leadT1ad

গুলিবিদ্ধ হাদি আমাদের যে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩১
শরিফ ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত

গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত হাদির মুখের ছবিতে ফেসবুক সয়লাব। এই রক্তাক্ত মুখচ্ছবিই আমাদের রাজনৈতিক সমাজের দীর্ঘ ও দুর্বিষহ ক্লান্তির এক জীবন্ত স্মারক। হাদি—ওসমান শরিফ বিন হাদি হচ্ছেন সেই তরুণ মুখ, যিনি জুলাই আন্দোলনের রক্তমঞ্চ থেকে উঠে এসে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ করেছেন। তিনি হচ্ছেন সেই মুখ, যিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শাহবাগকে জাগিয়ে রাখতে বিনিদ্র রজনী শ্লোগান দিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন সেই মুখ, যিনি জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙায় সক্রিয় ছিলেন।

হাদি হচ্ছেন সেই বাগ্মী তরুণ, যিনি বলেছিলেন, আপনার সামনে আপনার সন্তানের বুকে গুলি লেগে কলিজা ছিড়ে বের হয়ে গেছে, তখন কি আপনি গালি না দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইবেন? তিনি হচ্ছেন সেই স্বচ্ছ রাজনৈতিক নেতা, যিনি ফেসবুকে তাঁর নির্বাচনি তহবিল সংগ্রহের আপডেট জানান। তিনি হচ্ছেন সেই স্পষ্টবাদী বিপ্লবী, যিনি বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি সবাইকে দিল্লির দাসত্ব না করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছেন।

এমন একজন নেতা, পুরোনো পঁচাগলা সিস্টেমের সকলের চক্ষুশূল হবেন, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

সেই স্বাভাবিক ঘটনাই ঘটেছে গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টার একটু পরপরই। নির্বাচনি প্রচারের কাজে রাজধানীর বিজয়নগরে একটি চলন্ত রিকশায় ছিলেন হাদি। পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেলে দুজন মাস্কপরা দুর্বৃত্ত হাদিকে গুলি করে। গুলি তাঁর কানের পেছনে মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।

হাদি এখন কোমায়, এভারকেয়ার হাসপাতালে। জীবনমৃত্যুর সুক্ষ্ম সুতায় তাঁর জীবন দুলছে। ঠিক যেই মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ হলেন হাদি, ঠিক সেই মুহূর্তেই ইতিহাসের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই অন্ধকূপেই এসে থামল। যে অন্ধকূপ থেকে আমরা বারবার উঠে দাঁড়ানোর, রাষ্ট্রকে মেরামত করার দিবাস্বপ্ন দেখেছিলাম, সেখানেই আবার পড়লাম। আহারে!

ঢাকা শহরের দুপুরের কমলা রোদ বিদীর্ণ করে যে গুলির ঘটনা ঘটলো, তা কেবল হাদির নাক-মুখ থেকে রক্ত ঝরায়নি, রক্ত ঝরালো আমাদের ‘নতুন ধারার রাজনীতি’ কিংবা ‘নয়া বন্দোবস্তের’ বুক থেকেও। দায় ও দরদের প্রাণ থেকেও।

ঘটনার অব্যবহিত পরেই দেখা গেল রাষ্ট্রের চিরাচরিত প্রতিক্রিয়া। প্রধান উপদেষ্টা হুকুম দিলেন—দোষীদের অবিলম্বে ধরতে হবে। যেন এই একটি হুকুমেই রাষ্ট্র তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে। আর ডিএমপি কমিশনার শোনালেন সেই পুরোনো গৎবাঁধা ম্যাড়মেড়ে বাণী—‘অপরাধীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু’।

এটা গল্প হলেও পারত। কারণ ‘অভিযান’ শব্দটি এখন আর নিরাপত্তার আশ্বাস দেয় না। অপারেশন ডেভিল হান্ট থেকে শুরু করে কত কত অভিযান এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করল জাতি! নির্মম কৌতুক হলো, মাত্র দুদিন আগেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অসহায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন—‘হত্যা বন্ধের কোনো ম্যাজিক বা সুইচ আমার হাতে নেই।’ এই যে স্ববিরোধিতা—একদিকে অভিযানের হুঙ্কার, অন্যদিকে অক্ষমতার স্বীকারোক্তি—এটাই কি আমাদের রাষ্ট্রচরিত্রের আসল রূপ নয়?

ওদিকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী অভিযোগের আঙুল তুললেন সীমান্তের ওপারে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘অপর’ বা ‘বাহির’ সবসময় এক সুবিধাজনক জাস্টিফিকেশন। ঘরের ভেতর যখন আগুন লাগে, তখন আমরা জানালার বাইরে মেঘের মধ্যে শত্রুর মুখ খুঁজি। একদা ছিল পাকিস্তান, পরে এল সামরিক জুজু, এখন এসেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূত। নিজের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা ঢাকতে ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত চাদর। যেন আমাদের সব দায় ‘অন্য কোথাও’, নিজের ভেতরে কোনো গলদ নেই।

সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখালেন ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম। হাদি গুলিবিন্ধ হওয়ার ৩৩ মিনিটের মাথায় তিনি একটি পোস্ট দিলেন, যেখানে আহত হাদির সুস্থতা কামনা করে একটি শব্দও নেই! তিনি উদ্বিগ্ন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে। তিনি ধরেই নিয়েছেন, নির্বাচন বানচাল করার জন্য তথাকথিত ‘চান্দাবাজ’ ও ‘গ্যাংস্টারেরা’ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাই তিনি ‘অভ্যুত্থানের’ ডাক দিলেন এবং ছাত্র-জনতাকে ‘প্রস্তুত’ থাকার আহ্বান জানালেন।

কি অদ্ভূত! গণ-অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শুরু হয়ে গেল বিভাজনের রাজনীতি। প্রতিপক্ষের রক্ত দেখলে এখন আর মানুষ কাঁদে না, বরং হিসাব কষে—এতে আমার দলের লাভ কতটুকু? ক্ষমতার এই লাভ-ক্ষতির অঙ্ক মানুষের কান্নাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায়?

আর সত্য? সত্য এখানে নিলামে ওঠা পণ্য। ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের বটবাহিনী ছড়িয়ে দিল মির্জা আব্বাসের নাম। জামায়াত-শিবিরও আঙুল তুলল বিএনপির দিকে। যেন সত্যের বাজারে প্রতিটি পক্ষের নিজস্ব গুজবের দোকান আছে। কোনটি আসল, কোনটি নকল—তা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। সত্য-মিথ্যা এখানে রাবারের মতো, যেদিকে টানবেন, সেদিকেই লম্বা হবে। রাজনৈতিক বাস্তবতা এখানে প্রমাণনির্ভর নয়, পুরোটাই বয়াননির্ভর। আর এই বিষাক্ত বয়ানগুলোই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সহিংসতার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে।

শরিফ ওসমান হাদির ওপর কেন হামলা হলো—এর কোনো সরলরৈখিক উত্তর নেই। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, হাদি বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগের চিরাচরিত বৃত্তের বাইরে একটি নতুন, আদর্শিক রাজনৈতিক স্থানের দাবি তুলেছিলেন। তাঁর উত্থান পুরাতন সব রাজনীতিকদের জন্যই ছিল ‘এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’ বার্তা। এই বার্তা কাদের জন্য অসহ্য, তা সহজেই অনুমেয়।

দ্বিতীয়ত, হাদি কেবল ক্ষমতার বদল চাননি, তাঁর দাবি ছিল আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল, গণহত্যার বিচার এবং মৌলিক সংস্কার। এই দাবি সরাসরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।

তৃতীয়ত, সংগঠনভিত্তিক রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তি যখন জনপ্রিয়তা পান, তখন ক্ষমতার পুরোনো কাঠামো কেঁপে ওঠে। বাংলাদেশে ‘জনপ্রিয়তা’ নিজেই একটি অপরাধ। তাই আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে প্রতিশোধ আর কেটে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর।

তবে এই হামলা আমাদের সামনে আরও বড় এক দার্শনিক সংকট উন্মোচন করেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক আজ আর আস্থার সুতোয় বাঁধা নয়। রাষ্ট্র যখন নিরাপত্তার গালভরা বুলি আওড়ায়, সমাজ তখন নিজেকে সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত ভাবে। সমাজ চায় মানবিকতা, রাষ্ট্র দেয় অভিযানের হুঙ্কার। জনগণ চায় স্বস্তি, রাজনীতি দেয় গুলি-ককটেলের আওয়াজ।

ফলে, হাদির রক্তাক্ত শরীর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে সেই পুরোনো প্রশ্ন নিয়ে—বাংলাদেশের রাজনীতি কি কেবল ক্ষমতার পালাবদলের রক্তাক্ত গল্পই হয়ে থাকবে? আমরা কি কেবল ‘দোষী কে’ খুঁজে বেড়াব? রাজনীতির পুরাণ যখন মানুষের রক্তে লেখা হয়, তখন মিথ সত্যের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আজকের এই হামলা সেই মিথেরই পুনরাবৃত্তি—যেখানে অনিশ্চয়তা, ভয় ও বিভাজন একসঙ্গে নৃত্য করছে।

সম্ভবত এই নৃত্যচক্র অনন্তকাল চলতেই থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে আবারও নতুন কোনো হাদি গুলিবিদ্ধ হবেন, আবারও সত্যের মুখ কালো হয়ে থাকবে। আর আমরা, এই অভাগা জাতি, অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকব। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যদি একটু আলো দেখা যায়!

মারুফ ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত