বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি অভিঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। শুধু বাংলাদেশের জনগণই নয়, দেশটিতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীও এখন এই জলবায়ু ঝুঁকির সরাসরি সম্মুখীন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বিপদে বাংলাদেশের ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ বা আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা নতুন দিগন্ত দেখাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ‘নো এসকেপ-২: দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড’ বা ‘পালানোর পথ নেই-২: আগামীর দিশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত সোমবার (১০ নভেম্বর) বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ) শুরুর আগমুহূর্তে ইউএনএইচসিআর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনটিতে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘গ্লোবাল লিডার’ বলেও উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুর্যোগ–পূর্ববর্তী সতর্কবার্তা বা আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম পরিচালনায় বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু সংকটের জেরে গত এক দশকে ২৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই হিসেবে দৈনিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘরবাড়ি ত্যাগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে কপ৩০ প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। আর এই বাস্তুচ্যুতদের পরিস্থিতি বাংলাদেশে বেশ খারাপ হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
চরম ঝুঁকি ও প্রশংসনীয় প্রস্তুতি বাংলাদেশের
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে তিন দিক থেকে নদীবেষ্টিত। প্রতিটি নদীর আচরণেই জলবায়ুর বড় পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। অতিবৃষ্টি বেড়েছে, বর্ষার সময় বদলে যাচ্ছে, হিমালয়ের তুষার গলতে শুরু করেছে দ্রুত গতিতে। জলবায়ু পরিবর্তন–সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলোতে বলা হচ্ছে, আগামী ২০ বছরে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়বে, তার অর্ধেক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে।
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কক্সবাজার ও উপকূলীয় জেলাগুলোতে বর্ষাকালে ভূমিধস, অতি বৃষ্টির পর হঠাৎ বন্যা, সাইক্লোন, জলাবদ্ধতা বছর বছর বাড়ছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী, যাদের আবাসস্থলই বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শরণার্থী বসতি।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক বসতি বলা হয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গারা ভৌগোলিকভাবে অস্থিতিশীল পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নেয়। ইউএনএইচসিআর বলছে, বর্ষাকাল অর্থাৎ জুন থেকে অক্টোবর— কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন ক্রমেই অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। প্রতিবছরই খাড়া পাহাড়ি ঢালে মাটি ধসে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। বর্ষায় ভারি বৃষ্টি নামলে বাঁশ ও ত্রিপলের ঘরে থাকা মানুষজনের ভোগান্তি বাড়ে। আর শরণার্থী শিবিরের নিচু এলাকায় থাকা অনেকের ঘর প্রায়শই পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যায়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বড় অংশে যে বন্যা হয়েছিল, তার আঘাত শিবিরগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ ১৫টি শরণার্থী বসতির একটি হবে কক্সবাজার। এখানে প্রতি বছর প্রায় ২০০ দিন পর্যন্ত অত্যধিক তাপমাত্রা হতে পারে, যা মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমে ‘গ্লোবাল লিডার’ বাংলাদেশ
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন আর্লি ওয়ার্নিং এবং আর্লি অ্যাকশনে বিশ্বের অন্যতম সফল দেশ। এর পেছনে তিনটি বড় কারণ উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
এক. ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি। দুই লাখের বেশি স্বেচ্ছাসেবী সাইক্লোনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে দেশের প্রত্যন্ত উপকূলে কাজ করেন। পৃথিবীতে এমন সুসংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক আর কোনো দেশে নেই।
দুই. দেশটিতে জাতীয়ভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের যে সতর্কতা জারি করা হয়, তা সরাসরি শরণার্থী শিবির পর্যন্ত পৌঁছায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবির এখন বাংলাদেশের জাতীয় অ্যালার্ট সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। এতে সময়ের অপচয় কমে, জীবন বাঁচার সুযোগ বাড়ে।
তিন. প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি বিশ্বের যেকোনো শরণার্থী শিবিরের জন্য সবচেয়ে বড় কমিউনিটি–বেইসড আর্লি অ্যাকশন সিস্টেম।
ন্যাপ ও এনডিসিতে শরণার্থী অন্তর্ভুক্তি নেই
ভূমি সংকট, সহিংসতা, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বিশেষত জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (ন্যাপ) তাদের অবস্থানকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তবে বিশ্বের ৩০টি শরণার্থী-আশ্রয়দাতা উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (১৪টি দেশ) এখনও ন্যাপ তৈরি করেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা করেছে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ (১০টি দেশ) শরণার্থীদের কোনো উল্লেখই করেনি। চাদ, জর্ডান, নাইজার এবং দক্ষিণ সুদানের ন্যাপে শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য কিছু কার্যকর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ক্যামেরুন, চাদ, জর্ডান এবং দক্ষিণ সুদান ছাড়া, মাত্র ৪টি দেশের এনডিসিতে শরণার্থীদের উল্লেখ রয়েছে।
শরণার্থীদের বিষয়টি বাংলাদেশের ন্যাপ ও এনডিসিতে উল্লেখ নেই। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিযোজনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার, দেশগুলো তার অল্প অংশই পাচ্ছে— প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত
সংঘাত ও জলবায়ুর কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে—এমন দেশের সংখ্যা ২০০৯ সাল থেকে তিন গুণ হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এরপরও দুর্দশাগ্রস্ত ও সংঘাতে জর্জরিত যেসব দেশে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে, ওই দেশগুলো প্রয়োজনের চার ভাগের এক ভাগ জলবায়ু সহায়তা পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা না রেখেও বাস্তুচ্যুতদের অনেক সময় দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে শরণার্থী ও অন্যান্য বাস্তুচ্যুত মানুষের চার ভাগের তিন ভাগ এমন দেশে বাস করছে, যেগুলো উচ্চ বা চরম জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ে আক্রান্ত। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ইউএনএইচসিআর যতবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল, তার তিন ভাগের এক ভাগের কারণ ছিল বন্যা, খরা, দাবানলসহ অন্যান্য চরম আবহাওয়া–সংক্রান্ত ঘটনা।
যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আবহাওয়া পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০৪০ সাল নাগাদ চরম জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে পড়া দেশের সংখ্যা ৩ থেকে বেড়ে ৬৫–এ পৌঁছাতে পারে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ গাম্বিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, সেনেগাল ও মালির ১৫টি শরণার্থীশিবির বছরে প্রায় ২০০ দিন বিপর্যয়কর তাপমাত্রার মুখে পড়তে পারে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, ‘চরম জলবায়ুর প্রভাব থেকে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে তহবিলে কাটছাঁট। আমরা যদি স্থিতিশীলতা চাই, তাহলে মানুষ যেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। বাস্তুচ্যুত হওয়া থামাতে জলবায়ু তহবিল সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।’