চার্লি চ্যাপলিনের গল্পটা হয়তো শুনে থাকবেন। না শুনলেও সমস্যা নাই। এবার শুনে নিন। একবার কোথাও ভ্রমণে গেছিলেন এ অভিনেতা। পথে এক জায়গায় প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। বিষয় চার্লি চ্যাপলিনকে যে সবচেয়ে ভালো অনুকরণ করতে পারবে সে-ই জয়ী। তিনিও প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেন। ধারণা ছিল জিতেই যাবেন। যেহেতু একই কাজ তিনি অনেকবার করেছেন। কিন্তু না! চার্লি চ্যাপলিন ফার্স্ট হতে পারলেন না। চার্লি চ্যাপলিন হওয়া সবার কাজ না আসলে।
গল্পটা সত্যি না মিথ্যা—এমন তর্ক হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চার্লি চ্যাপলিন কি চাইলেই অনুকরণ করতে পারতেন। এটা কি শুধু আইকনিক গোঁফ, কোট-টাই, লাটি হাতে হাঁটার বিষয় বা অঙ্গভঙ্গি; নাকি অন্য কিছু! আজব মনে হলেও জ্ঞানতত্ত্বের ক্লাসে এমন প্রশ্ন শুনতে পারবে; আলুকে কেন আমরা আলু বলি? চার্লি চ্যাপলিনের জায়গা বলি হুমায়ূন আহমেদ কখন হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেন? হুমায়ূন-পরবর্তীকালে হুমায়ূন হইতে চাওয়া লোকের সংখ্যা তো কম না। কিন্তু হুমায়ূন নিজেও কি নিজের অনুকরণে সফল? ভঙ্গি সর্বস্ব হয়ে যান না তো। মোটা দাগে এর একটা উদাহরণ দেবো, যেখানে তিনি ব্যর্থ।
হুমায়ূন গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমা-গান করেছেন। তার গল্পে অন্যরাও সিনেমা বানিয়েছে। শঙ্খনীল কারাগার, দারুচিনি দ্বীপ, দেবী, দূরত্ব, নিরন্তর এমন কিছু নাম দ্রুত মুখে চলে আসবে। হুমায়ূন যুক্ত আছেন এমন একটা সিনেমর কথা খুব একটা বলা হয় না। এটা কোনো উপন্যাস থেকে নির্মিত না। সুভাষ দত্তর জন্য গল্প লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। নাম ‘আবদার’ (১৯৯৩)।
নির্মাতা হিসেবে বড় সময়জুড়ে সুভাষ দত্ত শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক ধারার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। সুতরাং, আয়না ও অবশিষ্ট, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ডুমুরের ফুল বা বসুন্ধরায় এমন চেষ্টা দেখা গেছে। পরের দিকে নাজমা বা ফুলশয্যা ছিল প্রচলিত ঘরানার যাকে ফর্মূলা চলচ্চিত্র বলা হয়। বড়পর্দার জন্য উনার শেষ সিনেমা ছিল ‘আবদার’। যার সম্পর্কে সৌমিক হাসান সোহাগ লিখেছেন, ‘সুভাষ দত্ত কখনোই নিজেকে বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক হিসাবে ভাবতে চায়নি। অনেকটাই জীবন জীবিকার তাগিদে, নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখার জন্যেই তিনি বাণিজ্যিক সফল ছবিগুলো পরিচালনা করেছেন। পরিচ্ছন্ন সামাজিক ছবিগুলোর সাফল্যের কারণে সুভাষ দত্ত নিজের ইচ্ছার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন আবদার (১৯৯৩) নামে একটি ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা করে। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল না হওয়ায় চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।‘ (চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত জীবন ও কর্ম, ড. মাসুদ রেজা, জুন ২০১৯, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, পৃষ্টা ২২০)
গল্পকার কে তা না জেনে সিনেমাটি দেখলে, অনেক কিছু পরিচিত মনে হবে; কোথায় যেন দেখেছি। প্রথমত সিনেমার গল্প। ফর্মূলা বাংলা সিনেমার কয়েকটি আদিকল্প আছে। যার একটি— সিনেমার এক বা একাধিক চরিত্র ছোটবেলায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এতে অনুঘটক হিসেবে থাকবে ভিলেন। পরে তাদের মিলন হবে। এতে কোনো না কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকবে, যা বিচ্ছিন্ন পরিবারকে একত্রিত করবে। এমন একটা (প্রায়শ সামন্ততান্ত্রিক মেটাফোরে ভরপুর) গল্প সাধারণত যেভাবে ট্রিটমেন্ট পাওয়ার কথা, তা-ই ‘আবদার’। এর বাড়তি এমন কিছু বিষয় আছে; যা গড়পরতা সিনেমায় দর্শক না দেখলেও পরিচিত। যেমন পাতার বাঁশি বাজাবে বাবা চরিত্র, আলাভোলা টাইপ দ্বিতীয় নায়ক বা অদ্ভুত কিছু সংলাপ।
এমন একটা অসফল সিনেমায় হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে অনুকরণ করেছেন বলে মনে হয়; হুমায়ূনীয় ধাঁচ হিসেবে পরিচিত কৌতুক বা চরিত্র নির্মাণে। কথা হলো, এমন কাহিনীর শত শত সিনেমা ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে সফল হলে এটি কেন নয়! হুমায়ূন আহমেদকে মাথায় রাখলে মনে হতে পারে সেটা সম্ভব না। কারণ হুমায়ূন আহমেদ হয়তো টিপিক্যাল বাংলা সিনেমাই লিখতে গিয়েছেন। সুভাষ দত্ত তা-ই চেয়েছিলেন বা হুমায়ূন তেমনই ভেবেছিলেন যাকে বাংলা সিনেমা ভাবা হয়। এর ওপর নিজের কমন কিছু থিম প্রয়োগ করেছেন।
সুভাষ দত্ত পরিচালিত আবদার সিনেমার পোস্টার। ছবি: বিএমডিবিকিন্তু সমাজে যা কিছু টিপিক্যাল তাকে টিপিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিতে গিয়ে হয়তো আমরা এসেন্সটা হারিয়ে ফেলি। মানে যে ঘটনাকে সহজ-সরল অনুকরণযোগ্য বলে ভাবা হয়; তা আদতে তেমন নাও হতে পারে। দৃশ্য দিয়ে বর্ণিত যেকোনো ঘটনা দৃশ্যাতীত কিছু বলতেও পারে। যেমন, হুমায়ূন আহমেদ চাইলেই কখনো কাশেম বিন আবু বকরকে অনুসরণ করতে পারতেন না। বিসমিল্লাহ বলে প্রেম করলেই সেটা কাশেম বিন আবু বকর হবে না। আমার অনুমান, বাংলা সিনেমা বা উপমহাদেশের সাবেকী ধারার গল্পে মানুষজন হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে আসা, তা শুধু ফিজিক্যাল কোনো ঘটনা না। বরং এখানকার সমাজ যে পরিবারিক মূল্যবোধের ওপর গড়ে উঠে তার দিক থেকে দেখার ঘটনা। নায়ক বা কোনো চরিত্র যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; সে মূলত বড় হওয়ার কালে সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ থকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হুমায়ূন আহমেদের গল্পের যে ধরন; তাতে এমন সাবেকী ধারার মূল্যবোধ থাকার কথা না। তিনি যে মধ্যবিত্তে ফ্যাংশন করতেন তারা এ গল্পকে হাস্যকরভাবে নিত এবং এর মূল্য তাদের বয়ানে অনুপস্থিত। এটা ঠিক বা বেঠিকের বিষয় না। মানে হুমায়ূনের মধ্যে থাকলেও অন্যভাবে হয়তো আছে। কিন্তু শত শত ‘বাংলা সিনেমা’ যেভাবে বলে বা দর্শকের হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়; তা থাকে না আরকি! দৃশ্যের আড়ালে কিছু একটা মিসিং থাকে।
হুমায়ূনের সিনেমায় এ হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কেমন? ‘দুই দুয়ারী’র (২০০০) কথা মনে আছে? যেখানে রহস্য মানব চরিত্রটি কোথা থেকে এসেছে আর কোথা যাবে কেউ জানে না। মাথায় সাদা ক্যাপ পরা চরিত্রটির মনে নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু তা সুরাহা না হলেও চলে। বরং একটা সামান্য জগতে সে নিজেকে ধরতে পেরেই খুশি।যেখানে শিশির কনারও আছে একান্ত আনন্দময় জীবন। এর সঙ্গে তুলনা করলে বাংলা সিনেমার ফর্মূলাভিত্তিক চরিত্রগুলো ভিন্ন; তাদের একটা গন্তব্য লাগে। সামাজিক গন্তব্য। তাদের টেবুলা-রাসা বা শাদা কাগজ হইলে চলে না।
যাই-হোক; হুমায়ূন আহমেদ হয়তো ফর্মূলাভিত্তিক গল্প হিসেবে চেখে দেখতে ‘আবদার’-এর অংশ হয়েছিলেন। এটা নিশ্চিতভাবে হয়তো জানা যাবে না। এরপর তিনি আর এমন গল্প লিখেন নাই। অবশ্য ফরমামেশি কাজ হিসেবে ধরলেও এটা একই ধরনের বিষয় নাটক-সাহিত্যে ঘটে নাই। যেমন উনার এনজিওধর্মী ধারাবাহিক আছে: সবুজ ছায়া। সেখানে রসগোল্লার ভাঁজের ট্যাবলেট খাওয়ার মতো গল্প বলেছেন। তার তৈরি দর্শক সেটা পছন্দ করেছে। সেটা হুমায়ূনের কমফোর্টজোন ছিল। সাহিত্যও তার কমফোর্ট।
উইলিয়াম পিটার ব্লেটির বিখ্যাত পিশাচ কাহিনী দি একসরসিস্ট-এর হুমায়ূনের ভাবানুবাদ পড়লে বুঝতে পারবেন, অন্যরে গল্পের কাঠামো কীভাবে হুমায়ূনীয় ভঙ্গি ধারণ করে এবং সুখপাঠ্য হয়ে উঠে। আরো ভালো উদাহরণ বোধহয় এ কে কুইন্যালের ম্যান অন ফায়ার– এর বাঙলায়ন ‘অমানুষ’।
ফরমায়েশি ব্যাপারটা বোঝাতে দি একসরসিস্ট অনুবাদের ভূমিকা থেকে পড়তে পারেন— ‘একবার খুব অর্থকষ্টে পড়েছিলাম। আমেরিকা থেকে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেশে ফিরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যে বেতন পাওয়ার কথা- ছ’মাস তা পাচ্ছি না। কাগজপত্রের কি যেন অসুবিধা। এর তার কাছে ধার করতে হচ্ছে। তখন শুনলাম কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ভৌতিক বা গোয়েন্দা জাতীয় উপন্যাস অনুবাদ করে দিলে নগদ টাকা দেন। রাত জেগে অনুবাদ করলাম উইলিয়াম পিটার ব্লেটির দি একসরসিস্ট। পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে দেয়ামাত্র তিনি আমাকে দু’হাজার টাকা দিলেন। টাকাটা খুব কাজে লাগল।’ সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। আবদারের গল্পও তেমন ফরমায়েশ কিনা জানি না; নাকি সুভাষ দত্তর আবদার। এমন কিছু হতে পারে। এটা দারুণ একটা ঘটনা।
হুমায়ূনীয় ফর্মূলা যে চাইলেই প্রয়োগ করা যায় না; তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে। স্বয়ং হুমায়ূনও পারেন না। বুঝতে হবে চরিত্র নির্মাণ বা বাক্যের গঠনই হুমায়ূন না। আরো কিছু আছে। আশ্চর্যভাবে অনেকেই এমনটা ভাবেন!