leadT1ad

তালেবানেরা কি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে?

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ২০
তালেবানেরা কি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে

অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে আফগানিস্তানের একাধিক শহরে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় মারাত্মক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মেহসুদ এই হামলা থেকে বেঁচে যান এবং হামলার প্রতিশোধ হিসেবে টিটিপি পাকিস্তানে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ১০ ও ১১ অক্টোবর টিটিপি পাকিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা হামলা চালায়। এর মধ্যে একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলায় ২০ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ৩ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে যখন গত ১১ অক্টোবর রাতে আফগান তালেবান বাহিনী খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি সেনা চৌকিতে একযোগে `বৃহৎ আক্রমণ' চালায়। এই ভয়াবহ সংঘর্ষের পর, উভয় পক্ষই নিজদের বিজয় দাবি করে। আফগানিস্তান ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনা হত্যার দাবি করলে ইসলামাবাদ তা `ভিত্তিহীন প্রচারণা' বলে উড়িয়ে দেয়। এই তীব্র উত্তেজনার ফলে তোরখামসহ দুই দেশের মধ্যকার সব প্রধান সীমান্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এই নজিরবিহীন সংঘাত পাকিস্তান-তালেবানের মধ্যে একসময়ের 'মধুচন্দ্রিমা'র সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। যে তালেবানকে পাকিস্তান কয়েক দশক ধরে নিজেদের 'কৌশলগত সম্পদ' (স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ) হিসেবে লালন-পালন করেছিল, আজ তারাই ইসলামাবাদের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাজনিত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠছে, তালেবান কি কেবল পাকিস্তানের জন্য হুমকি, নাকি তাদের শাসন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যই এক অখণ্ড বিপদ?

জঙ্গি তৎপরতা ও সীমান্ত সমস্যা

তালেবানের বর্তমান চরিত্র বুঝতে হলে তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের ছাই থেকে তালেবানের জন্ম। পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সামরিক ও আর্থিক মদতে তালেবান দ্রুত একটি শক্তিশালী গ্রুপে পরিণত হয় এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আল-কায়েদা নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত তালিকা অনুযায়ী, প্রথম শাসনামলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শেষ পর্যন্ত আল-কায়েদা তালেবানের সুরক্ষায় আফগানিস্তান থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। ২০০১ সালে মার্কিন আক্রমণে পতনের পর দীর্ঘ ২০ বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায় তালেবান।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে গেলে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে তালেবান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসেসমেন্ট ক্যাপাসিটি প্রজেক্ট (এসিএপিএস) প্রতিবেদনে মোটে, এই দীর্ঘ সংগ্রামের পথে তালেবানের সঙ্গে টিটিপি, আল-কায়েদা, ইসলামিক মুভমেন্ট অফ উজবেকিস্তান (আইএমইউ)-এর মতো বহু জঙ্গি গোষ্ঠীর আদর্শগত এবং রণকৌশলগত জোট তৈরি হয়, যা তারা আজও ত্যাগ করতে পারেনি।

সম্প্রতি ভারতে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সংবাদ সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সংগৃহীত ছবি
সম্প্রতি ভারতে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সংবাদ সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সংগৃহীত ছবি

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একাধিক প্রতিবেদন অনুসারে, তালেবান এবং আল-কায়েদার মধ্যে সম্পর্ক এখনও অটুট। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে উঠেছে টিটিপি। আফগান তালেবানের আদর্শিক ছত্রছায়ায় টিটিপি আফগানিস্তানের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলকে পাকিস্তানে হামলা চালানোর এক নিরাপদ লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ' (পিআইপিএস)-এর তথ্যমতে, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানে টিটিপি-র হামলা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাকিস্তান বারবার ডুরান্ড লাইন বরাবর বেড়া নির্মাণ এবং সীমান্ত চৌকি স্থাপন করে এই অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করলেও, তালেবান বাহিনী নিজেরাই সেই বেড়া উপড়ে ফেলেছে এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানপন্থি বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবান শুধুমাত্র টিটিপি-কে আশ্রয়ই দিচ্ছে না, বরং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকেও সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভারতের মিত্রতা

আফগানিস্তানের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নতুনভাবে চিত্রিত করছে, যেখানে প্রধান লাভবান ভারত। পাকিস্তানের তালেবান নীতি যখন বুমেরাং হয়েছে, তখন নয়াদিল্লি এক অত্যন্ত বাস্তববাদী কূটনীতির পথে হাঁটছে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত তালেবানবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত এখন তালেবান সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কাবুলে একটি ‘টেকনিক্যাল মিশন’ চালু রাখা, আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা প্রেরণ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত ধীরে ধীরে কাবুলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।

ভারতের এই নীতির পেছনে রয়েছে এক সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা। ইসলামাবাদ দাবি করছে, তালেবানকে 'ট্রাম্প কার্ড' হিসেবে ব্যবহার করে নয়াদিল্লি দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং শত্রু দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় ।

পাকিস্তান যখন তার পশ্চিম সীমান্তে টিটিপি ও আফগান তালেবানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, তখন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে চাপ স্বাভাবিকভাবেই কমে এসেছে। ভারত চাইছে এই পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে ভারত নিশ্চিত করতে চাইছে আফগানিস্তানের মাটি যেন জইশ-ই-মোহাম্মদ বা লস্কর-ই-তৈয়বার মতো ভারত-বিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী ব্যবহার করতে না পারে।

একইসঙ্গে, পাকিস্তানকে পশ্চিম সীমান্তে ব্যস্ত রেখে ভারত আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে নিজেদের পাল্লা ভারী করতে চাইছে। যদি তালেবান ভারতের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তার বিনিময়ে পাকিস্তানের উপর চাপ অব্যাহত রাখে, তবে তা হবে ভারতের জন্য একটি বড় কৌশলগত বিজয়। এই জটিল খেলা দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন 'প্রক্সি' বা ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করছে। যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য নতুন হুমকি তৈরি করে।

তালেবান শাসনে অর্থনৈতিক পতন

তালেবানের শাসন আফগানিস্তানকে একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতি কার্যত ভেঙে পড়েছে। আগে আফগানিস্তানের সরকারি ব্যয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশই আসত বিদেশি সাহায্য থেকে, যা এখন শূন্য। এর ফলে দেশটির জিডিপি ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতে, আফগানিস্তানের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

এই অর্থনৈতিক সংকট কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিও বটে। কারণ, কর্মসংস্থানহীন এবং ক্ষুধার্ত এক বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী সহজেই আইএস-খোরাসান (আইএস-কে) বা অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দলে ভিড়তে পারে।

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন মোকাবিলায় কাজ করা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) বলছে, আফগানিস্তান এখন বিশ্বের বৃহত্তম আফিম ও মেথামফেটামিন উৎপাদক। এই মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করছে এবং গোটা অঞ্চলে অপরাধ ও অস্থিতিশীলতা ছড়াচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া আফগানিস্তান থেকে সৃষ্ট শরণার্থী সংকট প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে।

আফগানিস্তানের বর্তমান নিরাপত্তাহীনতা

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার বারবার দাবি করে আসছে, ২০২১ সালে পুনরায় শাসন ক্ষমতায় আসা তালেবান আফগানিস্তানে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুসারে, ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) দেশজুড়ে, বিশেষ করে কাবুলে নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা শিয়া হাজারা সম্প্রদায়, সুফি মসজিদ এবং এমনকি বিদেশি দূতাবাসকেও লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।

অন্যদিকে, তালেবানের অভ্যন্তরীণ নীতি বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘুদের উপর তাদের দমন-পীড়ন দেশটিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বন্ধ, নারীদের কর্মসংস্থান থেকে বিতাড়ন এবং কঠোর পর্দা প্রথা চালু করার মতো পদক্ষেপের কারণে হাতেগোনা দু-একটি দেশ ছাড়া কেউই তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।

জাতিসংঘের আফগানিস্তান সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ) এই পরিস্থিতিকে ‘লিঙ্গীয় বৈষম্যমূলক’ (জেন্ডার অ্যাপারথাইড) বলে অভিহিত করেছে। এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা আফগানিস্তানকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে টাইম বোমার মতো বলে দাবি করা হয়েছে। তালেবানের ছত্রছায়ায় জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান, প্রতিবেশীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘাত, ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তির ভূ-রাজনৈতিক খেলা, ভয়াবহ অর্থনৈতিক পতন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা—এই সবকিছুর সম্মিলিত প্রভাবে আফগানিস্তান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

তালেবান যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, তবে আফগানিস্তান কেবল ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত