ভারতে সফররত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সংবাদ সম্মেলন থেকে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে নারী সাংবাদিকদের অনুপস্থিতি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে মোদি সরকার। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, নারী অধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি কি তবে শুধুই রাজনৈতিক স্লোগান? ভারত সরকার বলছে, অনুষ্ঠানের আয়োজনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু এই ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন ভারতের ঘোষিত লিঙ্গ সমতা নীতির সঙ্গে কূটনৈতিক বাস্তবতার এক প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব হিসেবে।
স্ট্রিম ডেস্ক
সফররত তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে মোদি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার।
গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি নয়াদিল্লিতে অবস্থিত আফগান দূতাবাসে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এই ঘটনার পরপরই ভারতীয় নারী সাংবাদিক ও বিরোধী দলগুলো নিন্দার ঝড় তোলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
এই ঘটনা ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছে। ঘটনা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নারী সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কমার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক খুঁজেছেন অনেকে।
সরকারের অবস্থান: জড়িত থাকার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার
ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজনে তাদের ‘কোনো ভূমিকা ছিল না’। সরকারি সূত্রগুলো দাবি করছে, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতার এই আয়োজন করেছিল আফগান দূতাবাস এবং আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে অবস্থিত আফগান কনসাল জেনারেল।
ভারত সরকার জানিয়েছে, অনুষ্ঠানটি আফগান দূতাবাসের চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা বিদেশি ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। যে কারণে এই অনুষ্ঠান ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারের অধীনে নয়। ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে নারী সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আফগান দূতাবাসকে পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।
তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদন মতে, ভারত সরকারের এই ঘটনা থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পেছনে নিজস্ব স্বার্থ নিহিত আছে। ভারত সরকার চায় না এই ধারণা বদ্ধমূল হোক যে, তাঁরা নিজের মাটিতে তালেবানের বৈষম্যমূলক গণমাধ্যম নীতিকে নীরবে অনুমোদন দিয়েছে।
এই দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক স্থাপনের জটিলতাকেও তুলে ধরে। নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে কাবুলের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের অন্যতম প্রচারিত কর্মসূচি হলো 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' (কন্যা সন্তান বাঁচাও, কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করো)। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা এবং নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। যে সরকার দেশে নারীদের শিক্ষা ও অগ্রগতির জন্য নীতি প্রণয়ন করে, সেই দেশের মাটিতেই নারী সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার ঘটনা সরকারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
নারী সাংবাদিকদের প্রতিবাদ: ‘নারীবিদ্বেষ আমদানি করা হচ্ছে’
নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার ঘটনাটি ভারতীয় গণমাধ্যম জগতে বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টিংয়ের অগ্রভাগে রয়েছেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয় নারী সাংবাদিকরা। বিশিষ্ট সাংবাদিকরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন যে এই ধরনের একটি অনুষ্ঠান হতে দেওয়া ভারতের সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করার শামিল।
ইন্ডিয়ান উইমেন'স প্রেস কর্পস (আইডব্লিউপিসি) এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করেছে। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ধরনের পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক নীতির ওপর সরাসরি আঘাত। তারা ভারত সরকারকে আফগান দূতাবাসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করেছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
'দ্য হিন্দু' পত্রিকার বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক, বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার বলেন, তালেবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আতিথেয়তা দিয়ে ভারত তাদের নারীবিদ্বেষী বৈষম্যকে ভারতীয় মাটিতে আমদানি করেছে।
স্বাধীন সাংবাদিক স্মিতা শর্মা বলেন, নারী সাংবাদিকদের কেবল বাদই দেওয়া হয়নি, এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের বক্তব্যেও তালেবান শাসনে আফগান নারী ও মেয়েদের ভয়াবহ দুর্দশার কোনো উল্লেখ ছিল না। যে দেশে আমরা পেশাদার নারী ও নেত্রীদের নিয়ে গর্ব করি, সেখানে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে কারণে মুত্তাকিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। এটাই আজকের বিশ্ব রাজনীতি।’
ইন্ডিয়া টুডে-র সিনিয়র এডিটর পৌলোমী সাহা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তালেবান সরকারকে ভারতীয় মাটিতে এমন একটি সংবাদ সম্মেলন করার অনুমতি দেওয়া হলো ‘যেখানে তারা আমাদের নারী সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্য করে এবং তাদের ঢুকতে দেয় না?’
