leadT1ad

জাল হুমায়ূন: ফেবুদর্শন ও ডিজিটাল ফোক কালচার

ফেসবুকে এখন হুমায়ূনের অজস্র ক্লোন। তাঁর নামে উদ্ধৃতি ও দর্শন ছড়িয়ে পড়ছে নেটস্ফিয়ার সর্বত্র। এইসব জাল হুমায়ূনের দিনরাত্রি ও স্বভাব-চরিত্র নিয়ে এই লেখা।

স্ট্রিম গ্রাফিক

ফেসবুকের বিশাল দুনিয়ায় অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়। ফেসবুকবাসীই এদের নাম দিয়েছে ‘জাল হুমায়ূন আহমেদ’। তাঁরা লেখক নন, অথচ লেখেন। তাঁরা চিন্তাবিদ নন, অথচ প্রতিদিন নতুন চিন্তার জন্ম দেন। আসল হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে ঘুমিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর জাল সংস্করণেরা এখনো তুমুল সক্রিয়। ফেসবুক পোস্ট, কমেন্ট সেকশন, এমনকি টিকটক ভিডিয়োর ক্যাপশনেও রাজত্ব করছেন তাঁরা।

কেউ প্রেমে ব্যর্থ হলে, রাতের অন্ধকারে চা হাতে একাকী ছবি তুললে, বা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে চোখে পানি এলে, বোঝা যায়—তাঁর ওপর হুমায়ূনের আত্মা ভর করেছে। এই জাল হুমায়ূনের মধ্যে মেয়ে হুমায়ূনেরা সাধারণত এমনভাবে শুরু করে: ‘ভালোবাসা একটা নটি ব্যাপার। যখন খাঁচায় থাকে তখন মানুষ তাকে ইচ্ছে মতো ইউজ করা হয়, আর যখন মুক্ত থাকে তখনও ইচ্ছে মতো ইউজ করতে চায়। এরা আসলে ভালোবাসা নয়, অন্যকিছু চায়।’

তারপর নিচে পাঁচটা লাইক, দুইটা লাভ রিঅ্যাক্ট, আর এক ভদ্রলোকের কমেন্ট—‘কত গভীর কথা! হুমায়ূন স্যার তো জিনিয়াস ছিলেন!’ অথচ হুমায়ূন জীবিত থাকতে এমন কথা কোনোদিন বলেননি। বরং বেঁচে থাকলে হয়তো তখন তিনি কোনো রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে কল্পনায় শান্তিনিকেতনে বসে তরল পানীয় খেয়ে ঝুমতেন। আর ভাবতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এসব কী আলবাল লেখা লিখেছে। প্রকৃতি কেন রবীন্দ্রনাথকে কবি প্রতিভা দিলেন? সবকথা আগেই লেখে গেছেন, আমাদের জন্য কী রাখছেন?’

আসলে এসব জাল হুমায়ূন উক্তি এক ধরনের ডিজিটাল লোকসংস্কৃতি। কেউ হুমায়ূনের স্টাইল অনুকরণ করে লিখছেন, কেউ দুঃখের রাতে নিজের ব্যথা হুমায়ূনের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। কারণ নিজের নামে লিখলে পোস্টে রিচ কম, কিন্তু হুমায়ূনের নামে লিখলে সেটার রিচ বেড়ে যায় শতগুণ। হুমায়ূনের নাম এখন ফেসবুকের ‘অ্যালগরিদমিক তাবিজ’।

আনন্দের বিষয় হচ্ছে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে শত শত নতুন ‘হুমায়ূন’। এখানে কোনো লিঙ্গভেদ নেই। ছেলে-মেয়ে-তৃতীয় লিঙ্গ যেকেউ হুমায়ূন হতে পারেন। শুধু তাঁদেরকে ‘হুমায়ূনপিল’ খাইয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাঁদের কেউ বিজ্ঞাপনের ছোঁয়া লাগানো দর্শন দেন—‘কাজল চোখের মেয়ে, আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে, তোমার চোখে চেয়ে।’ কাজলের বিজ্ঞাপনে এই কবিতাটা দেখা গেছে। নিচে যথারীতি হুমায়ূন আহমেদের নাম। অথচ বেঁচে থাকলে এমন সস্তা লাইনের জন্য হুমায়ূন ওই কোম্পানির নামে মামলা করতেন। কেউ আবার বলেন, ‘প্রেম ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে সবকিছুই হালাল।’ এই কথাটিও তাঁরা নির্দ্বিধায় হুমায়ূনের নামে চালিয়ে দেন। যেন প্রাচীন রোম থেকে ফেসবুক পর্যন্ত এই উক্তির বৈজ্ঞানিক সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো।

আর কেউ বলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ ড্যাডি আছে, খারাপ শুগার ড্যাডি একটিও নেই।’

এই লাইন কি হুমায়ূন বলেছিলেন কোনোদিন? কিন্তু কমেন্টে দেখা যায়—‘স্যার, এইজন্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ কেউ কেউ আবার লেখেন, ‘স্যার, আপনিই আমাদের প্রেরণা।’ এর মধ্যেই এক শুগার ড্যাডি মন্তব্য করেন, ‘স্যার, আপনিও তো ভালো শুগার ড্যাডি। আপনাকে স্মরণ করেই আমরাও এই লাইনে এসেছি।’ এরপর ফেসবুক পেজ ‘সোবার’ তাদের ব্যান করে দেয়, কারণ তাদের ভাষায়, এই শুগার ড্যাডিরা হচ্ছে সমাজের বোঝা। শুগার ড্যাডি নিয়ে শুগার হুমায়ূন ড্যাডিরাই মাঝে মাঝে পোস্ট দেয়, ‘শুগার ড্যাডিদের এক অদ্ভুত দুর্বলতা হলো, তারা ভাবে, সব অল্প বয়সি নারীই তার প্রেমে পড়তে উন্মাদ হয়ে আছে।’ শুগার ড্যাডিদের অনেকেই মেয়েদের আকর্ষণ করার জন্য বলেন, ‘মেয়েদের আসল পরীক্ষা হচ্ছে শুগার ড্যাডিদের মেইনটেইন করা, ওই পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে সব পাশ!’

আসলে এসব জাল হুমায়ূন উক্তি এক ধরনের ডিজিটাল লোকসংস্কৃতি। কেউ হুমায়ূনের স্টাইল অনুকরণ করে লিখছেন, কেউ দুঃখের রাতে নিজের ব্যথা হুমায়ূনের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। কারণ নিজের নামে লিখলে পোস্টে রিচ কম, কিন্তু হুমায়ূনের নামে লিখলে সেটার রিচ বেড়ে যায় শতগুণ। হুমায়ূনের নাম এখন ফেসবুকের ‘অ্যালগরিদমিক তাবিজ’।

এসব জাল উক্তির ভেতরেও এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। হুমায়ূন হোক বা না হোক—এই বাক্যগুলো মানুষকে একটু ভাবায়, একটু হাসায়, কখনো প্রেমে ফেলে, কখনো ঠকায়। হয়ত এই কারণেই ফেসবুকের প্রতিটি দুঃখী রাতে নতুন করে জন্ম নেয় একেকজন ‘জাল হুমায়ূন আহমেদ’।

দেশে যারা রাজনীতি করেন, তাঁদের মধ্যে হুমায়ূন মিশে গেছেন। তাঁরা হুমায়ূনের কোটগুলোকে নিজেদের মতো বসিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেন। তাঁরা ফেসবুকে লেখেন, ‘পৃথিবীতে সব নারীদের ডাক উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু শেখ হাসিনার ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা প্রকৃতি আমাদের দেয়নি।’ নিচে অবশ্যই নাম থাকে হুমায়ূন আহমেদের। অনেকেই সেই পোস্টের নিচে কমেন্ট করেন, ‘মা আসবেই, দেশ হাসবেই।’ আবার অনেকেই মজা করে বলেন, ‘দেশ হাসবেই, হাসিনা জেলে নাঁচবেই।’

অনেকেই হুমায়ূনকে ‘লাভগুরু’ বলে থাকেন। তাঁর লেখার প্রেম, রোম্যান্স, ব্যথা—সবই মানুষের অনুভূতির সঙ্গে মিশে গেছে। ‘ছেলে আর মেয়ে বন্ধুত্ব করতে পারে, কিন্তু একসময় তারা একে অপরের প্রেমে পড়বেই’—এই উক্তিটিও ফেসবুকের প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ায়। কেউ জানে না এটা সত্যিই তাঁর লেখা কিনা, কিন্তু সবাই মেনে নেয় যেন এটা কোনো পবিত্রসূত্র। হয়ত এই বাক্য পড়েই কেউ প্রেমে পড়েছে, কেউ ভেঙেছে, কেউ বিয়ে পর্যন্তও পৌঁছে গেছে।

এভাবেই এক লেখক মারা গিয়েও তাঁর নাম বেঁচে আছে লাখ লাখ ‘জাল হুমায়ূন’-এর ভেতরে। বাস্তবের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ এখন ফেসবুকের ভার্চুয়াল দার্শনিক। যিনি মেয়েদের হাসির সময়ের সৌন্দর্য নিয়েও গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণ দেন, ‘মেয়েদের হাসি চেপে রাখার সময়ের যে সৌন্দর্য, তা যেন বলিউডের মাধুরীর মতো’। অবশ্য সেটিও তাঁর লেখা নয়।

তবু আশ্চর্য, এসব জাল উক্তির ভেতরেও এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। হুমায়ূন হোক বা না হোক—এই বাক্যগুলো মানুষকে একটু ভাবায়, একটু হাসায়, কখনো প্রেমে ফেলে, কখনো ঠকায়। হয়ত এই কারণেই ফেসবুকের প্রতিটি দুঃখী রাতে নতুন করে জন্ম নেয় একেকজন ‘জাল হুমায়ূন আহমেদ’।

হুমায়ূন নিজেও এসব দেখে হয়ত হেসে ফেলতেন। যেমন একবার নিউইয়র্কে ‘যদি মন কাঁদে’ গানটি গেয়েছিলেন শাওন। শুনে দর্শকদেরে একজন বলেছিলেন, ‘এই রবীন্দ্রসংগীত তো আগে শুনিনি।’ তখন হুমায়ূন বলেছিলেন, ‘যাক, এবার তবে রবীন্দ্রসংগীত লিখলাম।’

আজ হুমায়ূন বেঁচে থাকলে হয়ত নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিতেন— ‘প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। সবকিছুতে রহস্য থাকে। লোকে নিজেদের লেখাগুলো কেন যে আমার নামে প্রচার করে, সেই রহস্য আজও বুঝলাম না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত