্টের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ইউরোপীয়দের তুলনায় দ্বিগুণ, জাপানিদের তুলনায় ছয় গুণ এবং চীনাদের তুলনায় বিশ গুণ বেশি। সাধারণত, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হার্টের সমস্যা আট থেকে দশ বছর আগেই দেখা দেয়।
২ দিন আগে