কেউ কেউ আবার পরিহাস করে বলেছেন, যে দেশ তার গণতান্ত্রিক পরিচয় ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গর্ব করে, সেই দেশেই তালেবানের পশ্চাদগামী নীতিগুলোকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনাকে অনেকেই কেবল পদ্ধতিগত ত্রুটি হিসেবে দেখছেন না, বরং সমতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতির ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবে দেখছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ কেউ আবার নারী সহকর্মীদের প্রবেশাধিকার না দেওয়ার পরেও সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য পুরুষ সাংবাদিকদের সমালোচনাও করেছেন।
অক্সফাম ইন্ডিয়া ও নিউজলন্ড্রির এক যৌথ প্রতিবেদন মতে, ভারতের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর শীর্ষ পদে নারীদের উপস্থিতি খুবই কম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেতৃত্বস্থানীয় পদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পুরুষদের দখলে। অনেক নারী সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, তাদেরকে প্রায়শই ‘সফট বিট’ (যেমন- লাইফস্টাইল, বিনোদন, সংস্কৃতি) দেওয়া হয়, যেখানে পুরুষদের ‘হার্ড বিট’ (যেমন- রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা) দেওয়া হয়। এই বিভাজনের ফলে নারী সাংবাদিকদের পক্ষে পেশাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা এবং পদোন্নতি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তালেবান সরকারের ব্যাখ্যা
আজ রোববার (১২ অক্টোবর) আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাঁর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি একটি “টেকনিক্যাল ইস্যু”, অন্য কোনো সমস্যা নয়। সংবাদ সম্মেলনটি খুব অল্প সময়ের নোটিশে আয়োজন করা হয়েছিল। সাংবাদিকদের যে তালিকায় আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল সীমিত। আমাদের সহকর্মীরা নির্দিষ্ট কয়েকজন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।’
আমির খান মুত্তাকি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্তমানে স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ কোটি শিক্ষার্থী আছে, যার মধ্যে প্রায় ২৮ লাখ নারী ও মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদরাসাগুলোতেও পড়াশোনা স্নাতক পর্যন্ত চলছে। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে আমরা কখনও নারীদের শিক্ষাকে ধর্মীয়ভাবে হারাম ঘোষণা করিনি। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এটি কেবল সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে।’
মোদি সরকারকে তীব্র আক্রমণ
এই বিতর্ক ভারতের বিরোধী দলগুলোকে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিদেশ নীতি ও নারী অধিকারের প্রতিশ্রুতির সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। কংগ্রেস দল এই ঘটনায় বিশেষভাবে সোচ্চার হয়েছে এবং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে এর জবাবদিহি দাবি করেছেন।
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে প্রশ্ন করে বলেছেন, ‘ভারতের নারীদের করা এই “অপমানের” বিষয়ে মোদি যেন তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। নারী অধিকার নিয়ে সরকারের প্রচার কি তবে শুধু ‘সুবিধাবাদী’?
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী দাবি করেছেন, এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নারী অধিকার নিয়ে তাঁর (মোদীর) স্লোগানের ‘ফাঁপা’ দিকই প্রকাশ করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও একই ধরনের সমালোচনা করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় নারীদের অসম্মান করার এবং দেশের নৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলার অভিযোগ তুলেছে।
বিরোধীদের মূল বক্তব্য হলো, মোদী সরকার তালেবানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহে মানবাধিকার এবং লিঙ্গ সমতার মতো মৌলিক নীতিগুলোকে উপেক্ষা করেছে।
দিনশেষে, এই বিতর্কটি নিছক একটি কূটনৈতিক ঘটনায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক নীতির এক কঠিন পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ঘটনা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং লিঙ্গ সমতার মতো মৌলিক সাংবিধানিক নীতির মধ্যকার অন্তর্নিহিত সংঘাতকে প্রকাশ্যে এনেছে। ভারত সরকার ও তালেবান উভয়েই নিজেদের ব্যাখ্যা দিলেও, রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে কতটা আপস করা হবে—সেই মৌলিক প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য স্ক্রল, দ্য প্রিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি।
সফররত তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে মোদি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার।
গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি নয়াদিল্লিতে অবস্থিত আফগান দূতাবাসে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এই ঘটনার পরপরই ভারতীয় নারী সাংবাদিক ও বিরোধী দলগুলো নিন্দার ঝড় তোলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘নারী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ না করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
এই ঘটনা ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছে। ঘটনা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নারী সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কমার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক খুঁজেছেন অনেকে।
সরকারের অবস্থান: জড়িত থাকার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার
ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজনে তাদের ‘কোনো ভূমিকা ছিল না’। সরকারি সূত্রগুলো দাবি করছে, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতার এই আয়োজন করেছিল আফগান দূতাবাস এবং আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে অবস্থিত আফগান কনসাল জেনারেল।
ভারত সরকার জানিয়েছে, অনুষ্ঠানটি আফগান দূতাবাসের চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা বিদেশি ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। যে কারণে এই অনুষ্ঠান ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারের অধীনে নয়। ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে নারী সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আফগান দূতাবাসকে পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।
তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদন মতে, ভারত সরকারের এই ঘটনা থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পেছনে নিজস্ব স্বার্থ নিহিত আছে। ভারত সরকার চায় না এই ধারণা বদ্ধমূল হোক যে, তাঁরা নিজের মাটিতে তালেবানের বৈষম্যমূলক গণমাধ্যম নীতিকে নীরবে অনুমোদন দিয়েছে।
এই দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক স্থাপনের জটিলতাকেও তুলে ধরে। নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে কাবুলের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের অন্যতম প্রচারিত কর্মসূচি হলো 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' (কন্যা সন্তান বাঁচাও, কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করো)। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা এবং নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। যে সরকার দেশে নারীদের শিক্ষা ও অগ্রগতির জন্য নীতি প্রণয়ন করে, সেই দেশের মাটিতেই নারী সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার ঘটনা সরকারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
নারী সাংবাদিকদের প্রতিবাদ: ‘নারীবিদ্বেষ আমদানি করা হচ্ছে’
নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার ঘটনাটি ভারতীয় গণমাধ্যম জগতে বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টিংয়ের অগ্রভাগে রয়েছেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয় নারী সাংবাদিকরা। বিশিষ্ট সাংবাদিকরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন যে এই ধরনের একটি অনুষ্ঠান হতে দেওয়া ভারতের সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করার শামিল।
ইন্ডিয়ান উইমেন'স প্রেস কর্পস (আইডব্লিউপিসি) এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করেছে। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ধরনের পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক নীতির ওপর সরাসরি আঘাত। তারা ভারত সরকারকে আফগান দূতাবাসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করেছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
'দ্য হিন্দু' পত্রিকার বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক, বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার বলেন, তালেবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আতিথেয়তা দিয়ে ভারত তাদের নারীবিদ্বেষী বৈষম্যকে ভারতীয় মাটিতে আমদানি করেছে।
স্বাধীন সাংবাদিক স্মিতা শর্মা বলেন, নারী সাংবাদিকদের কেবল বাদই দেওয়া হয়নি, এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের বক্তব্যেও তালেবান শাসনে আফগান নারী ও মেয়েদের ভয়াবহ দুর্দশার কোনো উল্লেখ ছিল না। যে দেশে আমরা পেশাদার নারী ও নেত্রীদের নিয়ে গর্ব করি, সেখানে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে কারণে মুত্তাকিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। এটাই আজকের বিশ্ব রাজনীতি।’
ইন্ডিয়া টুডে-র সিনিয়র এডিটর পৌলোমী সাহা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তালেবান সরকারকে ভারতীয় মাটিতে এমন একটি সংবাদ সম্মেলন করার অনুমতি দেওয়া হলো ‘যেখানে তারা আমাদের নারী সাংবাদিকদের প্রতি বৈষম্য করে এবং তাদের ঢুকতে দেয় না?’
কেউ কেউ আবার পরিহাস করে বলেছেন, যে দেশ তার গণতান্ত্রিক পরিচয় ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গর্ব করে, সেই দেশেই তালেবানের পশ্চাদগামী নীতিগুলোকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনাকে অনেকেই কেবল পদ্ধতিগত ত্রুটি হিসেবে দেখছেন না, বরং সমতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতির ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবে দেখছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী কেউ কেউ আবার নারী সহকর্মীদের প্রবেশাধিকার না দেওয়ার পরেও সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য পুরুষ সাংবাদিকদের সমালোচনাও করেছেন।
অক্সফাম ইন্ডিয়া ও নিউজলন্ড্রির এক যৌথ প্রতিবেদন মতে, ভারতের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর শীর্ষ পদে নারীদের উপস্থিতি খুবই কম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেতৃত্বস্থানীয় পদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পুরুষদের দখলে। অনেক নারী সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, তাদেরকে প্রায়শই ‘সফট বিট’ (যেমন- লাইফস্টাইল, বিনোদন, সংস্কৃতি) দেওয়া হয়, যেখানে পুরুষদের ‘হার্ড বিট’ (যেমন- রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা) দেওয়া হয়। এই বিভাজনের ফলে নারী সাংবাদিকদের পক্ষে পেশাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা এবং পদোন্নতি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তালেবান সরকারের ব্যাখ্যা
আজ রোববার (১২ অক্টোবর) আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাঁর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি একটি “টেকনিক্যাল ইস্যু”, অন্য কোনো সমস্যা নয়। সংবাদ সম্মেলনটি খুব অল্প সময়ের নোটিশে আয়োজন করা হয়েছিল। সাংবাদিকদের যে তালিকায় আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল সীমিত। আমাদের সহকর্মীরা নির্দিষ্ট কয়েকজন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।’
আমির খান মুত্তাকি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্তমানে স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ কোটি শিক্ষার্থী আছে, যার মধ্যে প্রায় ২৮ লাখ নারী ও মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদরাসাগুলোতেও পড়াশোনা স্নাতক পর্যন্ত চলছে। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে আমরা কখনও নারীদের শিক্ষাকে ধর্মীয়ভাবে হারাম ঘোষণা করিনি। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এটি কেবল সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে।’
মোদি সরকারকে তীব্র আক্রমণ
এই বিতর্ক ভারতের বিরোধী দলগুলোকে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিদেশ নীতি ও নারী অধিকারের প্রতিশ্রুতির সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। কংগ্রেস দল এই ঘটনায় বিশেষভাবে সোচ্চার হয়েছে এবং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে এর জবাবদিহি দাবি করেছেন।
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে প্রশ্ন করে বলেছেন, ‘ভারতের নারীদের করা এই “অপমানের” বিষয়ে মোদি যেন তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। নারী অধিকার নিয়ে সরকারের প্রচার কি তবে শুধু ‘সুবিধাবাদী’?
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী দাবি করেছেন, এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নারী অধিকার নিয়ে তাঁর (মোদীর) স্লোগানের ‘ফাঁপা’ দিকই প্রকাশ করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও একই ধরনের সমালোচনা করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় নারীদের অসম্মান করার এবং দেশের নৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলার অভিযোগ তুলেছে।
বিরোধীদের মূল বক্তব্য হলো, মোদী সরকার তালেবানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহে মানবাধিকার এবং লিঙ্গ সমতার মতো মৌলিক নীতিগুলোকে উপেক্ষা করেছে।
দিনশেষে, এই বিতর্কটি নিছক একটি কূটনৈতিক ঘটনায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক নীতির এক কঠিন পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ঘটনা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং লিঙ্গ সমতার মতো মৌলিক সাংবিধানিক নীতির মধ্যকার অন্তর্নিহিত সংঘাতকে প্রকাশ্যে এনেছে। ভারত সরকার ও তালেবান উভয়েই নিজেদের ব্যাখ্যা দিলেও, রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে কতটা আপস করা হবে—সেই মৌলিক প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য স্ক্রল, দ্য প্রিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাবুলের ‘সার্বভৌম ভূখণ্ড’ লঙ্ঘন করার অভিযোগ তুলেছে আফগানিস্তান। গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) তালেবানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের এসব কর্মকাণ্ড ‘নজিরবিহীন, হিংসাত্মক ও উসকানিমূলক’। এই অভিযোগ আসার আগের রাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে দুটি বিকট বিস্ফোরণ ঘ
১৮ ঘণ্টা আগেদক্ষিণ এশিয়ায়— বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এর পেছনে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় মিশ্রণ, ঔপনিবেশিক শাসকদের কৌশল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং উপনিবেশ-পরবর্তী আত্মপরিচয়ের সংকট।
১ দিন আগেএআই প্রযুক্তির উন্নতির অর্থ হল এখন অতি-বাস্তবসম্মত ভয়েসওভার ও সাউন্ডবাইট তৈরি করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আসল মানুষের কণ্ঠ থেকে আলাদা করা যায় না এআই-জেনারেটেড ভয়েস। এই এক্সপ্লেইনারে আমরা এআইয়ের সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব।
২ দিন আগেড্রোন বা মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন আধুনিক যুদ্ধের অপরিহার্য অস্ত্র। একসময় এগুলো সীমিত পর্যবেক্ষণযন্ত্র ছিল, এখন তা নির্ভুল আঘাত, কম খরচ এবং নিরাপদ পরিচালনার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্ষুদ্রাকৃতির প্রযুক্তি ও সমন্বিত আক্রমণ ক্ষমতার অগ্রগতির ফলে ড্রোন এখন গুপ্তহত্য
২ দিন আগে