leadT1ad

এটা কি সত্যের শেষ জমানা

তথ্যের কেয়ামত বা ইনফরমেশন এপক্যালিপ্স শুরু হয়ে গেছে– এ কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। চারিদিকে তথ্যের ছড়াছড়ি, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বোঝা দুষ্কর। অনেকেই মানছে না মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বুলি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল। জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রোপাগান্ডা। মিসইনফরমেশনকে টক্কর দিতে ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন অনেকে। তাতে জনমত পরিবর্তন হচ্ছে সামান্যই। কেন? প্রোপাগান্ডিস্টরা কোন তরিকায় জিতছে সত্যের বিপরীতে? এটা কি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নাকি নিঁখুত স্ট্র্যাটেজি?

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ০২
এটা কি সত্যের শেষ জমানা? স্ট্রিম গ্রাফিক

সিগারেটের প্যাকেট দেখলে এখন আঁতকে উঠতে হয়। বডি হররের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এতে ব্যবহৃত সতর্কীকরণ ছবিগুলো। সাথে বিখ্যাত ট্যাগলাইন: সিগারেট কজেজ ক্যান্সার, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে দৃশ্যমান ক্যাম্পেইনগুলোর একটি ধূমপানবিরোধী ক্যাম্পেইন। সিগারেট ফুসফুসের ক্ষতি করে এবং এর সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে – এই পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য।

এসবের পরও কেন মানুষ সিগারেট খায়? সিগারেট কোম্পানিরা তাদের পণ্য বিষাক্ত—এটা প্যাকেটে ছাপিয়ে কীভাবে বিক্রিবাট্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাড়াচ্ছে? বৈজ্ঞানিক সত্য বা আবিষ্কারের কি তাহলে কোনো প্রভাব নেই মানুষের ওপর?

সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালে বা ভাই-ব্রাদারদের রাজনৈতিক কমেন্টারি শুনলে মনে হয় আসলেই সত্যের জমানা শেষ। চারিদিকে কন্সপিরেসি থিওরির জয়জয়কার। এই ডিপ স্টেট খেলে দিল, অমুক দেশ তমুক দ্বীপ, গ্রাম, শহর নিয়ে গেল, কালকেই কোনো ক্যু হয়ে যাবে, এবং মোস্ট ফেভারিট —গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলা বিখ্যাত সেই বাণী, ‘সেফ এক্সিট’!

এইগুলার মধ্যে কয়েকটা যে আমিও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলি নাই — এটা বললে মিথ্যা হবে। আমি নিজেকে একজন র‍্যাশনাল মানুষ মনে করি, তারপরও কেন আমি এগুলা বিশ্বাস করছি? আপনি কেন করছেন? যারা এই কন্সপিরেসিগুলো ছড়াচ্ছে তারা কি কোনো বিশেষ তরিকায় মিসইনফরমেশন বা কন্সপিরেসি ছড়ায়? তরিকাটা কী? শিখতে চান? অনলাইনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরফে কন্সপিরেসি থিওরিস্ট হয়ে উঠতে চান? তাহলে চলুন আবার গোড়ায় ফিরে যাই।

সিগারেট থেকে শুরু, শেষকালে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ডাউট’

বিখ্যাত সিগারেট কোম্পানি ব্রাউন অ্যান্ড উইলিয়ামসনের ১৯৬৯ সালের একটা মেমোতে কোম্পানি কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল, ‘ডাউট ইজ আওয়ার প্রোডাক্ট’। সিগারেট কোম্পানির পণ্য ‘সংশয়’ কীভাবে? এখানেই লুকিয়ে আছে বর্তমান রাজনীতির রেটরিকের ইতিহাস ও স্ট্র্যাটেজি।

ষাট-সত্তরের দশকে এই তথ্য প্রবল হয়ে ওঠে যে সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ক্যান্সারের নিয়ামক। টোব্যাকো কোম্পানিরা এই ধূমপানবিরোধী ক্যাম্পেইন দেখে এবং বুঝতে পারে যে এই যাত্রায় বিজ্ঞান তাদের বন্ধু নয়। তারা গবেষণায় পালটা রেজাল্ট দিয়ে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে পারবে না, গবেষণার ফল তাদের জন্য ক্ষতিকরই হবে। তখন তারা ৪ ধাপের এক ইউনিক স্ট্র্যাটেজি নেয়।

এই স্ট্র্যাটেজি পরবর্তীতে রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত। বর্তমান ইনফরমেশন-সুনামি এবং মিসইনফরমেশনের যুগে টোব্যাকো স্ট্র্যাটেজি সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারগুলোর একটি—হোক সেটা ট্রাম্পের জন্য বা কোনো উদীয়মান অনলাইন রাজনীতি-বিশ্লেষক। এত সাসপেন্স করলাম, এইবার মূল স্ট্র্যাটেজিটা দেখি।

ধাপ -১:

খতিয়ে দেখা’র প্রতিশ্রুতি: সরকারের মত শুরুতেই সুষ্ঠু তদন্তের কিরা-কসম কাটা। টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি মানুষকে আশ্বস্ত করতে প্রথমেই বলল তারা এই ‘ক্যান্সার’-এর বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে, গবেষণায় বিনিয়োগ করছে। মার্কিনি ভাষায় যেটাকে বলে, ‘উই আর পুটিং আওয়ার বেস্ট পিপল অন ইট’।

ধাপ - ২:

সহজকে জটিল করা: কোনো ধূমপায়ীর মুখে এই কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন– ‘ক্যান্সার তো আরো কতকিছুতেই হয়। ঢাকার যা বাতাস তা তো সিগারেট থেকেও খারাপ। তুমি মাইক্রোওয়েভের রেডিয়েশনের লেভেল জানো…’। সিগারেট কোম্পানিগুলো সিগারেট খাওয়ানোর পাশাপাশি এই জিনিসও দীর্ঘদিন মানুষকে গেলাচ্ছে। সিগারেটের সাথে ক্যান্সারের বা অন্য স্বাস্থ্যগত জটিলতার ডাইরেক্ট কোরিলেশন থাকলেও অন্য কোরিলেশন টেনে জিনিসতাকে জটিল ও হালকা করে। মানুষের মনে সন্দেহের জন্ম দেওয়া যে আসলেই সিগারেটে কতটুকু ক্যান্সার হয় আর অন্য কিছুতে কত। যদিও এখানে কোনো নিয়ামকই মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ হওয়ার কারণ নেই। এই কনফিউজড উঙ্গাবুঙ্গা পরিস্থিতিতে টোব্যাকো কোম্পানি আপনাকে বলবে, ইস্যুটা আসলে সিগারেট না, ফুসফুসের ক্যান্সার। আমাদের ক্যান্সারের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত, ‘সব’ ফ্যাক্টরের দিকে চোখ দেওয়া উচিত, এবং চিকিৎসার উন্নতি করা উচিত। সিগারেটের দিকে মনোযোগ দিলে সেটা হবে মায়োপিক বা একচোখা।

সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালে বা ভাই-ব্রাদারদের রাজনৈতিক কমেন্টারি শুনলে মনে হয় আসলেই সত্যের জমানা শেষ। চারিদিকে কন্সপিরেসি থিওরির জয়জয়কার। এই ডিপ স্টেট খেলে দিল, অমুক দেশ তমুক দ্বীপ, গ্রাম, শহর নিয়ে গেল, কালকেই কোনো ক্যু হয়ে যাবে, এবং মোস্ট ফেভারিট —গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলা বিখ্যাত সেই বাণী, ‘সেফ এক্সিট’!

ধাপ - ৩:

গুরুতর গবেষণাগুলোকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা: প্রতিষ্ঠিত গবেষণা (যেগুলো বারবার রিচেক করা হয়েছে এবং যেগুলোর পিছে বড় গবেষক দল আছে) —কে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমে সেগুলোর ফাইন্ডিংস উড়িয়ে দেওয়া। যেমন, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সিগারেট আর ক্যান্সারের কো-রিলেশন পাওয়া গেলে পোস্টমর্টেমই অ্যাকুরেট না এমন দাবি তোলা। যেই গবেষণায় সাবজেক্ট অনেক সেই গবেষণাকে ‘পরিসংখ্যানের নাম্বার’-এ রিডিউস করে ডিহিউম্যানাইজ করা। পশুপাখির ওপর করা গবেষণাকে অপ্রাসঙ্গিক বলা। এই পদক্ষেপগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করতো এবং তার আগের সন্দেহে আরো অ্যাড করত। মানুষ অপেক্ষা করত ধাপ-১ এর ‘আসল গবেষণা’ ও খতিয়ে দেখার ওপর। অন্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট গবেষণা থেকে আস্থা হারাতো।

ধাপ - ৪:

নর্মালাইজেশন এবং ‘ইহা পুরাতন তথ্য’ আর্গুমেন্ট: এক পর্যায়ে এই গবেষণা এবং পাল্টা-গবেষণা, তর্ক-বিতর্কে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি আসে তাদের মূল অস্ত্র নিয়ে — ‘এসব জানা কথা, পুরানো কথা, এত পরিসংখ্যান সাধারণ মানুষের জন্য না’। তারা সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট আর গবেষকদের বলতেন, নতুন কিছু বলতে হইলে বলেন, একই ত্যানা প্যাঁচাবেন না।

এই চার ধাপের স্ট্র্যাটেজি তথ্যনির্ভর না, রেটরিক নির্ভর। কিন্তু তার মোকাবেলা করেছে প্রগতিশীল উদারবাদী মিডিয়া তথ্য দিয়ে – যা কার্যকর হওয়ার কথা না, হয়ও নি যথারীতি। এই মোকাবেলার রাজনীতি নিয়ে বিস্তারিত পরে আলোচনা করছি। তার আগে আমরা দেখবো কীভাবে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন এই চার ধাপের স্ট্র্যাটেজিতে হয়।

রাজনীতিতে ‘চালাই দেন’ মডেল

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক এবং এককালের প্রখ্যাত সাংবাদিক জন ক্রিস্টেনসেন মতে, ট্রাম্পের প্রোমোশন টিম টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রির প্লেবুক বা স্ট্র্যাটেজিই ফলো করেছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রবার্ট প্রোক্টোরও একই দাবি করেন, ট্রাম্প টিমের সাথে যুক্ত করেন ব্রেক্সিট ক্যাম্পেইনারদেরই।

কীভাবে?

ব্রেক্সিট ক্যাম্পেইনাররা প্রথমেই দাবি করল প্রতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে জমা দেয়। এটা ফ্যাকচুয়ালি মিথ্যা। কিন্তু এই মিথ্যা তারা জোর দিয়ে প্রচার করে। বাসের গায়ে চিকা মারা থেকে শুরু করে মিডিয়া দিয়ে প্রচার করা কিছুই বাকি রাখে না। মানুষের মুখস্ত হয়ে যায় এই ৩৫০ মিলিয়ন সংখ্যাটি এবং এই ন্যারেটিভ যে প্রচুর টাকা যুক্তরাজ্য হারাচ্ছে ইউরোপিয় ইউনিয়নের জন্য। যখন এই তথ্যের কাউন্টার আসে তখন ক্যাম্পেইনাররা বলে আমরা এটা খতিয়ে দেখছি আমাদের গবেষকদের দিয়ে (ধাপ - ১), ইউরোপীয় ইউনিয়নে এই অর্থ না দিলেও আরো অনেক ক্ষতি হচ্ছে তাদের জন্য যুক্তরাজ্যের, আরো অনেকভাবে টাকা হারাচ্ছে ইউনিয়নের ইন্ধনে (ধাপ-২), ব্রেক্সিটের বিপক্ষের গবেষকরা বায়াসড, ইউনিয়ন ফান্ডেড, তাদের তথ্য সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না কারণ আমজনতা ট্যাক্সের মারপ্যাচ বোঝে না (ধাপ - ৩) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে কত পয়সা হারাচ্ছে যুক্তরাজ্য এগুলা পুরান ক্যাঁচাল, পয়সা হারাচ্ছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ, জনমত ব্রেক্সিটের পক্ষে (ধাপ - ৪)

ট্রাম্প একইভাবে ‘অভিবাসীরা আমাদের সব চাকরি নিয়ে যাচ্ছে’ ক্যাম্পেইন করে। এই মিথ্যাকে ব্যাকাপ দেয় চার ধাপে।

এক. সেই পুরান কাসুন্দী — আমরা গবেষক দিয়ে খতিয়ে দেখব।

দুই. দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, অভিবাসীদের জন্য না হলে আর কি জন্য বাড়ছে? সাদারাই কেন বেকার?

তিন. এত এত পরিসংখ্যান বুঝি না, বুঝি মানুষ বেকার আর দেশে অভিবাসী বাড়ছে।

চার. এই তর্ক পুরানো যে আদৌ কি কারণে বেকার বাড়ছে, এটায় জড়ায় সময় নষ্ট করা যাবে না। জুরি ইজ আউট। কিন্তু সমাধানে যেতে হবে। অভিবাসীদের ঢুকতে দেওয়া যাবে, সিটিজেনশিপ দেওয়া যাবে না, তাহলেই বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হবে। উদারবাদী মিডিয়ার সমাধান পুরানো এবং অকার্যকর, নতুন সমাধান লাগবে।

মানুষ চাঁদে যায় নাই, পৃথিবী চ্যাপ্টা– এই রকম কন্সপিরেসি থিওরি যারা বিশ্বাস করে তারা প্রচুর প্রতিষ্ঠিত কাউন্টার থাকার পরও কেন করে? তাদের ক্ষেত্রে তো কোনো বড় ইন্ডাস্ট্রি স্ট্র্যাটেজি নিয়েও নামে নাই কন্সপিরেসিতে ঈমান আনাতে। এখানে যে মডেল কাজ করে সেটা খারেজির ও বিভ্রান্তির।

দেশের প্রখ্যাত কন্সপিরেসি থিওরিস্ট ওরফে অনলাইন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও একইভাবে অপারেট করে। দেশের সব সমস্যার মূলে আছে সুপারভিলেন ‘র’, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, মায়ানমার ইত্যাদি এবং তাদের জেন্ট বা দোসররা –ক্লেইম।

ধাপ - ১: এখানে বাংলাদেশ এক ডিগ্রি সরেশ। ব্যক্তিগত গবেষণার বরাত দিয়ে তারা নিজেদের ক্লেইম প্রতিষ্ঠার প্রথম চেষ্টা করে। তাও না থাকলে – গবেষণা করছি/করব অঙ্গীকার।

ধাপ - ২: দেশে এত অনিয়ম কেন হচ্ছে? নিশ্চয়ই এর পিছে বিদেশী শক্তি আছে, নাহলে কেন দেশের নেতারা দেশের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগেছে?

ধাপ - ৩: আইনের মারপ্যাচ, ডিপস্টেট, ব্যুরোক্রেসি, কূটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এসব সাধারণ মানুষের বোঝার কথা না। তাকে ক্লিয়ার হিরো-ভিলেন দিতে হবে। অন্য তথ্য ইচ্ছা করে তার জন্য জটিল করা হচ্ছে, কাজেই সেসব গবেষণা ও বিশ্লেষণ বাদ যারা ক্লিয়ার হিরো ভিলেন দেয় না।

ধাপ - ৪: সব তথ্য, গবেষণা পুরানো, এসব দিয়ে উন্নতি হওয়ার থাকলে এতদিনে হয়ে যেত। হয় নাই কারণ সব সমস্যার মূলে আছে অল পাওয়ারফুল বিদেশি শক্তি যে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায় এই দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, বর্ডার, সামরিক শক্তি ইত্যাদিকে। তাকে হারানো না গেলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। দ্য ভিলেন ইজ আউট টু গেট ইউ। তাকে পরাস্ত করাই মূল কথা। বাকি সব ‘ওল্ড টক’।

মজার ব্যপারটা হল পৃথিবীর কোনো ন্যারেটিভই একশোভাগ সত্য বা মিথ্যা হয় না। কাজেই এসব থিওরি কখনো পুরোপুরি তথ্য দিয়ে কাউন্টার করা সম্ভব হয় না। থিওরিস্টদের পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত সংখ্যায় ভুল ধরা যায়, ডাহা মিথ্যা তথ্য দিলে সেটা অডিও-ভিজুয়াল সহ নানা প্রকার এভিডেন্স দিয়ে তুলে ধরা যায়। কিন্তু এসবে কতটা লাভ হয় তা নিয়ে গবেষকদের সন্দেহ আছে। মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে কোনো তথ্য সত্য হওয়ার আদৌ কি প্রয়োজন আছে?

অ্যাগনোটোলজি বা জ্ঞানহীনতার জ্ঞান

১৯৯৫ সালে ইতিহাসবিদ রবার্ট প্রোক্টর জ্ঞানবাজারে নতুন টার্ম আনেন অ্যাগনোটলজি। এটা হল ইগ্নোরেন্সের বিদ্যা বা সহজ করে বললে ইগ্নোরেন্স কীভাবে তৈরি করা যায় সিস্টেমেটিকালি তার গবেষণা। প্রোক্টর এই জ্ঞানকান্ড বা ডিসিপ্লিনের মডেল দাঁড় করান টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রির মডেল দিয়ে। তিনি দেখান তথ্য বা সত্য কীভাবে ন্যারেটিভের কাছে হেরে যায় প্রতিনিয়ত। প্রশ্নাতীত গবেষণা কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রতিনিয়ত। সাম্প্রতিক সময়ে প্রোক্টর বলেন, ‘আমরা ইগ্নোরেন্সের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছি। ট্রাম্প আর ব্রেক্সিট তা প্রমাণ করে।’

সমসাময়িক রাজনীতি বাদেও পৃথিবীতে বড় বড় যেসব কন্সপিরেসি থিওরি আছে সেগুলোর সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা দেখলে প্রোক্টরের কথাকে সত্য বলে মনে হয়। যদিও সত্য-মিথ্যার ভ্যালু যাচাইয়ের আর পয়েন্ট নেই।

মানুষ চাঁদে যায় নাই, পৃথিবী চ্যাপ্টা– এই রকম কন্সপিরেসি থিওরি যারা বিশ্বাস করে তারা প্রচুর প্রতিষ্ঠিত কাউন্টার থাকার পরও কেন করে? তাদের ক্ষেত্রে তো কোনো বড় ইন্ডাস্ট্রি স্ট্র্যাটেজি নিয়েও নামে নাই কন্সপিরেসিতে ঈমান আনাতে। এখানে যে মডেল কাজ করে সেটা খারেজির ও বিভ্রান্তির। কোনো তথ্য-উপাত্তের জন্য নয়, বরং আমি মানবো না প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভের তথ্যে গ্যাপ বা মিথ্যা থাকতে পারে - এই লজিকে। অবিশ্বাস তথ্যে না, যে অথোরিটি তথ্য সরবরাহ করে তার ওপর। মানুষ চাঁদে গেছে - এটা মার্কিন সরকার বলেছে, মার্কিন সরকার সত্য বলে না কাজেই মানুষ চাঁদে যায় নাই।

বিজ্ঞান প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করে। কিন্তু কখনো কখনো এই প্রশ্ন করা হেলদি স্কেপ্টিসিজমের জায়গায় প্যারানয়েড সিনিসিজমে পরিণত হয়। মানুষের চাঁদে যাওয়ার ক্ষমতা আছে– কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা এই বিষয়ে স্কেপ্টিক। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ সম্পূর্ণ মানবজাতিকে ধোঁকা দিতে পারে চাঁদে যাওয়ার মত বড় ঘটনা সাজিয়ে– এই ব্যপারে তারা নিশ্চিত।

আরেকটা জায়গা হল মানুষ সরল ব্যাখ্যা পছন্দ করে। চাঁদে যাওয়ার প্রযুক্তি বোঝার চেয়ে সরকার মিথ্যুক ও বেঈমান এটা বোঝা সহজ। পুরো পৃথিবীতে এলিয়েন বা কোনো অতি ক্ষমতাশালী সুপার ভিলেন আছে যে সব নিয়ন্ত্রণ করছে – এই ধারণা বাকি মানবজাতিকে দায়মুক্ত করে।

দিনশেষে সবই বিশ্বাস এবং আশার খেল। আমরা যারা বিশ্বাস করি মানুষ চাঁদে গেছে তারা প্রত্যেকেই কি এর পুরো বিজ্ঞান জেনে করি, নাকি আমাদের আস্থার বিজ্ঞানীরা বা মিডিয়া এটা বলেছে দেখে করি? মিসইনফরমেশনের প্রতিপক্ষ কি তাহলে সঠিক তথ্য বা ফ্যাক্টচেক হতে পারে?

বর্তমান ইনফরমেশন-সুনামি এবং মিসইনফরমেশনের যুগে টোব্যাকো স্ট্র্যাটেজি সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারগুলোর একটি—হোক সেটা ট্রাম্পের জন্য বা কোনো উদীয়মান অনলাইন রাজনীতি-বিশ্লেষক।

ন্যারেটিভের লড়াইয়ে ফ্যাক্টচেকিং: বন্দুকযুদ্ধে চাক্কু

এই সমাজে যারা এখনো সত্যের বেপারী বা অন্তত নিজেকে তা হিসেবে দাবি করে যেমন, সাংবাদিক, গবেষক, ‘সচেতন নাগরিক’ তাঁরা মিসইনফরমেশনকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন ফ্যাক্টচেকিং দিয়ে। এটা কালবৈশাখীতে ছাতা দিয়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টার মতই দুর্বল প্রচেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলিটিফ্যাক্ট-এর মত বড় ফ্যাক্টচেকিং অর্গানাইজেশনও অনলাইন ডিবেট থেকে নির্বাচনী পোল কোথাওই সুবিধা করতে পারে নি। ‘ফেইক নিউজ’ বুলি দুই পক্ষই সারাক্ষণ আওড়ায় এবং কেউ অপরপক্ষের নিউজকে সত্য বলে মনে করে না।

ফ্যাক্টচেকিং অকার্যকর হয় তিনটা কারণে—-

১. সহজ মিথ্যা বনাম জটিল সত্য: যুক্তরাজ্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়নকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো দেয় এটা সহজ তথ্য। সহজে মনে রাখা যায়, ডাইরেক্ট। এই তথ্যর ফ্যাক্টচেকিং করলে জটিল সব বিষয় এসে উপস্থিত হয় যেমন ইউরোপীয় ইওনিয়নের রিবেট সিস্টেম, কৃষিখাতে ভর্তুকি, আসল নেট কন্ট্রিবিউশন কত ইত্যাদি। এত জটিলতায় কে ভুগতে চায়?

১৯৯৪ সালে মনোবিজ্ঞানী হলিন জনসন এবং কলিন সাইফের্ট একটা গবেষণা করেন যেখানে একদল মানুষকে তারা এক কারখানার বিস্ফোরণ নিয়ে জানান। বিস্ফোরণ বিষয়ক বিবৃতির প্রথম দিকে কারখানায় মজুদ পেট্রোল ক্যান এবং রং-এর উল্লেখ ছিল, কিন্তু পরবর্তী অংশে এটাও মেনশন করা ছিল যে পেট্রল আর রঙের উপস্থিতির তথ্য ভুয়া। গবেষণার সাবজেক্টরা যখন স্মৃতির পরীক্ষা দিলেন তখন এটা মনে করতে পেরেছিলেন যে রঙের উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু যখন তাদের প্রশ্ন করা হল যে বিস্ফোরণে এত ধোঁয়ার কারণ কী তখন অন্য কোনো ব্যাখ্যা না পেয়ে তাদের একটা বড় অংশ রঙের কথা উল্লেখ করেছেন। তারা নিজেরা শুধু ভুল তথ্যে বিশ্বাস করছেন তা না– তথ্য ভুল এটা জানার পর এবং স্বীকার করার পরও সেটাই জোর দিয়ে বলছেন। সত্যকে অস্বীকার করতে পারছেন কিন্তু মিথ্যাকে না। কারণ মিথ্যা সহজ ব্যাখ্যা প্রদান করছে, জটিলতার সৃষ্টি করছে না।

২. সত্য বোরিং: পৃথিবীতে আপনার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার এবং ধরে রাখার নানাকিছু আছে। ইন্সটাগ্রাম রিল থেকে বিউটি কন্টেস্ট – আপনার মস্তিষ্ককে সারাক্ষণ ব্যস্ত ও বিনোদিত রাখে এবং রাখার জন্য ডিজাইন করা। সেথ ফ্ল্যাক্সম্যান, শারাড গোয়েল এবং জাস্টিন রাও– এই তিন গবেষকের এক গবেষণায় আসে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ (স্যাম্পল সাইজ ১.২ মিলিয়ন) সিরিয়াস নিউজ পড়ে (পড়ার রেট তিন মাসে অন্তত ১০ টি আর্টিকেল ও দুইটি মতামত কলাম)। যারা পড়ে তারাও তাদের সমমতের মানুষের মতামতই পড়ে এবং পুনরুৎপাদন করে। বাকি ৯৬ শতাংশ পড়ছেই না, তারা দুই পোলের যেদিকেই অবস্থান করুক। কারণ, নিউজ বোরিং, ফ্যাক্ট বোরিং, সত্য বোরিং।

৩. মোটিভেটেড রিজনিং: সত্য বা তথ্য যদি কারোর আইডেন্টিটি (পলিটিকাল, ধর্মীয়, জাতিগত যেটাই হোক)-এর জন্য হুমকিস্বরূপ হয়, তাহলে সে সেই তথ্যকে রিজেক্ট করে। বিপরীত তথ্য, সত্য-অসত্য যা-ই হোক, সেটায় বিশ্বাস করে। এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেসন রেইফ্লারের মতে এটা হল ‘ব্যাকফায়ার ইফেক্ট’। ২০১১ সালে অভিভাবকদের ওপর করা এক গবেষণায় রেইফ্লার ও আরো কয়েকজন গবেষক লক্ষ করেন, অটিজম ও ভ্যাক্সিনের কোরিলেশন নেই এমন গবেষণার রেজাল্ট যখন তাঁরা রিসার্চ সাবজেক্টদের জানায় তখন যেই অংশ আগে থেকেই ভ্যাক্সিনের পক্ষে তারা সেটা পজিটিভলি গ্রহণ করে, কিন্তু অ্যান্টি-ভ্যাক্স অভিভাবকেরা তারপরও বলেন তারা তাদের সন্তানদের ভ্যাক্সিন দিবেন না, যদিও গবেষণার তথ্য অবিশ্বাস করছেন না। কারণ দ্বিতীয় গ্রুপের মুল রিজনিং ভয়ের ওপর নির্ভরশীল, ফ্যাক্টের বা ফ্যাক্টচেকিং এর ওপর না। মানুষ হুমকি বা ভয়ের কারণে বহুল তথ্যের উপস্থিতিতেও তার পূর্ববর্তী বিশ্বাসের এবং পরিচয়ের বর্শবর্তী হয়ে রিজনিং করে, এটাই মোটিভেটেড রিজনিং।

তাহলে উপায়?

এতদূর পড়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সত্যের জমানা শেষ। যেই হারে মিসইনফরমেশন ছড়ায় এবং ছড়ানো হচ্ছে সেটাকে ফ্যাক্টচেক করাও সম্ভব না, করে লাভও হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই এতটা হতাশাজনক নাকি পুরোটাই নতুন তরিকা উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের অভাব?

তরিকা অতি সাধারণ: ফ্যাক্ট ওভার ফিকশন না, ফিকশন ওভার ফ্যাক্টও না, ফ্যাক্ট ও ফিকশনের মেলবন্ধন।

এখানে ফিকশন বলতে মিথ্যা বা মনগড়া পালটা তথ্য দিয়ে কাউন্টার করার কথা বলছি না, বরং ফিকশনের মূল হাতিয়ার ‘ন্যারেটিভ’ গঠন করার কথা বলছি। অপর প্রান্তে সবাই তাই করছে। তাদের মত ডাউটকে ওয়েপনাইজ না করেও এটা করা সম্ভব। কার্ল সেগান বা নিল ডিগ্র্যাসি টাইসন যেভাবে ন্যারেটিভ দিয়ে, গল্প দিয়ে বিজ্ঞানের তথ্যকে তুলে ধরেন, সেভাবে অন্য তথ্যও তুলে ধরা সম্ভব। ফ্রিকোনমিক্স, ভিসসের মত বহু উদাহরণ আছে যেখানে খুব সহজভাবে, শক্তিশালী রেটরিক দিয়ে অর্থনীতি, সমাজ, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ঘটনা ও সমস্যা ব্যাখ্যা করা হয়। সত্যের অন্বেষণ নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব–এই ধারণা থেকে বের হয়ে, আকর্ষণীয় ন্যারেটিভ দিয়ে সত্য জানায় মানুষকে আগ্রহী করা যায়।

কারোর একক বা সামষ্টিক সত্ত্বা ও বিশ্বাসকে আক্রমণ করে, তথ্যের সমুদ্রে ফেলে দিয়ে– তার বিশ্বাস পরিবর্তন করা যায় না, তাকে দলভুক্ত করা যায় না। অতিডান এই ব্যপারে অবগত, সত্যের ধারক-বাহকরা তাদের উঁচুকক্ষ থেকে নেমে যতদ্রুত এটা বুঝতে পারবে ততদ্রুত তারা ন্যারেটিভের খেলায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।

আমাদের যতটা না ভালো ফ্যাক্টচেকার দরকার, তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন ভালো ন্যারেটর, ভালো গল্পকথক। সত্য খুঁজে বের করা যেন শুধু একটা ‘দায়িত্ব’ না থাকে, বরং একটা আনন্দদায়ক প্রক্রিয়া। ধমকে মানুষ সত্য খোঁজে না, আবিষ্কারের আগ্রহে-আনন্দে খোঁজে। সত্যের সন্ধানের মূল চালিকাশক্তি কৌতূহল।


যাত্রার সত্যিকারের আনন্দ নতুন জায়গা আবিষ্কারে নয়, বরং নতুন দেখার চোখ আবিষ্কারে।

-মার্শেল প্রুস্ত

Ad 300x250

সম্পর্কিত