চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধের দামামার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পাঁচ দিনের এশিয়া সফর শেষ করেন বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর)। ট্রাম্প মালয়েশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সফর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তখন ফেডারেল সরকারের অচলাবস্থা ও আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল।
এমন পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউস সফরটিকে তুলে ধরে ‘আমেরিকা ফার্স্ট কূটনীতি’ হিসেবে। এই নীতিতে ট্রাম্প শুল্ক বাড়ানোর হুমকি ব্যবহার করে মিত্র ও প্রতিপক্ষ উভয়ের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ছাড় আদায়ের চেষ্টা করেন।
এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অঙ্গীকার পেয়েছে, রপ্তানির ওপর কিছু শুল্ক ছাড়ও নিশ্চিত হয় এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। চীনের সঙ্গে সমঝোতাকে ট্রাম্প নিজেই ‘১০-এর মধ্যে ১২ নম্বর পাওয়ার’ সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেন।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এগুলো মূলত সাময়িক কৌশলগত অর্জন, দীর্ঘমেয়াদে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন নয়। এটি শান্তি নয়, বরং সাময়িক বিরতি—বিশেষকরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্ররা উদ্বিগ্ন হতে পারে।
ট্রাম্পের সফরসঙ্গী বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরখার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের বিদেশ সফর সাধারণত বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পাঁচ দিনের পূর্ব এশিয়া সফরও ছিল মূলত তার ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রদর্শন। তবে এবার একই সঙ্গে, সেই ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ চীনের পাল্টা শুল্কের আঘাতে যুক্তরাষ্ট্র একপ্রকার সমঝোতা করতে এবং চীনকেও অনেক ছাড় দিতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের লাভ: চুক্তি, সম্পদপ্রাপ্তি ও কূটনৈতিক প্রদর্শন
ট্রাম্প তার সফরজুড়ে শুল্কনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি দিয়ে তিনি কৃষি, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদারে মিত্রদের কাছ থেকে ছাড় আদায় করেন।
গত ২৬ অক্টোবর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আসিয়ান সম্মেলনে অংশগ্রহণ দিয়ে ট্রাম্প এই সফর শুরু করেন। মালয়েশিয়ায় ট্রাম্প সেমিকন্ডাক্টর ও বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকারের প্রতিশ্রুতি পান। আসিয়ান বাণিজ্য চুক্তিতেও অগ্রগতি হয়। এতে সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা কিছুটা কমে।
এরপর জাপান থেকে ট্রাম্প পান ১০ বছরে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা, যা যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতকে সহায়তা করবে। এতে দেশটির অটোমোবাইল ও উৎপাদনশিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে। এ ছাড়া জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে বিরল খনিজ সরবরাহের চুক্তিও করে।
দক্ষিণ কোরিয়া বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার করে ২০০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। দেশটির যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এই চুক্তির ফলে কোরীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে আসে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো জাহাজ কারখানা ও বিমান শিল্প পুনরুজ্জীবিত করবে, যা ট্রাম্পের ‘বাই আমেরিকান’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক লিজি সি লি মনে করেন, ট্রাম্প ও শির ব্যক্তিগত কূটনীতির ধরন উভয়ের জন্যই কার্যকর হয়েছে। তার মতে, এটি ‘কৌশলী স্থিতিশীলতা’—যা আপাতত শান্তি এনে দিলেও মূল দ্বন্দ্ব এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
সফরের মূল আকর্ষণ ছিল শেষ দিনে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক। গত কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা চীনা পণ্যের ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছিলেন। তবে চীন নতি স্বীকার করেনি, বরং পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য কেনা স্থগিত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। চীনের ওই পাল্টা আঘাতের পরিপ্রেক্ষিতেই ট্রাম্প এশিয়ায় এই সফর করেন।
এই বৈঠক ছিল মূলত দুই দেশের ইচ্ছাশক্তির লড়াই—যার পেছনে ছিল অর্থনৈতিক ক্ষতির দীর্ঘ ছায়া। অবশেষে উভয় পক্ষই উত্তেজনা প্রশমনে সম্মত হয়। যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক কমায়, আর চীন গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজে প্রবেশাধিকার সহজ করে এবং মার্কিন কৃষিপণ্য ও তেল-গ্যাস আমদানি পুনরায় শুরু করার অঙ্গীকার করে।
দুই দেশের মধ্যে শুল্ক ১০ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে গড়ে ৪৭ শতাংশে আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তেল ও গ্যাস রপ্তানি ২০ শতাংশ বাড়ানোর সুযোগ পায়। এছাড়া চীন ফেন্টানিল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে নতুন পদক্ষেপ নেয়, টিকটকের মালিকানা হস্তান্তর বিষয়ে সমঝোতা হয় এবং উভয় দেশ পারস্পরিক সফরে সম্মত হয়।
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল এনার্জি সেন্টারের পরিচালক রিড ব্লেকমোর এ পরিস্থিতিকে ‘বিরল খনিজ সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের নিজের প্রভাবশালী অবস্থান ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিরতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদকদের জন্য ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্বস্তি’ এনে দিয়েছে।
এই চুক্তিগুলো ট্রাম্পের ব্যক্তিনির্ভর কূটনীতির উদাহরণ—যেখানে কঠোর অর্থনৈতিক অবস্থান এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শন একসঙ্গে দেখা গেছে। তার প্রতিটি বৈঠক ছিল রাজনৈতিক রণকৌশল ও প্রতীকী নাটকীয়তার সমন্বয়।
ফলাফলও তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান। চীনের সয়াবিন নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন কৃষকরা বছরে প্রায় ১২–১৩ বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। বিরল খনিজের রপ্তানি খোলার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা কোম্পানি—যেমন অ্যাপল ও লকহিড মার্টিন—২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বৃদ্ধি থেকে রক্ষা পাবে।
তবে বিশ্লেষকরা এই সাফল্যের পাশাপাশি সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো জোনাথন জিন সমালোচনায় বলেন, এটি ‘কৌশল, কৌশলগত পরিকল্পনা নয়’। ট্রাম্পের ‘কৌশল আছে, কিন্তু কৌশলগত দিকনির্দেশনা নেই।’ তাঁর মতে, চীন একধরনের ‘হোয়াক-এ-মোল খেলা’ পরিচালনা করেছে—একটি চাপের জায়গা (যেমন সয়াবিন) থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য জায়গায় (যেমন বিরল খনিজ, টিকটক) নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো অমীমাংসিতই থাকছে। চীন মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এক বিষয় থেকে আরেকটিতে ব্যস্ত রেখেছে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক লিজি সি লি মনে করেন, ট্রাম্প ও শির ব্যক্তিগত কূটনীতির ধরন উভয়ের জন্যই কার্যকর হয়েছে। তার মতে, এটি ‘কৌশলী স্থিতিশীলতা’—যা আপাতত শান্তি এনে দিলেও মূল দ্বন্দ্ব এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জুলিয়ান গিউয়ার্টজের মতে, ‘চীন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিটি ছাড় তারা কাজে লাগাচ্ছে।’
শীতল অর্থনৈতিক সংঘাতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন এবং সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দেন, তখন চীনা সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা কোনো ‘ব্ল্যাকমেইলের’ কাছে নত হবে না এবং ‘শেষ পর্যন্ত লড়বে।’ ধীরে ধীরে এই সংঘাত কেবল বাণিজ্যযুদ্ধ নয়, বরং দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ভূরাজনৈতিক শক্তিপরীক্ষায় রূপ নেয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফলের অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল।
ফলে গত ছয় মাস কেটেছে অস্থিরতায়। বারবার শুল্ক বাড়ানো ও কমানো, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, হুমকি ও পাল্টা হুমকি, সিদ্ধান্ত স্থগিত করা এবং একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তদন্ত—সব মিলিয়ে সময়টা ছিল চরম অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত।
এখন প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, তা কি সত্যিই এই লড়াইয়ের সমাপ্তি নির্দেশ করে? আর যদি করে, তবে তা কার শর্তে?
আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এপ্রিলে ট্রাম্পের আরোপিত ৬০ শতাংশেরও বেশি শুল্ক এবং বেইজিংয়ের পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে শুরু হওয়া এই সংঘাত এখন একটি শর্তসাপেক্ষ যুদ্ধবিরতির পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। মাদ্রিদ ও জেনেভাসহ নিরপেক্ষ স্থানে পাঁচ দফা আলোচনার পর আসল এই বুসান বৈঠক।
দুই পক্ষ উত্তেজনাপূর্ণ পদক্ষেপ অনেকটাই প্রত্যাহার করেছে। শুল্কহার ৪৫-৪৭ শতাংশে নেমেছে, চীনে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন রপ্তানি আবারও শুরু হয়েছে এবং চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরল খনিজ আমদানিতে এক বছরের জন্য স্বস্তি এসেছে।
চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ফেন্টানিল উৎপাদন ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। ট্রাম্পের বলেছেন, চূড়ান্ত চুক্তি খুব শিগগিরই হবে।
এই বাণিজ্য-যুদ্ধবিরতি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আপাতত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। শুল্কবৃদ্ধির আশঙ্কায় বাজার ইতিমধ্যে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে গিয়েছিল। ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারগুলো বছরে অতিরিক্ত ১ হাজার ৩০০ ডলার ব্যয়ের মুখে পড়ছিল। অন্যদিকে চীনের জন্যও এটি কিছুটা বিরতি এনে দিয়েছে—৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চাপে থাকা অর্থনীতি কিছুটা স্থিতি পেয়েছে এবং সংঘাতকালে তাদের শেয়ারবাজার ৩৪ শতাংশ বেড়েছে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, এটি বড় বাণিজ্য সমস্যা সমাধান করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা একে স্থায়ী সমাধান নয়, বরং এক প্রকার সাময়িক বিরতি বলে মনে করছেন।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাক্তন সিআইএ বিশ্লেষক ডেনিস ওয়াইল্ডার বলেছেন, ‘এটি বাণিজ্যযুদ্ধের বিরতি, শেষ নয়। আমরা এখনো অনেক দূরে আছি।’ ট্রিভিয়াম চায়নার জো মাজুর মন্তব্য করেন, ‘চীনের কৌশল—প্রথমে আঘাত নয়, কিন্তু প্রতিবার প্রতিশোধ—এবার সম্পূর্ণ সফল হয়েছে।’
তবে এই শান্তি ভঙ্গুর। ফেন্টানিল নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি না হলে শুল্ক ছাড় পুনরায় প্রত্যাহার হতে পারে। চুক্তিতে তাইওয়ান বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপের মতো সংবেদনশীল ইস্যু অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিশ্লেষক জা ইয়ান চং সতর্ক করেছেন, ‘এইসব পদক্ষেপ খুব সহজেই বাতিল করা যায় এবং একে অপরকে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করা সম্ভব।’
নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝু ফেং বলেন, পূর্ণাঙ্গ খনিজ রপ্তানি বন্ধ ‘দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর’ হতো, তাই সময়ক্ষেপণ চীনের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জুলিয়ান গিউয়ার্টজের মতে, ‘চীন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিটি ছাড় তারা কাজে লাগাচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। মিত্ররা শুল্ক এড়াতে আপস করেছে, আর শি জিনপিং কিছু না হারিয়েই বাড়তি সময় পেলেন। তাই বলা যায়, বাণিজ্যযুদ্ধ থামেনি—এটি কেবল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিচ্ছে। ২০২৬ সালের দিকেই এই অস্থির ভারসাম্য আবারও ভেঙে পড়তে পারে।
বৃহত্তর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের লুইস লু মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব সীমিত—ফেন্টানিল নীতির ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে মাত্র ০.২ শতাংশ, কিন্তু ৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না। শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ক্রেইগ কাফুরা মন্তব্য করেন, ‘নিজেকে মুখে ঘুষি মারা বন্ধ করার মতো স্বস্তি এসেছে। এটি আমদানি ব্যয় কিছুটা কমালেও জনসমর্থন ক্ষয়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে, শি জিনপিং আহ্বান জানিয়েছেন ‘বৃহত্তর চিত্র’ দেখার এবং ‘বিধ্বংসী চক্র’ থেকে বেরিয়ে আসার। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, চীনের উত্থান এবং ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ধারণা মূলত একে অপরের প্রতিযোগী।
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের সিনিয়র ডিরেক্টর ও সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপদেষ্টা মেলানি হার্ট বলেন, আলোচনার ফলাফল ছিল ‘প্রত্যাশিত’। তিনি সতর্ক করেন, চীন চাইলে ‘সব ছাড় ফেরত নিতে পারে।’ ২০২৬ সালের নির্ধারিত শীর্ষ বৈঠকগুলো—বিশেষ করে ট্রাম্পের এপ্রিলের বেইজিং সফর—চীন কৌশলগতভাবে ব্যবহার করবে তাকে ‘নিয়ন্ত্রণে আনত’।
কাউন্সিলের ভূ-অর্থনীতি সেন্টারের সিনিয়র ডিরেক্টর জোশ লিপস্কি একই মত দেন। তাঁর মতে, এই চুক্তি ‘আমাদের কেবল সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়েছে, যেখানে আমরা বসন্তকালের বাণিজ্যযুদ্ধের আগে ছিলাম। সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলো পরবর্তী আলোচনায় উঠবে।’
কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাথিউ ক্রোয়েনিগের ধারণা, দুই দেশের সম্পর্ক ‘ভালো হওয়ার আগে আরও খারাপ’ হতে পারে। বড় কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধান হয়নি। একই প্রতিষ্ঠানের ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো ডেক্সটার টিফ রবার্টস আরও কঠোর মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, ‘এই সাময়িক বাণিজ্যবিরতি শেষ পর্যন্ত ফাঁপা প্রমাণিত হতে পারে।’
কাউন্সিলের জিওটেক সেন্টারের ফেলো কিট কনকলিন এটিকে ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতি, কিন্তু শান্তি নয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় ‘কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা’ আগামী বছরে নতুন অস্থিরতা ডেকে আনবে, যেখানে বাণিজ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা একীভূত হয়ে যাবে। কারণ বাণিজ্যযুদ্ধের মূল কারণ—প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাজারে প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা—রয়ে গেছে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি আবারও উত্তেজনা বাড়তে পারে।
তবে ট্রাম্পের এশিয়া সফর তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ভাবমূর্তিকে শক্ত করেছে। তার জন্য রাজনৈতিকভাবে বড় সাফল্য বয়ে এনেছে। এক ট্রিলিয়নেরও বেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি তার ‘দক্ষ আলোচক’ ভাবমূর্তিকেও শক্ত করেছে এবং কৃষকদের অসন্তোষ প্রশমিত করেছে। তবে এই যুদ্ধবিরতি আসলে একটি কৌশলগত বিরাম, স্থায়ী শান্তি নয়। যুক্তরাষ্ট্র সাময়িক স্বস্তি ও আর্থিক লাভ পেলেও প্রযুক্তি, তাইওয়ান ও বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। মিত্ররা শুল্ক এড়াতে আপস করেছে, আর শি জিনপিং কিছু না হারিয়েই বাড়তি সময় পেলেন। তাই বলা যায়, বাণিজ্যযুদ্ধ থামেনি—এটি কেবল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিচ্ছে। ২০২৬ সালের দিকেই এই অস্থির ভারসাম্য আবারও ভেঙে পড়তে পারে। আপাতত এটি একটি প্রয়োজনীয় বৈরিতার অবসান—পরিকল্পিত নয়, বরং বাধ্যতামূলক শান্তি। কারণ শক্তিশালী পক্ষকেও কখনো কখনো প্রতিপক্ষের শক্তিতে নত হতে হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, সিবিসি নিউজ, সিএনএন, ইউএসএ টুডে