আমরা এখন বাস করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রিলসের যুগে। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বিছানার চাদর, রান্নার হাঁড়ি, পোষা বেড়াল, বাচ্চার ডায়াপার, উদ্যাপিত দাম্পত্য কলহ ও প্রেম দিয়ে নির্মিত একটা ফ্যাব্রিকেটেড জীবন আমরা অনবরত সাবস্ক্রাইব করি বা কিনি। হুমায়ূন আহমেদ এই কাজ সফলভাবে করেছিলেন সময়ের অনেক আগেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না সে যুগে; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে নির্মিত কন্টেন্ট পাঠকদের সার্ভ করতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি কি আত্মজীবনীমূলক লেখার মাধ্যমে এই কাজগুলো করতেন?
এনামুল রেজা
লেখালেখির জগতে আত্মজৈবনিক রচনা সব সময়েই নানান তর্কের জন্ম দিয়ে গেছে। বিখ্যাত কেউ হলে তো কথাই নেই, এমনকি অখ্যাত লেখকও নিজের জীবনকথায় খ্যাতিমানদের নিয়ে আলাপ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন, এ রকম অসংখ্য উদাহরণ মিলবে।
এ ধরনের রচনায় অলিখিত ঘোষণা থাকে যে এসব বাস্তব, পড়তে বসে পাঠকেরা ধরেই নেন তারা যা পড়ছেন তা লেখকের জীবনে ঘটে গেছে। এবং খেয়াল করে দেখবেন, যে কোনো সুলিখিত আত্মজৈবনিক রচনা পাঠকের মনস্তত্ত্বে একটা দাগ রেখে যায়। প্রিয় লেখক, গায়ক, নায়ক, বা খেলোয়াড় নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত যে কল্পনার মিউজিয়াম, সেই কল্পমিউজিয়াম নির্মাণ করে দেয় তাঁর জীবনের নানান ঘটনাবলি।
সেলিব্রেটিদের কর্ম শুধু নয়, কাণ্ড এবং জীবন যাপনও মানুষ সাবস্ক্রাইব করতে ভালোবাসে। তাঁদের নিয়ে গসিপ—কে কয়টা বিয়ে করল, কে কার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াল, ঋণের দায়ে ডুবে গেলো কে, কার ছেলে ড্রাগ নিয়ে ধরা খেলো পুলিশের হাতে। অর্থাৎ তাঁদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পপকালচারের অংশ বা বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে ওঠে। ইমতিয়াজ আলির রকস্টার সিনেমায় যেমন মিউজিক প্রডিউসার ঢিংড়া উঠতি গায়ক জনার্দনকে বলে, ‘গান কেউ কেনে না, কেনে গায়কের ইমেজ।’
আমার একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ: এই ‘ইমেজ’ নিয়ে সাহিত্যিকেরা যত ভাবেন, আর কোনো মাধ্যমের সেলেব্রিটিরা অতটা ভাবেন বলে মনে হয় না। আত্মজৈবনিক রচনার সময় অধিকাংশ লেখকের মধ্যে একটা সেলফসেন্সর কাজ করে। নিজেদের খুব ভেবেচিন্তে পোর্ট্রে করতে চান তাঁরা, যেখানে তাঁদের শিল্পভাবনা, ব্যক্তিত্ব, লেখালেখির কৌশলের পাশাপাশি থাকে পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থন বা ভিক্টিম কার্ডের ব্যবহার। মানুষের জীবন যেহেতু ঘটতে থাকা একটা ব্যাপার, বা র্যান্ডম, সচেতন কোনো নির্মাণ নয়, লেখকদের সুচিন্তিত সাজানো আত্মজীবনী তাই কতটুকু সত্য আর কতোটুকু বানোয়াট, এই নিয়ে বিতর্কটাও চিরকালীন।
এখানে নৈতিকতার প্রশ্ন যেমন আসে, আসে ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমের কথাও। লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলোর প্রাইভেসি কি তিনি ভাঙতে পারেন? পরিবার বা প্রিয়জনের সঙ্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথা লেখার আগে তাঁদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন কি তিনি বোধ করেন? যদি অনুমতি নেন, বলা যাবে লেখক তাঁর মোরাল কোড মেনেছেন। কিন্তু এরপর? প্রিয়জনেরা যদি দলবেঁধে এসে বলে, ‘এই জায়গাটা পছন্দ হলো না, ওইখানে তোমার দোষ ছিল, অথচ তুমি নিজেকে সাধু বানাইলা, বা এই জায়গাটা তুমি ভুল লিখেছ, আমি তোমারে এসব লেখার অনুমতি দিতে পারব না’, এ রকম পরিস্থিতিতে লেখক কী করবেন? তিনি কি লিখবেন না তাহলে আত্মজীবনী?
ব্যাপার হলো লিখবেন, এবং লিখতে বসলে তাঁকে কেউ আর ঠেকাতে পারে না। এখানেই তাঁর জিনিয়াস, এখানেই তাঁর উত্থান ও পতন, সব কিছু। যেমন নরওয়ের লেখক কার্ল অভে নুসগার্দ। ছয় খণ্ডে লেখা তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘মাই স্ট্রাগল’ বা আমার সংগ্রাম, ইউরোপে ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? এক সাক্ষাৎকারে নুসগার্দ বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো একটা ডেভিলস বার্গেইন করেছি, নিজের জীবনের গোপন প্রকাশ্য সব উপাদান আমার উপন্যাসে ব্যাবহার করে বিপুল সাফল্য পেয়েছি। বিনিময়ে হারিয়েছি আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে।’ ‘মাই স্ট্রাগল’-এ যা কিছু লিখেছিলেন, তা ওঁর কাছের মানুষদেরকে ব্যাপক আহত করেছিল। এমনই আহত করেছিল যে তাঁরা নুসগার্ডের সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখেননি।
এর বিপরীতে আমাদের মনে পড়ে গুন্টার গ্রাসের কথাও। পশ্চিমা জাদুবাস্তববাদের আধুনিক চাবিকাঠি বলা হয় যে যুদ্ধ উপন্যাসকে, সেই ‘টিন ড্রাম’-এর লেখক জীবনসায়াহ্নে এসে প্রকাশ করেছিলেন ‘পিলিং দ্য অনিয়ন’ নামের আত্মজীবনী। যে বইয়ে তিনি অকপটে প্রকাশ করে দেন সারা জীবন ধরে লুকিয়ে রাখা এক তথ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিটলার্স ইয়ুথ নামের কিশোর সংগঠনের সদস্য হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন গ্রাস। নোবেলজয়ী মানবতাবাদী লেখক হিসেবে এই তিক্ত সত্যের প্রকাশ অনেক কঠিন একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু গ্রাস শেষ পর্যন্ত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি। স্বীকার করেছিলেন নিতান্ত অল্প বয়সে নেওয়া জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারতম ভুল সিদ্ধান্তের কথা।
আত্মজৈবনিকের কথা এলে আরেক নোবেলজয়ী এনি আর্নোর কথা না বললে চলে না। তাঁর সাহিত্যিক গতিপথই নির্মিত হয়েছে অকপট আত্মজৈবনিক সব ন্যারেটিভ দিয়ে। এইসব লেখায় তিনি বর্ণনা করেছেন নিজের ঈর্ষার কথা, গোপন ক্ষোভের কথা, যৌন আকাঙক্ষার বিবরণী, স্মৃতি ও বিভ্রমের দোলাচল। পড়তে পড়তে মনে হয়, ভালো মানুষ হওয়ার, গ্রেট হওয়ার, আড়াল রাখার কোনো চাপ আর্নোর নেই।
তবে ভালো কিছু হয়ে ওঠার, সাধু-সন্ন্যাসী ধরনের উদাসীন বা মহৎ হয়ে ওঠার চেষ্টা বাঙালি লেখক হিসেবে আমি মনে হয় বেশি আবিষ্কার করেছি আমাদের লেখকদের আত্মজৈবনিক পড়তে গিয়েই। এর পেছনে আমাদের সোশাল কন্ডিশনিংয়ের ভূমিকা যে নেই, তা অস্বীকার করব না। আমাদের এখানে এটা প্রচলিত আছে যে লেখককে খুব বড় মাপের মানুষ হতে হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে হয়, শুভবোধ সম্পন্ন হয়তে হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় ইত্যাদি।
বাংলাদেশে আমার পছন্দের লেখকদের কারও আত্মজীবনীকেই আমি তাই জীবনী হিসেবে পড়তে পারি না। এত নিটোল, এত উপভোগ্য। জীবন তো উপন্যাস নয়, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আল মাহমুদ বা নির্মলেন্দু গুণ– এঁদের সবার আত্মকথাই গল্প উপন্যাসের মতো।
বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক রচনাগুলো এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। খুলে বলি।
আমরা এখন বাস করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রিলসের যুগে। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বিছানার চাদর, রান্নার হাঁড়ি, পোষা বেড়াল, বাচ্চার ডায়াপার, উদ্যাপিত দাম্পত্য কলহ ও প্রেম দিয়ে নির্মিত একটা ফ্যাব্রিকেটেড জীবন আমরা অনবরত সাবস্ক্রাইব করি বা কিনি। হুমায়ূন আহমেদ এই কাজ সফলভাবে করেছিলেন সময়ের অনেক আগেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না সে যুগে; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে নির্মিত কন্টেন্ট পাঠকদের সার্ভ করতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শুধু একজন বড় মাপের গল্পকারই নন, তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় পপকালচার আইকনদের একজন হিসেবে নিজের বেডরুমকে ড্রয়িংরুমকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে মানুষটা ছিলেন পাইওনিয়র। তাঁর যে কোনো আত্মজৈবনিক লেখাই আধুনিক ডেইলি ভ্লগসের প্রি-কোড হওয়ার সব শর্ত পূরণ করে।
এসব বলে আমি যে আর্গুমেন্টটা তৈরি করতে চাইছি, তা জটিল কিছু নয়। নিজের ইচ্ছেমতো আত্মজৈবনিক রচনাকে দোষের কিছু বলে আমি মনে করি না। লেখক কী লিখবেন, প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো মোরাল কোড মানবেন কি না, বা ক্রিয়েটিভ স্বাধীনতা বর্জন করবেন কি না, এসবের পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু এটা তো ডেভিলস বার্গেইনই। এর পরিণতি ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ দায়ভারও লেখককে নিতে হবে। এসব তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না, জীবদ্দশায় তো বটেই, এমনকি মৃত্যুর পরেও।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
লেখালেখির জগতে আত্মজৈবনিক রচনা সব সময়েই নানান তর্কের জন্ম দিয়ে গেছে। বিখ্যাত কেউ হলে তো কথাই নেই, এমনকি অখ্যাত লেখকও নিজের জীবনকথায় খ্যাতিমানদের নিয়ে আলাপ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন, এ রকম অসংখ্য উদাহরণ মিলবে।
এ ধরনের রচনায় অলিখিত ঘোষণা থাকে যে এসব বাস্তব, পড়তে বসে পাঠকেরা ধরেই নেন তারা যা পড়ছেন তা লেখকের জীবনে ঘটে গেছে। এবং খেয়াল করে দেখবেন, যে কোনো সুলিখিত আত্মজৈবনিক রচনা পাঠকের মনস্তত্ত্বে একটা দাগ রেখে যায়। প্রিয় লেখক, গায়ক, নায়ক, বা খেলোয়াড় নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত যে কল্পনার মিউজিয়াম, সেই কল্পমিউজিয়াম নির্মাণ করে দেয় তাঁর জীবনের নানান ঘটনাবলি।
সেলিব্রেটিদের কর্ম শুধু নয়, কাণ্ড এবং জীবন যাপনও মানুষ সাবস্ক্রাইব করতে ভালোবাসে। তাঁদের নিয়ে গসিপ—কে কয়টা বিয়ে করল, কে কার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াল, ঋণের দায়ে ডুবে গেলো কে, কার ছেলে ড্রাগ নিয়ে ধরা খেলো পুলিশের হাতে। অর্থাৎ তাঁদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পপকালচারের অংশ বা বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে ওঠে। ইমতিয়াজ আলির রকস্টার সিনেমায় যেমন মিউজিক প্রডিউসার ঢিংড়া উঠতি গায়ক জনার্দনকে বলে, ‘গান কেউ কেনে না, কেনে গায়কের ইমেজ।’
আমার একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ: এই ‘ইমেজ’ নিয়ে সাহিত্যিকেরা যত ভাবেন, আর কোনো মাধ্যমের সেলেব্রিটিরা অতটা ভাবেন বলে মনে হয় না। আত্মজৈবনিক রচনার সময় অধিকাংশ লেখকের মধ্যে একটা সেলফসেন্সর কাজ করে। নিজেদের খুব ভেবেচিন্তে পোর্ট্রে করতে চান তাঁরা, যেখানে তাঁদের শিল্পভাবনা, ব্যক্তিত্ব, লেখালেখির কৌশলের পাশাপাশি থাকে পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থন বা ভিক্টিম কার্ডের ব্যবহার। মানুষের জীবন যেহেতু ঘটতে থাকা একটা ব্যাপার, বা র্যান্ডম, সচেতন কোনো নির্মাণ নয়, লেখকদের সুচিন্তিত সাজানো আত্মজীবনী তাই কতটুকু সত্য আর কতোটুকু বানোয়াট, এই নিয়ে বিতর্কটাও চিরকালীন।
এখানে নৈতিকতার প্রশ্ন যেমন আসে, আসে ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমের কথাও। লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলোর প্রাইভেসি কি তিনি ভাঙতে পারেন? পরিবার বা প্রিয়জনের সঙ্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের কথা লেখার আগে তাঁদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন কি তিনি বোধ করেন? যদি অনুমতি নেন, বলা যাবে লেখক তাঁর মোরাল কোড মেনেছেন। কিন্তু এরপর? প্রিয়জনেরা যদি দলবেঁধে এসে বলে, ‘এই জায়গাটা পছন্দ হলো না, ওইখানে তোমার দোষ ছিল, অথচ তুমি নিজেকে সাধু বানাইলা, বা এই জায়গাটা তুমি ভুল লিখেছ, আমি তোমারে এসব লেখার অনুমতি দিতে পারব না’, এ রকম পরিস্থিতিতে লেখক কী করবেন? তিনি কি লিখবেন না তাহলে আত্মজীবনী?
ব্যাপার হলো লিখবেন, এবং লিখতে বসলে তাঁকে কেউ আর ঠেকাতে পারে না। এখানেই তাঁর জিনিয়াস, এখানেই তাঁর উত্থান ও পতন, সব কিছু। যেমন নরওয়ের লেখক কার্ল অভে নুসগার্দ। ছয় খণ্ডে লেখা তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘মাই স্ট্রাগল’ বা আমার সংগ্রাম, ইউরোপে ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? এক সাক্ষাৎকারে নুসগার্দ বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো একটা ডেভিলস বার্গেইন করেছি, নিজের জীবনের গোপন প্রকাশ্য সব উপাদান আমার উপন্যাসে ব্যাবহার করে বিপুল সাফল্য পেয়েছি। বিনিময়ে হারিয়েছি আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে।’ ‘মাই স্ট্রাগল’-এ যা কিছু লিখেছিলেন, তা ওঁর কাছের মানুষদেরকে ব্যাপক আহত করেছিল। এমনই আহত করেছিল যে তাঁরা নুসগার্ডের সঙ্গে আর সম্পর্কই রাখেননি।
এর বিপরীতে আমাদের মনে পড়ে গুন্টার গ্রাসের কথাও। পশ্চিমা জাদুবাস্তববাদের আধুনিক চাবিকাঠি বলা হয় যে যুদ্ধ উপন্যাসকে, সেই ‘টিন ড্রাম’-এর লেখক জীবনসায়াহ্নে এসে প্রকাশ করেছিলেন ‘পিলিং দ্য অনিয়ন’ নামের আত্মজীবনী। যে বইয়ে তিনি অকপটে প্রকাশ করে দেন সারা জীবন ধরে লুকিয়ে রাখা এক তথ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিটলার্স ইয়ুথ নামের কিশোর সংগঠনের সদস্য হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন গ্রাস। নোবেলজয়ী মানবতাবাদী লেখক হিসেবে এই তিক্ত সত্যের প্রকাশ অনেক কঠিন একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু গ্রাস শেষ পর্যন্ত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি। স্বীকার করেছিলেন নিতান্ত অল্প বয়সে নেওয়া জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারতম ভুল সিদ্ধান্তের কথা।
আত্মজৈবনিকের কথা এলে আরেক নোবেলজয়ী এনি আর্নোর কথা না বললে চলে না। তাঁর সাহিত্যিক গতিপথই নির্মিত হয়েছে অকপট আত্মজৈবনিক সব ন্যারেটিভ দিয়ে। এইসব লেখায় তিনি বর্ণনা করেছেন নিজের ঈর্ষার কথা, গোপন ক্ষোভের কথা, যৌন আকাঙক্ষার বিবরণী, স্মৃতি ও বিভ্রমের দোলাচল। পড়তে পড়তে মনে হয়, ভালো মানুষ হওয়ার, গ্রেট হওয়ার, আড়াল রাখার কোনো চাপ আর্নোর নেই।
তবে ভালো কিছু হয়ে ওঠার, সাধু-সন্ন্যাসী ধরনের উদাসীন বা মহৎ হয়ে ওঠার চেষ্টা বাঙালি লেখক হিসেবে আমি মনে হয় বেশি আবিষ্কার করেছি আমাদের লেখকদের আত্মজৈবনিক পড়তে গিয়েই। এর পেছনে আমাদের সোশাল কন্ডিশনিংয়ের ভূমিকা যে নেই, তা অস্বীকার করব না। আমাদের এখানে এটা প্রচলিত আছে যে লেখককে খুব বড় মাপের মানুষ হতে হয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে হয়, শুভবোধ সম্পন্ন হয়তে হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় ইত্যাদি।
বাংলাদেশে আমার পছন্দের লেখকদের কারও আত্মজীবনীকেই আমি তাই জীবনী হিসেবে পড়তে পারি না। এত নিটোল, এত উপভোগ্য। জীবন তো উপন্যাস নয়, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আল মাহমুদ বা নির্মলেন্দু গুণ– এঁদের সবার আত্মকথাই গল্প উপন্যাসের মতো।
বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের আত্মজৈবনিক রচনাগুলো এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। খুলে বলি।
আমরা এখন বাস করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রিলসের যুগে। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বিছানার চাদর, রান্নার হাঁড়ি, পোষা বেড়াল, বাচ্চার ডায়াপার, উদ্যাপিত দাম্পত্য কলহ ও প্রেম দিয়ে নির্মিত একটা ফ্যাব্রিকেটেড জীবন আমরা অনবরত সাবস্ক্রাইব করি বা কিনি। হুমায়ূন আহমেদ এই কাজ সফলভাবে করেছিলেন সময়ের অনেক আগেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না সে যুগে; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে নির্মিত কন্টেন্ট পাঠকদের সার্ভ করতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শুধু একজন বড় মাপের গল্পকারই নন, তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় পপকালচার আইকনদের একজন হিসেবে নিজের বেডরুমকে ড্রয়িংরুমকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে মানুষটা ছিলেন পাইওনিয়র। তাঁর যে কোনো আত্মজৈবনিক লেখাই আধুনিক ডেইলি ভ্লগসের প্রি-কোড হওয়ার সব শর্ত পূরণ করে।
এসব বলে আমি যে আর্গুমেন্টটা তৈরি করতে চাইছি, তা জটিল কিছু নয়। নিজের ইচ্ছেমতো আত্মজৈবনিক রচনাকে দোষের কিছু বলে আমি মনে করি না। লেখক কী লিখবেন, প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো মোরাল কোড মানবেন কি না, বা ক্রিয়েটিভ স্বাধীনতা বর্জন করবেন কি না, এসবের পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু এটা তো ডেভিলস বার্গেইনই। এর পরিণতি ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ দায়ভারও লেখককে নিতে হবে। এসব তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না, জীবদ্দশায় তো বটেই, এমনকি মৃত্যুর পরেও।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
জম্বিরা শেয়ার বাজারের ‘ভ্যালু স্টক’। জম্বিরা কথা বলে না, শরীর থেকে রস চুঁইয়ে পড়ে আর মগজটাও অকেজো। কিন্তু ওরা এমন এক বস্তু, যার বাজারদর কখনো কমে না। এর যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
৩ দিন আগেতাহসানের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘কথোপকথন’। জি সিরিজের ব্যানারে রিলিজ হয় ২০০৪ সালে। অর্থাৎ একুশ বছর আগে। হালচালে এসে যখন তিনি গান ছাড়ার ঘোষণা দেন; তখন জানান, এ বয়সে এসে ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ আর গাইতে চান না।
৬ দিন আগেগতকাল থেকে ফেসবুকে দেখতেছি, সবাই বন্ধু হইতে চায়। আমার বন্ধু হইতে চায় না। ডিয়ার রিডার, আপনারও বন্ধু হইতে চায় না, স্যরি; সবাই বন্ধু হইতে চায় স্বপ্নীলের।
৭ দিন আগেজেন-জি’রা কর্মী হিসেবে অলস। এই অভিযোগ কর্পোরেট বস মহলে কমন। আসলেই কি তাই? জেন-জি’রা কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হল। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরি ছাড়ার রেটে তারা এগিয়ে আছে, চাকরিতে তারা পুরো মনোযোগ দেয় না –এসব নালিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রবল। আরেকদিকে জেন-জি টিকটকার, রিলমেকার, লেখকরা বলছে এই প্রবণতাগুলো সত
১০ দিন আগে