.png)

মো কামরুল হাসান

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত জাতীয় পার্টিতে (জাপা) এবার দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়ে শুরু হয়েছে টানাটানি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও (সিইসি) নিশ্চিত নন লাঙলের আসল মালিক ভেঙে যাওয়া জাপার তিন উপদলের মধ্যে কোন পক্ষ।
এদিকে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার নেতৃত্বাধীন জাপার অংশটি বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অংশের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার স্ট্রিমকে বলেন, ‘আদালতই ঠিক করবেন প্রতীকের বৈধ দাবিদার কে।’ কবে রিট করবেন—এমন প্রশ্নে তিনি জানান, রিটের বিষয়ে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই বৈঠক করে তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই আইনি লড়াই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ কাঠামোকেই পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। অবশ্য জাপার নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রতীক নিয়ে এই সংঘাত যেমন বিভাজনকে গভীর করার আশঙ্কা তৈরি করেছে অপর দিকে তা দলের দ্বন্দ্ব মীমাংসার পথও খুলেছে। বিবদমান পক্ষগুলো শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৩তম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে ধারণা তাঁদের।
রেষারেষির শুরু যখন
জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সূচনা দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় থেকেই। এরশাদের মৃত্যুর আগ দিয়ে দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর আপসের মাধ্যমে জি এম কাদের চেয়ারম্যান এবং রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন।
তবে ওই আপস ভেঙে যায় ২০২২ সালের আগস্টে। ওই সময় অভিযোগ ওঠে, রওশন দলের কাউন্সিল আহ্বান করে জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে অপসারণের চেষ্টা করেন। এর বিপরীতে রওশনকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেন জি এম কাদের। যদিও তখন সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের ‘সমর্থনে’ রওশন টিকে যান। অবশ্য জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মন্তব্যের কারণে জাপার তৎকালীন মহাসচিব রওশন–ঘনিষ্ঠ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর এক বছর পর ফের সরকারি মধ্যস্থতায় জাপার সংকট সাময়িকভাবে মীমাংসা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কাদের ও রওশন সম্মত হন—জাপা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকবে এবং জি এম কাদের হবেন এর নেতা। এ কারণে বিএনপিসহ একাধিক দল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বয়কট করলেও জাপা এতে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনে রওশন–ঘনিষ্ঠদের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া নিয়ে আবার উত্তেজনা শুরু হয়। নির্বাচনেও বিপর্যয়কর ফল দেখে দলটি। আসন পায় মাত্র ১১টি। এতে জি এম কাদের ও রওশনের দ্বন্দ্ব আবার ঘনীভূত হয়।
জাতীয় নির্বাচনে বিপর্যয়কর ফলাফল ঘিরে এই উত্তেজনার মধ্যে জি এম কাদের দল থেকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী ফিরোজ রশিদ, সহসভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ্র রায় ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকে বহিষ্কার করেন। এই নেতারা পরে রওশনের শিবিরে যোগ দেন।
৭ জুলাই জি এম কাদের আরেক ধাপ এগিয়ে দলের সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো–চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ ১০ জনকে বহিষ্কার করেন। একই দিন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব করেন।
বহিষ্কৃত নেতারাও পাল্টা পদক্ষেপ নেন। তাঁরা ৩১ জুলাই জি এম কাদের ও যুগ্ম অফিস সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
একই বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এতে জাপার সংকট আরও বাড়ে। কারণ, হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির স্থানে জাপাকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ কারণে জাপার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কখনো বড় হতে দেয়নি আওয়ামী লীগ।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই আনিসুল মাহমুদ ও তাঁর সহযোগীরা ‘ঐক্য সম্মেলন’ করেন। এতে আনিসুল মাহমুদকে চেয়ারম্যান ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। এই অংশের সঙ্গে পরে যোগ দেন রওশন–ঘনিষ্ঠ কাজী ফিরোজ রশিদ ও আবু হোসেন বাবলা। এতে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ পক্ষের বাইরে আরেকটি অংশ সামনে আসে।
জাপার বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, নির্বাচন কমিশনও (ইসি) বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। একাধিক পক্ষ লাঙ্গল প্রতীকের দাবিদার, তাই বুঝে উঠতে পারছি না।’
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলতি অক্টোবরের শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরুর কথা জানিয়েছে ইসি। তবে এই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন জাপার কোন অংশকে মূল দল হিসেবে ডাকবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
যদিও গত ২৮ সেপ্টেম্বর জি এম কাদের পক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, দলীয় নিবন্ধন ও নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।’
কিন্তু ওই ঘটনার পরদিনই আনিসুল–হাওলাদার পক্ষ ইসিতে লিখিতভাবে নিজেদের বৈধ জাতীয় পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে। এর পরপরই আবার রওশন নেতৃত্বাধীন পক্ষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের লাঙ্গল প্রতীকের একমাত্র দাবিদার হিসেবে উপস্থাপন করে।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, কমিশন এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাপাকে আদৌ সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘সময় এলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
দলের তিন পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্ত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও। ঢাকা ও রংপুর বিভাগের কয়েকজন নেতা স্ট্রিমকে জানান, তাঁরা নিশ্চিত নন কোন পক্ষ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অনুমতি পাবে।
বিষয়টি নিয়ে রংপুরের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে রওশন ও কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু শেষ নির্বাচনের পর রওশনের প্রভাব কমে গেছে। কাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অনেক সিনিয়র নেতাকে সরিয়ে দিয়েছেন। অথচ এদের অনেকেরই অবদান বর্তমান চেয়ারম্যানের চেয়ে বেশি।’
ওই নেতা আরও বলেন, ‘রওশন–ঘনিষ্ঠদের কিছু অংশ আনিসুল–হাওলাদার পক্ষে গেছে। এতে রওশন শিবির আরও দুর্বল হয়েছে। এখন মূল লড়াই কাদের ও আনিসুলের মধ্যে। কিন্তু তারা প্রতীকের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া থেকে দলকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য আশঙ্কা করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন পুরো দলকেই নির্বাচনের বাইরে রাখবে।’
জাপার নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্ত হওয়ার কথা বললেও রুহুল আমিন হাওলাদারের কাছে দলের মধ্যে এই বিতর্ক রাজনীতির চেয়েও গভীর। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘এইচ এম এরশাদ জাতীয় পার্টির কর্মীদের জন্য এক আবেগের নাম। তিনি ছিলেন জনগণের নেতা। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু জি এম কাদের দলটিকে একনায়কতন্ত্রে পরিণত করছেন।’
নিজের অনুপস্থিতিতে দলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এরশাদ ২০১৬ সালে কো–চেয়ারম্যান পদ তৈরি করেন এবং জি এম কাদেরকে ওই পদে বসান। সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে কাদেরকে কো–চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেন এরশাদ। কিন্তু মাত্র ১২ দিন পর আবার পুনর্বহাল করেন। রাতারাতি কীভাবে ভাইকে রাজি করালেন, জানি না। তবে সিনিয়র নেতারা তাঁকে দল ধ্বংস করতে দেবেন না।’
তিনি দাবি করেন, ‘যদি আমরা প্রতীকে (আদালতের মাধ্যমে লাঙ্গল প্রতীক পান) জয়ী হই, অন্যান্য পক্ষের অনেক নেতা ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য সম্ভব।’
এদিকে রওশন–নেতৃত্বাধীন জাপা মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ বলেন, তাঁদের পক্ষই দলীয় প্রতীকের বৈধ দাবিদার। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগির তাঁরা ইসির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
অন্যদিকে এই দুই পক্ষের দাবি উড়িয়ে দিয়ে জি এম কাদেরপন্থী মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী স্ট্রিমকে বলেন, ‘দলের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় পার্টির প্রতীক অপরিবর্তনীয়। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন এ বিষয়ে ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না। জাতীয় পার্টি ৯টি জাতীয় নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে অংশ নিয়েছে— এর মধ্যে তিনটি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী আরও বলেন, কাদের চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের নেতা–দুই পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের সংবিধান অনুযায়ী এখানে কোনো বিচ্যুতির সুযোগ নেই।
তবে ইসির অবস্থান সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে শামীম হায়দার বলেন, ‘যদি নির্বাচন কমিশন অন্য কোনো বিকল্প বিবেচনা করে, তাহলে সেটা নিরপেক্ষতার নয়, অন্য কোনো প্রভাবের ফল। সংবিধান পর্যালোচনা করলে তারা দেখবে, কোনো আইনি সুযোগ নেই।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আগেও সরকার–সমর্থিত উদ্যোগে জাতীয় পার্টিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। এবারও একই চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু নেতা-কর্মীরা তা মেনে নেবে না। জাপা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ঐক্যের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নে জাপার এ নেতা বলেন, ‘রাজনীতিতে সব সময়ই নমনীয়তার জায়গা থাকে। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। দলের ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চেয়ারম্যান যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি অবশ্যই তৃণমূল নেতাদের মতামত বিবেচনায় নেবেন।’

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত জাতীয় পার্টিতে (জাপা) এবার দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়ে শুরু হয়েছে টানাটানি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও (সিইসি) নিশ্চিত নন লাঙলের আসল মালিক ভেঙে যাওয়া জাপার তিন উপদলের মধ্যে কোন পক্ষ।
এদিকে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার নেতৃত্বাধীন জাপার অংশটি বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অংশের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার স্ট্রিমকে বলেন, ‘আদালতই ঠিক করবেন প্রতীকের বৈধ দাবিদার কে।’ কবে রিট করবেন—এমন প্রশ্নে তিনি জানান, রিটের বিষয়ে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই বৈঠক করে তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই আইনি লড়াই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ কাঠামোকেই পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। অবশ্য জাপার নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রতীক নিয়ে এই সংঘাত যেমন বিভাজনকে গভীর করার আশঙ্কা তৈরি করেছে অপর দিকে তা দলের দ্বন্দ্ব মীমাংসার পথও খুলেছে। বিবদমান পক্ষগুলো শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৩তম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে ধারণা তাঁদের।
রেষারেষির শুরু যখন
জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সূচনা দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় থেকেই। এরশাদের মৃত্যুর আগ দিয়ে দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর আপসের মাধ্যমে জি এম কাদের চেয়ারম্যান এবং রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন।
তবে ওই আপস ভেঙে যায় ২০২২ সালের আগস্টে। ওই সময় অভিযোগ ওঠে, রওশন দলের কাউন্সিল আহ্বান করে জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে অপসারণের চেষ্টা করেন। এর বিপরীতে রওশনকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেন জি এম কাদের। যদিও তখন সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের ‘সমর্থনে’ রওশন টিকে যান। অবশ্য জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মন্তব্যের কারণে জাপার তৎকালীন মহাসচিব রওশন–ঘনিষ্ঠ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর এক বছর পর ফের সরকারি মধ্যস্থতায় জাপার সংকট সাময়িকভাবে মীমাংসা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কাদের ও রওশন সম্মত হন—জাপা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকবে এবং জি এম কাদের হবেন এর নেতা। এ কারণে বিএনপিসহ একাধিক দল ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বয়কট করলেও জাপা এতে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনে রওশন–ঘনিষ্ঠদের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া নিয়ে আবার উত্তেজনা শুরু হয়। নির্বাচনেও বিপর্যয়কর ফল দেখে দলটি। আসন পায় মাত্র ১১টি। এতে জি এম কাদের ও রওশনের দ্বন্দ্ব আবার ঘনীভূত হয়।
জাতীয় নির্বাচনে বিপর্যয়কর ফলাফল ঘিরে এই উত্তেজনার মধ্যে জি এম কাদের দল থেকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী ফিরোজ রশিদ, সহসভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ্র রায় ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকে বহিষ্কার করেন। এই নেতারা পরে রওশনের শিবিরে যোগ দেন।
৭ জুলাই জি এম কাদের আরেক ধাপ এগিয়ে দলের সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো–চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ ১০ জনকে বহিষ্কার করেন। একই দিন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব করেন।
বহিষ্কৃত নেতারাও পাল্টা পদক্ষেপ নেন। তাঁরা ৩১ জুলাই জি এম কাদের ও যুগ্ম অফিস সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
একই বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এতে জাপার সংকট আরও বাড়ে। কারণ, হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির স্থানে জাপাকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ কারণে জাপার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কখনো বড় হতে দেয়নি আওয়ামী লীগ।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই আনিসুল মাহমুদ ও তাঁর সহযোগীরা ‘ঐক্য সম্মেলন’ করেন। এতে আনিসুল মাহমুদকে চেয়ারম্যান ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। এই অংশের সঙ্গে পরে যোগ দেন রওশন–ঘনিষ্ঠ কাজী ফিরোজ রশিদ ও আবু হোসেন বাবলা। এতে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ পক্ষের বাইরে আরেকটি অংশ সামনে আসে।
জাপার বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, নির্বাচন কমিশনও (ইসি) বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। একাধিক পক্ষ লাঙ্গল প্রতীকের দাবিদার, তাই বুঝে উঠতে পারছি না।’
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলতি অক্টোবরের শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরুর কথা জানিয়েছে ইসি। তবে এই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন জাপার কোন অংশকে মূল দল হিসেবে ডাকবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
যদিও গত ২৮ সেপ্টেম্বর জি এম কাদের পক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, দলীয় নিবন্ধন ও নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।’
কিন্তু ওই ঘটনার পরদিনই আনিসুল–হাওলাদার পক্ষ ইসিতে লিখিতভাবে নিজেদের বৈধ জাতীয় পার্টি হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে। এর পরপরই আবার রওশন নেতৃত্বাধীন পক্ষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিজেদের লাঙ্গল প্রতীকের একমাত্র দাবিদার হিসেবে উপস্থাপন করে।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, কমিশন এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাপাকে আদৌ সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘সময় এলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
দলের তিন পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্ত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও। ঢাকা ও রংপুর বিভাগের কয়েকজন নেতা স্ট্রিমকে জানান, তাঁরা নিশ্চিত নন কোন পক্ষ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অনুমতি পাবে।
বিষয়টি নিয়ে রংপুরের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে রওশন ও কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু শেষ নির্বাচনের পর রওশনের প্রভাব কমে গেছে। কাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অনেক সিনিয়র নেতাকে সরিয়ে দিয়েছেন। অথচ এদের অনেকেরই অবদান বর্তমান চেয়ারম্যানের চেয়ে বেশি।’
ওই নেতা আরও বলেন, ‘রওশন–ঘনিষ্ঠদের কিছু অংশ আনিসুল–হাওলাদার পক্ষে গেছে। এতে রওশন শিবির আরও দুর্বল হয়েছে। এখন মূল লড়াই কাদের ও আনিসুলের মধ্যে। কিন্তু তারা প্রতীকের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া থেকে দলকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য আশঙ্কা করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন পুরো দলকেই নির্বাচনের বাইরে রাখবে।’
জাপার নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্ত হওয়ার কথা বললেও রুহুল আমিন হাওলাদারের কাছে দলের মধ্যে এই বিতর্ক রাজনীতির চেয়েও গভীর। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘এইচ এম এরশাদ জাতীয় পার্টির কর্মীদের জন্য এক আবেগের নাম। তিনি ছিলেন জনগণের নেতা। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু জি এম কাদের দলটিকে একনায়কতন্ত্রে পরিণত করছেন।’
নিজের অনুপস্থিতিতে দলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এরশাদ ২০১৬ সালে কো–চেয়ারম্যান পদ তৈরি করেন এবং জি এম কাদেরকে ওই পদে বসান। সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে কাদেরকে কো–চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেন এরশাদ। কিন্তু মাত্র ১২ দিন পর আবার পুনর্বহাল করেন। রাতারাতি কীভাবে ভাইকে রাজি করালেন, জানি না। তবে সিনিয়র নেতারা তাঁকে দল ধ্বংস করতে দেবেন না।’
তিনি দাবি করেন, ‘যদি আমরা প্রতীকে (আদালতের মাধ্যমে লাঙ্গল প্রতীক পান) জয়ী হই, অন্যান্য পক্ষের অনেক নেতা ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য সম্ভব।’
এদিকে রওশন–নেতৃত্বাধীন জাপা মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ বলেন, তাঁদের পক্ষই দলীয় প্রতীকের বৈধ দাবিদার। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগির তাঁরা ইসির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
অন্যদিকে এই দুই পক্ষের দাবি উড়িয়ে দিয়ে জি এম কাদেরপন্থী মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী স্ট্রিমকে বলেন, ‘দলের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় পার্টির প্রতীক অপরিবর্তনীয়। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন এ বিষয়ে ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না। জাতীয় পার্টি ৯টি জাতীয় নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে অংশ নিয়েছে— এর মধ্যে তিনটি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী আরও বলেন, কাদের চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের নেতা–দুই পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের সংবিধান অনুযায়ী এখানে কোনো বিচ্যুতির সুযোগ নেই।
তবে ইসির অবস্থান সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে শামীম হায়দার বলেন, ‘যদি নির্বাচন কমিশন অন্য কোনো বিকল্প বিবেচনা করে, তাহলে সেটা নিরপেক্ষতার নয়, অন্য কোনো প্রভাবের ফল। সংবিধান পর্যালোচনা করলে তারা দেখবে, কোনো আইনি সুযোগ নেই।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আগেও সরকার–সমর্থিত উদ্যোগে জাতীয় পার্টিকে বিভক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। এবারও একই চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু নেতা-কর্মীরা তা মেনে নেবে না। জাপা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ঐক্যের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নে জাপার এ নেতা বলেন, ‘রাজনীতিতে সব সময়ই নমনীয়তার জায়গা থাকে। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। দলের ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চেয়ারম্যান যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি অবশ্যই তৃণমূল নেতাদের মতামত বিবেচনায় নেবেন।’
.png)

জাতীয় ছাত্রশক্তির (আগের নাম—বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদারের মটরসাইকেলকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
৬ ঘণ্টা আগে
জোটগতভাবে ৩০০ আসনে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাতে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুনা নূর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
৬ ঘণ্টা আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি।
৭ ঘণ্টা আগে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, জামায়াত বা বিএনপির সঙ্গে জোট ও সমঝোতায় পৌঁছানো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের বৈঠকে।
৮ ঘণ্টা আগে