leadT1ad

ডাকসুতে বিজয়ীদের প্রায় অর্ধেকই সরাসরি শিবির করেন না

স্ট্রিম গ্রাফিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘ভূমিধস বিজয় হয়েছে’ বলা হলেও প্রকৃত চিত্র এমন নয়। বরং জয়ীদের প্রায় অর্ধেকই সরাসরি শিবির করেন না। সদ্য শেষ হওয়া ডাকসু নির্বাচনে ১৫টি পদে শিবিরের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে এসেছেন। আর এর বাইরে ১৩টি পদে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র ও অন্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তাঁরা আর মাত্র একটি পদে জয় পেলেই শিবিরের সমান পদ পেতেন। স্ট্রিমের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

আবার ডাকসুর ফলাফলে ‘শিবিরের জয়’ বলা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ইসলামী ছাত্রশিবির সরাসরি কোনো প্যানেল ঘোষণা করেনি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন আলোচনা হয়েছে, প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও। ডাকসু ফল ঘোষণার দিনই এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ নিয়ে কথা বলেন। তিনি ডাকসুতে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি বলেন, ‘দু-একটি পত্রিকায় দেখলাম, ছাত্রশিবিরের প্যানেল জয়ী হয়েছে। সাংবাদিক বন্ধুদের উদ্দেশে বলতে চাই, আমার জানামতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এই নামে কোনো প্যানেল দেওয়া হয়েছে কি? না। পত্রিকায়, বিভিন্ন মিডিয়াতে এভাবে আসছে কেন, প্রশ্ন সেখানে।’

মোট পদের প্রায় অর্ধেকের নেতৃত্বে শিবির নেই

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে পদের সংখ্যা ছিল ২৮টি। এর মধ্যে ২৩টিতেই জয় পায় ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থীরা। এই জোটকে সমর্থন দিয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইনকিলাব মঞ্চ। পাশাপাশি তাঁদের সমর্থন জানায় ‘আপ বাংলাদেশ’ নামে একটি রাজনৈতিক দলও। এ দলের কোনো ছাত্র সংগঠন নেই।

এই জোটকে জয়ী করতে কাজ করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠনও। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেছেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্যানেল থাকলেও শিবির সমর্থিত প্যানেলের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা ছিল।’ গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই জোট থেকে জয় পাওয়াদের অধিকাংশই সরাসরি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ছাত্রসংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত নন। স্ট্রিমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তাঁদের অন্তত আটজন স্বতন্ত্র ও ভিন্ন সংগঠন থেকে প্যানেলে যুক্ত হয়ে ডাকসুতে জয়ী হয়েছেন।

অন্যদিকে এর বাইরে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়েছেন আরও পাঁচ শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে ডাকসুর ২৮ পদের বিপরীতে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ১৫ জন সাংগঠনিকভাবে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত, বিপরীতে শিবিরের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত নন ১৩ জন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে যে পাঁচজনের নাম ইতিমধ্যে সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁদের চার জনই শিবির নেতা। এর বাইরে সুপারিশকৃতদের একজন ঢাবি ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী।

ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে নির্বাচিত ২৩ জন

ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মো. আবু সাদিক (কায়েম)। এ ছাড়া জিএস পদে এসএম ফরহাদ; এজিএস মু. মহিউদ্দিন খান; মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ইকবাল হায়দার; কমন রুম-রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক উম্মে ছালমা; আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক খান জসিম; ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসেন; ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আব্দুল্লাহ; ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ এবং মানবাধিকার ও আইনবিষয়ক সম্পাদক শাখাওয়াত জাকারিয়া নির্বাচিত হয়েছেন।

আর ১৩টি কার্যনির্বাহী সদস্য পদের মধ্যে ১১টিতে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের জয়ী প্রার্থীরা হলেন, সাবিকুন নাহার তামান্না, সর্ব মিত্র চাকমা, মোছা. আফসানা আক্তার, রায়হান উদ্দিন, তাজিনুর রহমান, ইমরান হোসাইন, মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ, মো. রাইসুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান, আনাস ইবনে মুনির এবং মো. বেলাল হোসাইন অপু।

শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ১৫ জন

ডাকসুতে ভিপি পদে নির্বাচিত মো. আবু সাদিক (কায়েম) শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক, জিএস নির্বাচিত এসএম ফরহাদ ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি, এজিএস নির্বাচিত মু. মহিউদ্দিন খান ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক নির্বাচিত ইকবাল হায়দার ঢাবি ছাত্রশিবিরের বিগত কমিটিতে বিজ্ঞান ও ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন।

অন্যদিকে ডাকসুর ছাত্র পরিবহন সম্পাদক নির্বাচিত আসিফ আব্দুল্লাহ শিবিরের ঢাকা মহানগর পূর্বের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। ডাকসুর ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ঢাবি শাখা শিবিরের বিগত কমিটির (২০২৪) ছাত্র আন্দোলন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

জানা গেছে, ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য পদে জয়ী মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাহিত্য ও ক্রীড়া সম্পাদক। ডাকসুর আরেক কার্যনির্বাহী সদস্য ইমরান হোসাইন বর্তমানে ঢাবি শাখা শিবিরের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘প্যানেলের ম্যাক্সিমামই শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। কয়েকজন আছেন, যাঁরা শিবিরের বাইরে থেকে এসে জোট করেছেন।’

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন ডাকসু নেতারা। ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন ডাকসু নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ না পেলেও ৫ আগস্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি কমিটি ঘোষণা করেছে ছাত্রশিবির। ওপরের কয়েকজনের নাম সেই কমিটিতে রয়েছে। তবে এর বাইরেও ডাকসুর নবনির্বাচিত মানবাধিকার ও আইনবিষয়ক সম্পাদক শাখাওয়াত জাকারিয়া, ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসেন, নির্বাচিত কার্যনির্বাহী সদস্য রায়হান উদ্দীন, তাজিনুর রহমান, শাহীনুর রহমান, আনাস ইবনে মুনির ও মো. বেলাল হোসাইন অপুও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন বলে দাবি করেছেন ঢাবি শাখা শিবিরের দপ্তর সম্পাদক ইমরান হোসাইন।

ডাকসুতে কি শিবির জয়ী?

ডাকসুতে শিবিরের সাংগঠনিক কোনো প্যানেল ছিল না। তাদের সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ থেকে শিবিরের ১৫ জন বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হন। এর বাইরে ওই প্যানেল থেকে নির্বাচিত আটজনের কেউ স্বতন্ত্র, কেউ ভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত জনপ্রিয় মুখ। এই কারণে ডাকসুতে জয়ী প্যানেলকে সরাসরি শিবির প্যানেল বলতে রাজি না আপ বাংলাদেশের সদস্য সচিব আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ।

স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘এটি শিবির নেতৃত্বাধীন প্যানেল। ভিপি-জিএস থেকে শুরু করে মূল পদগুলোতে শিবিরের নেতৃবৃন্দই আছেন। সাংগঠনিক সক্ষমতা বা জনবল যেকোনো বিচারেই প্যানেলটাকে শিবির নেতৃত্ব দিচ্ছে ঠিক। কিন্তু এটাকে শিবির প্যানেল বলাটা আমি মনে করি না ঠিক হচ্ছে। যেহেতু এখানে শিবিরের বাইরেও অনেকেই ইনক্লুডেড (যুক্ত) রয়েছেন।’

১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ব্যানারে দলীয় নামে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি—আমাদের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছে। অন্যান্য কয়েকটি দল, এমনকি ইসলামী ছাত্র আন্দোলন তাঁদের নামে নির্বাচন করেছে। কেউ কেউ স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য নামে করেছে, কেউ সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ নামে করেছে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ নামে করেছে, অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ নামে করেছে। কিন্তু যারা স্বনামে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়নি, তার একটা উদ্দেশ্য তো অবশ্যই আছে! যারা আজকে জয়ী হয়েছে, তাদের দেখলাম প্যানেলটা ছিল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট।’

অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের বাইরে ডাকসুতে আরও পাঁচজন শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন—সমাজসেবা সম্পাদক পদে যুবাইর বিন নেছারী, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে জুলাইয়ের পোস্টার গার্ল সানজিদা আহমেদ তন্বি, সদস্য পদে হেমা চাকমা ও উম্মু উসউয়াতুন রাফিয়া।

একই প্যানেলে থেকেও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন ৮ বিজয়ী

ডাকসুতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক পদে নবনির্বাচিত ফাতিমা তাসনিম জুমা ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

গত ১১ সেপ্টেম্বর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ফাতিমা তাসনিম জুমা লিখেছেন, ‘জুলাইয়ের আগে (চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান) আমি ছিলাম রাজনীতি সচেতন, অ্যাপলিটিক্যাল অ্যাস্থেটিক। জুলাইয়ের উত্তাল সময়ে যখন অব্দি (সরকার) পতনের আশাও করতে পারছিলাম না, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই রাজনীতি করব। হাসিনারে তাড়াইতে একটা পলিটিক্যাল গাইডেন্সের আন্ডারে যাব। সিদ্ধান্ত নিই ছাত্রদল করব। সেই সময়ে ঢাবি ছাত্রদল, নোমানী ভাই ও আয়াজ ভাইদের লেখা আমাকে ছাত্রদলের প্রতি উইক করে। এর মধ্যেই হাসিনার পতন ঘটে। ছাত্রদল তখন একপ্রকার ক্ষমতায়। আমি বরাবর ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাদের দলে থাকতে চেয়েছি। সেই তাড়নায় কালচারাল ফ্যাসিজমকে অ্যাড্রেস করা ইনকিলাব মঞ্চ হয়ে ওঠে আমার ভয়েস তোলার জায়গা। পলিটিক্যাল পার্টি ছাড়া পলিটিক্স শুরু করা আমার পলিটিক্যাল বয়স দেড় বছর।’

ফাতেমা তাসনিম জুমা। স্ট্রিম গ্রাফিক
ফাতেমা তাসনিম জুমা। স্ট্রিম গ্রাফিক

ফাতিমা তাসনিম জুমা ছাড়াও ইনকিলাব মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত আরও দুজন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বলে জানান এই মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। তাঁর নম্বরে ফোন করা হলে অন্যজন একজন তাঁর ‘সাথী’ পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ওসমান ভাই পোস্ট দিয়ে আগেই জানাইছিলেন যে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল আমরা ডাকসুতে কোনো প্যানেল দেব না। এবার যে কেউ যেকোনো প্যানেল থেকে চাইলে নির্বাচন করতে পারবে। এটা আগে থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল। ওই হিসেবে শুধু জুমা না, আরও দুজন স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করেছে।’

শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে ইনকিলাব মঞ্চ ভবিষ্যতে যুক্ত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারও রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে অ্যালাই (মিত্র) করা ভিন্ন ব্যাপার। ওরকম প্ল্যান নাই।’ এই বক্তব্য মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির বলেও জানান তিনি।

শরিফ ওসমান হাদি। স্ট্রিম গ্রাফিক
শরিফ ওসমান হাদি। স্ট্রিম গ্রাফিক

ডাকসুর আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক খান জসিম জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী। আন্দোলনের সময় তাঁর শরীরে ২৮টি বুলেট আঘাত হানে। এর মধ্যে দুটি বুলেট চোখে গিয়ে আঘাত করে। গুরুতর আহত হওয়ার ফলে একটি চোখে এখন আর দেখতে পান না খান জসিম।

তিনিও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে জসিম বিষয়টি পরিষ্কার করেছিলেন। ডাকসু নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁর সঙ্গে শিবির ছাড়া আর কেউ যোগাযোগ না করার কারণে তিনি ওই প্যানেলের হয়ে নির্বাচন করেছেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে, শিবির তাদের প্যানেলকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে চেয়েছে। শিবিরের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি ওই প্যানেলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

খান জসিম। স্ট্রিম গ্রাফিক
খান জসিম। স্ট্রিম গ্রাফিক

নবনির্বাচিত কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক উম্মে ছালমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক সংগঠন অ্যাকশন ফর কমিউনিটি ট্রান্সফরমেশনের (অ্যাক্ট) সহপ্রতিষ্ঠাতা। ডাকসুতে একই প্যানেল থেকে তিনি এবং তাঁর স্বামী রায়হান উদ্দীন নির্বাচন করেছেন। তাঁর স্বামীও কার্যনির্বাহী সদস্য পদে জয়ী হয়েছেন। রায়হান উদ্দীন শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত থাকলেও উম্মে ছালমা নিজে শিবির বা ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নন বলে স্ট্রিমকে জানিয়েছেন। আগামী এক বছর ডাকসুতে দায়িত্ব পালন শেষে আবার অ্যাক্টের কার্যক্রম নিয়ে সক্রিয় হতে চান বলেও জানিয়েছেন তিনি।

উম্মে ছালমা। স্ট্রিম গ্রাফিক
উম্মে ছালমা। স্ট্রিম গ্রাফিক

অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ নতুনভাবে তৈরি হওয়া ‘আপ বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় সদস্য। তিনিও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন বলে জানা গেছে। তবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই তিনি শিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করেছেন বলে তাঁর দল জানিয়েছে।

সংগঠনটির সদস্য সচিব আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ স্ট্রিমকে বলেন, ‘ওই প্যানেলে শিবিরের বাইরেও অনেকে নির্বাচন করেছেন। সেই হিসেবে তাদের কেন্দ্রীয় সদস্যও ওই প্যানেলে নির্বাচন করেছেন।’ তাঁর মতে, শিবিরের সঙ্গে এটি তাদের শুধু একটি নির্বাচনী সমঝোতা ছিল। শিবিরের প্যানেলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো আদর্শিক কারণ ছিল না বলেও জানান তিনি।

আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ। স্ট্রিম গ্রাফিক
আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ। স্ট্রিম গ্রাফিক

আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা ওপেন ছিলাম। মানে যেই জোটের সঙ্গে গেলে উইনেবল হবে, তাদের সঙ্গে আমরা জোট করতে পারি, এরকম। অন্য জায়গাতেও এমনটাই হচ্ছে। যেমন জাকসুতেও আমাদের শিবিরের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাবি নেতারা শিবিরের সঙ্গে না গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ইলেকশন করেছেন।’

সদস্য পদে জয়ী সর্ব মিত্র চাকমাও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় গণমাধ্যমের সামনে তিনি বলেছেন, ‘শিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করা মানে শিবিরের রাজনীতি করা নয়। আমি তো আসলে মতাদর্শের ভিত্তিতে এখানে যাইনি। আমি শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য যাঁদের সঙ্গে বেশি কাজ করতে পারব, ইজি ফিট করব—আমি তাঁদের সঙ্গে গেছি। কথা এই জায়গায়।’ স্ট্রিমের পক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হলে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি সর্ব মিত্র। ফোনে কথা বলতে ‘স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না’ বলেও জানান তিনি।

সর্ব মিত্র চাকমা। স্ট্রিম গ্রাফিক
সর্ব মিত্র চাকমা। স্ট্রিম গ্রাফিক

এ ছাড়া, সদস্য পদে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া সাবিকুন নাহার তামান্না ও মোছা. আফসানা আক্তার যথাক্রমে ঢাবি শাখা ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী ও সেক্রেটারির দায়িত্বে রয়েছেন। শিবিরের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী নারী শিক্ষার্থীরা শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন না। তবে ছাত্রী সংস্থাকেই শিবিরের নারী শাখা বলে ধরা হয়।

ঢাবি শাখা ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী সাবিকুন নাহার তামান্না স্ট্রিমকে বলেন, ‘ছাত্রী সংস্থা আলাদা একটি সংগঠন। এটি শিবিরের নারী শাখা নয়।’ তবে দুটি সংগঠনের মধ্যে আদর্শিক মিল রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সাবিকুন নাহার তামান্না। স্ট্রিম গ্রাফিক
সাবিকুন নাহার তামান্না। স্ট্রিম গ্রাফিক

সদস্য পদে জয়ী মো. রাইসুল ইসলামও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। ভবিষ্যতেও শিবিরে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেই বলে স্ট্রিমকে জানিয়েছেন তিনি। দুই চোখেই দেখতে পান না রাইসুল ইসলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পরিচিত মুখ। স্ট্রিমকে জানান, ২০১৯ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তিনি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিলুপ্ত ঘোষণার আগ পর্যন্ত ছাত্রশক্তির সঙ্গে ছিলেন। রাইসুল সর্বশেষ ছাত্রশক্তির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। নিজের জয়ের পেছনে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ত থাকাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।

মো. রাইসুল ইসলাম। স্ট্রিম গ্রাফিক
মো. রাইসুল ইসলাম। স্ট্রিম গ্রাফিক

শিবির স্বতন্ত্র প্যানেলের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করলেও নির্বাচনের ফলাফল থেকে তাঁদের উত্থানের প্রমাণ পাওয়া যায় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল হুদা সাকিব। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘শিবির পূর্ণ জয় পেয়েছে, এটা আপনারা বলতে পারেন না। তবে এটাও সত্যি, শিবিরের উত্থান হয়েছে। এর কারণ, একটা দীর্ঘ সময় তারা প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি। এসময় তারা গোপনে সংগঠিত হয়েছে।’

প্রায় অর্ধেক পদে জয়ী হয়েও শুধু শিবির নেতারাই সিনেট সদস্য

ডাকসুর ২৮টি পদের ১৫টিতে জয়ী শিক্ষার্থীরা সাংগঠনিকভাবে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। এর বাইরে ১৩টি পদে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে যে পাঁচজনের নাম সুপারিশ করা হয়েছে, তার চার জনই শিবির নেতা। সুপারিশকৃত অন্যজন ঢাবি ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) ও ডাকসু সভাপতি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডাকসুর নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডাকসুর নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

বৈঠক শেষে জানানো হয়, সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধির নাম সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন—ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদ, এজিএস মহিউদ্দীন খান, পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ ও সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া সদস্য সাবিকুন্নাহার তামান্না। শিগগিরই গেজেট আকারে এটি প্রকাশ করা হবে।

মতামত জানতে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি ও জিএস সাদিক কায়েম ও এসএম ফরহাদ সাড়া দেননি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত