leadT1ad

হ্যাকারদের নজরে ব্যাংকের পেজ, ওয়েসবসাইট; কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ–আত্মসাৎ, ফলোয়ার বাড়ানো বা ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে অনলাইন স্পেসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় হ্যাকারেরা। আর সহজেই ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ সাইবার সুরক্ষার বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়া।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৫৯
প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ হ্যাক হয়েছে। গত শুক্রবার ভোর পৌঁনে ছয়টায় পেজটি হ্যাকারেরা দখলে নেয়। এর ১২ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে পেজটি ফের হ্যাকারদের দখলে যায়। ব্যাংকের পেজ বা ভার্চ্যুয়াল সম্পদ হ্যাক হওয়ার এমন ঘটনা নতুন নয়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ, পুলিশের পেজ, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এবং সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ–আত্মসাৎ, ফলোয়ার বাড়ানো বা ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে অনলাইন স্পেসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় হ্যাকারেরা। আর সহজেই ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ সাইবার সুরক্ষার বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়া। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। পেজ হ্যাক হলেও অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় না; এমনকি সাধারণ ডায়েরিও করা হয় না অনেক ক্ষেত্রে।

গত বছরের ২৩ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল হ্যাকারেরা। এর আগের দিন ২২ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়। ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়েবসাইটের ঠিকানার হোমপেজে লেখা ছিল, ‘হ্যাকড বাই রেজিস্ট্যান্ট’। পুলিশ সদস্য ও কুকুরের ছবি দিয়ে ওপরে লেখা ছিল, ‘অপারেশন হান্টডাউন, স্টপ কিলিং স্টুডেন্ট’। অবশ্য হ্যাকিংয়ের আধা ঘণ্টা পরই বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়েবসাইটটি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

এই একই হ্যাকার গ্রুপ ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশ এবং বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটও হ্যাক করেছিল। হ্যাকড ওয়েবসাইটে লেখা ছিল, ‘ওয়েবসাইট হ্যাকড বাই R3SISTANC3’। এর নিচে লেখা ছিল, ‘অপারেশন হান্টডাউন। স্টপ কিলিং স্টুডেন্টস।’

২০২৪ সালেই সরকারি একাধিক সংস্থার ফেসবুক পেজ হ্যাক করা হয়। এর মধ্যে জুলাইয়ের ৯ তারিখ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়। পেজটি উদ্ধার করতে লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। এ ছাড়া চলতি বছরের ৪ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ হ্যাক হয়। এর আগে ২০১৫ সালে সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছিল।

তবে ওয়েবসাইট ও পেজ হ্যাক হওয়ার ঘটনার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। অজ্ঞাতপরিচয় ওই ব্যক্তিরা বিশ্বের অন্যতম সাইবার সুরক্ষিত সুইফট পেমেন্টের মধ্যে ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। তবে চুরির ওই ঘটনার পরপরই তা জানায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করা হয় প্রায় ৩৯ দিন পর।

কেন হয় হ্যাকিং

বিভিন্ন সময় একাধিকবার কেন পেজগুলা হ্যাক করা সম্ভব হচ্ছে, এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্রিম।

তাঁরা বলছেন, ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই ধরনের অপরাধগুলো সংগঠিত হচ্ছে। কখনো অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে, কখনো ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য আবার কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এই কাজগুলো করে হ্যাকাররা। মামলা বা জিডি হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।

ইসলামী ব্যাংকের ফেসবুক পেজ হ্যাকিং নিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, পেজ হ্যাকের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এই ব্যাপারে পুলিশের কাছে এখনও কোনো মামলা আসেনি, সেজন্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে হ্যাক হয়েছে কি না। তবে জনসাধারণকে যেকোনো ধরনের ওটিপি শেয়ার করা থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক তৈয়বুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে এই অ্যাটাকগুলো হতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাবে, তত এই ধরণের সাইবার অ্যাটাক বাড়বে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিকিউরিটি সিস্টেম শক্তিশালী করতে হবে।’

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পেজ কীভাবে হ্যাক হচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিয়ে কাজ করছি না, আমরা ডাটাবেজের সুরক্ষা দিতে কাজ করছি। সোশ্যাল মিডিয়া তো তথ্যভাণ্ডার না, তো এটাকে আমরা এত গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। যেটা তথ্যভাণ্ডার, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।’

কীভাবে হয় হ্যাকিং

আইটি কনসাল্টিং ফার্ম ডিকোড ল্যাবের চিফ টেকনোলজি অফিসার আরিফ মঈনুদ্দিন স্ট্রিমকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ফেসবুক পেজ হ্যাক হয়েছে; ওয়েবসাইট হ্যাক হয়নি। ফেসবুক পেজের যে সংকটাপন্ন অবস্থা, সেটি হচ্ছে স্প্যামাররা পেজের কোনো একটা কমেন্টের ওপর রিপোর্ট করে। বিভিন্ন ধরনের কপিরাইট বা ট্রেডমার্ক ইস্যু বৃদ্ধি করে রিপোর্ট করা হয়, তারপর ফেসবুক থেকে এটা ডিজেবল করে দেওয়া হয়। পরে আপিল করলে ফেসবুক আবার ফেরতও দেয়। বৈধ পেজ এবং কন্টেন্টের অথেনটিসিটি থাকলেও কোনো না কোনো একটা দুর্বলতা ধরে সেটাকে ব্যবহার করে স্প্যামাররা এ রকম কাজ করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি সাইটগুলো সব থেকে বেশি সংকটাপন্ন। কারণ হচ্ছে, এই ওয়েবসাইটগুলো এস ডি এল সি (সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট লাইফ সাইকেল) মেইনটেইন করে তৈরি করা হয় না। সরকারি ওয়েবসাইটগুলি একই টেমপ্লেট ব্যবহার করে। এক টেমপ্লেটের যদি দুর্বলতা থাকে, আরও যে ওয়েবসাইটে তা কপি করা হয়েছে, সেম দুর্বলতা সেখানেও থাকবে। আরেকটা হচ্ছে ওয়েবসাইটগুলো বানানোর পরে নিরাপত্তা সমীক্ষা করা হয় না; ভিএবিটি করা হয় না। হ্যাকারেরা এই সুবিধাগুলো নেয়।

সিস্টেমের দুর্বলতা খুঁজে বের করে ওয়েবসাইটের ডাটাবেজে ঢুকে হ্যাক করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সমাধান কী

সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ‘সবার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট’ এর প্রতিষ্ঠাতা জেনিফার আলম বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণত যেই সিস্টেমটি সরবরাহ করে সেগুলোর লুপহোলস থেকে যায়। অনেক অপশন আমাদের দেশ থেকে অ্যাপ্লাই করা সম্ভব হয় না, কখনো আমাদের তরফ থেকে সবগুলো সিকিউরিটি স্টেপ কমপ্লিট করা হয় না।’

তিনি আরও বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া বিদেশি প্ল্যাটফর্ম, এখানে সাধারণত মিনিমাম সিকিউরিটি প্রোভাইড করা হয়। যদি সবগুলা স্টেপ অন থাকে তাহলে ঝুঁকি কমে যায়। পেজগুলোতে দেখা যায় একাধিক অ্যাডমিন থাকেন, তাঁদের সবার আইডি সুরক্ষিত রাখতে হবে।

হ্যাকিং এড়াতে ওটিপি শেয়ার না করা, ফিশিং লিংক, থার্ড পার্টি অ্যাপ লগইন না করা, কিউআর কোড শেয়ার না করা, আনওয়ান্টেড ফাইল ওপেন না করা, অপরিচিত আইডি থেকে দেওয়া লিংক ওপেন না করার পাশাপাশি অ্যাডভান্স প্রিমিয়াম সুবিধা নেওয়া উচিত। তবে ব্যাংকিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপত্তাব্যবস্থা আলাদা। একটার সঙ্গে অন্যটার মিলের কোনো সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত