একসময়ের ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ থেকে আজকের ‘চিরকালের বন্ধু’ চীন-পাকিস্তান! আকসাই চীন নিয়ে সংঘাত আর কাশ্মীর ইস্যুকে ঘিরে বদলে যায় দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। ১৯৬৩ সালের এক মধ্যরাতের চুক্তিতেই ভারতের বদলে চীনের ভাই হয়ে ওঠে পাকিস্তান—যে চুক্তি ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয় এ অঞ্চলের। কী ছিল সেই চুক্তি?
রাতুল আল আহমেদ
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রথম বন্ধু ছিল ভারত। এখন শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠবেন, কিন্তু সত্য এই যে, পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিনিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা পাকিস্তানকে চীন সন্দেহের চোখে দেখত। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চীন বেশি ভরসা করেছিল সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ ভারতের ওপর।
ফলে খুব কম মানুষই কল্পনা করতে পেরেছিল, আগামী কয়েক দশকের পরিক্রমায় পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটি এমনই বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়াবে যে তা ‘লৌহকঠিন ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘সব সময়ের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিতি পাবে।
অ্যান্ড্রু স্মল তাঁর ‘দ্য চায়না-পাকিস্তান অ্যাক্সিস: এশিয়াজ নিউ জিওপলিটিক্স’ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৫০ সালের শুরুতে বেইজিংয়ের নিকটতম সঙ্গী ছিল ভারত, পাকিস্তান নয়।
ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমস্যার সূত্রপাত মূলত কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে। তবে ভারতের সঙ্গে এ দ্বন্দ্ব তুঙ্গে পৌঁছালেও চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলেছে চীন।
দ্বন্দ্বের সূচনা
আরও অনেক সমস্যার মতো চীনের সঙ্গে বিরোধের উৎস ব্রিটিশ শাসনামল।
আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ড. ইয়াকুব খান বাঙ্গাশের মতে, মহারাজা রনজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজরা কাশ্মীর উপত্যকাকে বিক্রি করে দেয় জম্মুর রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে। শিখদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধের পর ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ ‘অমৃতসর চুক্তি’র অধীনে সম্পন্ন হয় এই বেচাবিক্রির কাজ। সে সময় কাশ্মীরের মূল্য ধরা হয়েছিল ৭৫ লাখ রুপি।
ড. বাঙ্গাশ বলেন, এভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সৃষ্টি হলেও এর পূর্ব সীমান্ত নির্ধারিত হয়নি। তাঁর মতে, ‘তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ের দিকে এই সীমান্ত ছিল বিরান ও জনশূন্য, তাই এ নিয়ে তেমন চিন্তাও ছিল না।’
লাহোরের ইনফরমেশন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ড. বাঙ্গাশ বলেন, ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইন থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালের ম্যাকমোহন লাইন পর্যন্ত যেসব সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল একে অপরের থেকে আলাদা।
ভারতের ব্রিটিশ সরকার কখনো কোনো অঞ্চলকে জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ বলে ঘোষণা করত, আবার সেই অঞ্চলকে অন্য কোনো অঞ্চলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করত। এই প্রক্রিয়া অনেক বছর ধরে চলছিল। সীমানা ভাগাভাগির সময় তিব্বতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বারবার আলোচনা করা হলেও শিনজিয়াংয়ে থাকা চীনের সরকারের সঙ্গে সীমান্ত সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়েছে ভারতের। ফলে চীনের সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের এসব নিয়ে গোলযোগ লেগেই থাকত।
ভারতের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এই সীমানা নির্ধারণের সময় চীনা সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইরা ম্যাকডোনাল্ড তাঁর ‘হোয়াইট এজ দ্য শ্রাউড: ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড ওয়ার অন দ্য ফ্রন্টিয়ার্স অব কাশ্মীর’ বইতে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, ‘ব্রিটেন বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিল তিব্বতকে। যার মধ্যে ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইনও ছিল, যা আকসাই চীনের বেশিরভাগ অংশকে লাদাখের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এছাড়া ১৮৯৯ সালের ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইন, যা তুলনামূলকভাবে বাস্তব প্রস্তাব ছিল। তবে এই প্রস্তাবগুলো কখনও আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন পায়নি।’
ম্যাকডোনাল্ড লেখেন, ‘যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় তখন ব্রিটিশ নকশাগুলোতে আকসাই চীনের কোনো স্পষ্ট সীমানা ছিল না।’
উত্তর-পূর্ব কাশ্মীরের ব্রিটিশ শাসনের সেই সীমান্ত রেখাগুলো চীন কখনও স্বীকার করেনি। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের পরও এই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
চীনের দাবি ছিল, বেইজিংয়ে তাদের সরকারের কোনো কর্মকর্তা ভারতের সরকারের সঙ্গে সীমান্তসংক্রান্ত কোনো চুক্তি করেনি।
চীনের বাড়ানো হাত ভারত ধরল না কেন
ভারত ও চীন দুই দেশ আকসাই চীনের ওপর মালিকানা দাবির সময়ে অঞ্চলটি মূলত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ছিল। অ্যান্ড্রু ম্যাক্সওয়েল তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াস চায়না ওয়ার’ বইয়ে বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতে আকসাই চিন ছিল শতকের পর শতক ধরে লাদাখেরই অংশ।
অপর দিকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের মতে পশ্চিম সীমান্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইনই একমাত্র সীমান্ত প্রস্তাব যা কোনো চীনা সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী আকসাই চীনের কিছু অংশ চীনের সীমানার মধ্যে পড়েছিল।
চৌ এন লাই আরও দাবি করেন, ‘আকসাই চীন ইতিমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণেই আছে এবং আলোচনা চলাকালে বাস্তবতার ভিত্তিতে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।’
এসবের মধ্যেই চীনের কমিউনিস্ট সরকার তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার পর লাদাখের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে। এগোনোর উদ্দেশ্য ছিল আকসাই চীন অঞ্চল দিয়ে একটি সামরিক সড়ক নির্মাণ করা। ১৯৫৬–৫৭ সালে এই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
এই সড়ক শিনচিয়াং ও পশ্চিম তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে এবং চীনকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যবর্তী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়।
ভারত বেশ দেরিতে ওই সড়কের বিষয়ে জানতে পারে। এরপরেই দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ শেষমেশ ১৯৬২ সালের অক্টোবরে চীন-ভারত যুদ্ধে রূপ নেয়। সে যুদ্ধের পর থেকে লাদাখের উত্তর-পূর্ব অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
জার্মান সংস্থা এসডব্লিউপির দুই গবেষক ক্রিশ্চিয়ান ভ্যাগনার ও অ্যাঞ্জেলা স্টেনজেল এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন। তাঁরা বলছেন, ১৯৫৯ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতের কাছে একটি প্রস্তাব তোলেন। তিনি চাইছিলেন ভারত ও চীন এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে, যেখানে তারা একে অপরের কিছু ভূখণ্ডের দাবির ক্ষেত্রে ছাড় দেবে।
এক্ষেত্রে চীন আকসাই চীন পাবে, আর ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতের (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) ওপর দাবি ছেড়ে দেবে। কিন্তু ভারতের সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
জার্মান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালের পর ভারত-চীন সম্পর্ক যখন উন্নতির দিকে যেতে শুরু করে, সীমান্ত ইস্যুটি তখন আবার গুরুত্ব পায়। ১৯৯৩ সালের চুক্তির আওতায় লাইন অব অ্যাকচ্যুয়াল কনট্রোলকে (এলএসি) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট রেখা নয়। এটি দুইপক্ষের সম্মতিপ্রাপ্ত টহল-রুট ও সামরিক চৌকির এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বাতিল করে এবং সেটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০২০ সালের ৪ আগস্ট পাকিস্তান একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুন ইং এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ আইন একতরফাভাবে পরিবর্তন করে চীনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করেছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে চীনও লাদাখ বা আকসাই চীন প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসে।
এই সব পদক্ষেপে বোঝা যায়, কাশ্মীর ইস্যুটি এখন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এর ফলে চীন ও পাকিস্তান সম্ভবত আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার দিকে এগোতে পারে।
পাকিস্তান-চীনের সীমান্ত চুক্তি
সীমান্ত সংকট চীন ও পাকিস্তানের মধ্যেও ছিল।
ভারতের চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবিদ এ জি নূরানি ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় (২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৫৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান যখন আলোচনার প্রস্তাব দেয়, তখন চীনের তরফ থেকে এক ধরনের শীতল ও সন্দেহভরা মনোভাব পাওয়া যায়। তখনও চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতকে গুরুত্ব দিত।’
পাকিস্তানের সেই প্রস্তাবের জবাব দিতে চীন এক বছর সময় নেয়। অবশেষে ১৯৬০ সালের ৮ ডিসেম্বর তার প্রতিক্রিয়া জানায় চীন।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’-এ লিখেছেন, ‘১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে চীনা রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের কাছে জাতিসংঘে চীনের আসনের জন্য সমর্থন চান। এর জবাবে তিনি সীমান্ত সমস্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।’
চীনা রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে জটিল বলে বর্ণনা করলে আইয়ুব খান বলেন, ‘আমাদের উচিত দুটি বিষয়কে তাদের নিজ নিজ গুরুত্ব অনুযায়ী বিবেচনা করা।’
অ্যান্ড্রু স্মল লিখেছেন, ‘আইয়ুব খান নিশ্চিত ও সতর্কভাবে এগিয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুব খানকে পরামর্শ দেন যেন তিনি তাঁর আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন।’ ওই বক্তব্যে তিনি কাশ্মীর নিয়ে চীন-ভারত বিরোধকে কেবলই ‘ভারতের সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বেইজিংকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে তারা ভারতের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে।
১৯৬২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।
প্রাথমিকভাবে চীনের দাবি ছিল খুনজরাব উপত্যকা এবং কে-২-এর আশপাশের অঞ্চলগুলো। তবে পরে তারা কিছু সংশোধনসহ পাকিস্তানের মানচিত্র মেনে নেয়। কে-২ পর্বতশৃঙ্গ দুই দেশের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়।
পাকিস্তানের হুনজা উপত্যকার বাসিন্দারা শতকের পর শতক ধরে শিমশাল পাসের ওপারের কিছু চারণভূমি ব্যবহার করে আসছে। পাকিস্তান ওই অংশের মালিকানা দাবি করে চীনের কাছে। চীনা প্রতিনিধিরা এতে সম্মত হন। তারা বলেন, বিষয়টি ‘মেরিট’-এর ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। পরে ওই এলাকা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়।
২ মার্চ ১৯৬৩ বেইজিংয়ে ‘চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সমঝোতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। ২৬ মার্চ ১৯৬৫ সাক্ষর হয় ভূমি সীমা চিহ্নিতকরণ প্রোটোকল। চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর পূর্বসূরি মনজুর কাদির। ১৯৬২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মূল চুক্তির ঘোষণা আসে। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ১৯৬৩ সালের মার্চে ভুট্টো নিজেই বেইজিং যান এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেন ইর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পুরো ঘটনাই ঘটে মাঝরাতে।
এ চুক্তিটি কারাকোরাম ওয়াটারশেড ভিত্তিক ছিল যা ১৮৯৭ সালের আর্দাগ লাইন, ১৮৯৯ সালের ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড প্রস্তাব এবং ১৯০৫ সালের কার্জন সংশোধন-এর ভিত্তিতে গঠিত। ভারত এই চুক্তিকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। ভারতের মতে, ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুসারে সম্পূর্ণ কাশ্মীর ভারতের অংশ। জাতিসংঘে একটি প্রতিবাদপত্রও জমা দেয় তারা। পাকিস্তান তার উত্তরে জানায়, চীন এই সীমান্তকে একটি ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর তা পুনর্বিবেচনা করা হবে।
১৯৬৩ সালের ২৬ মার্চ দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের প্রতিবাদপত্র প্রসঙ্গে বলেন, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের অংশ নয়, বরং কাশ্মীরবাসীর। এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট ও ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারির প্রস্তাব অনুযায়ী। অর্থাৎ একটি অবাধ গণভোটের মাধ্যমে।
ভুট্টো আরও বলেন, যেহেতু ভারত ও পাকিস্তান এই প্রস্তাবে একমত, তাই এককভাবে কাশ্মীরের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করা দুঃখজনক ও অনুচিত। পাকিস্তান চীনকে এক ইঞ্চি জমিও দেয়নি, উল্টো ৭৫০ বর্গমাইল জমি পেয়েছে। আগে যা ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণে।
কোন পথে এগোবে চীন-ভারত সীমান্ত সংকট
চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সমঝোতা চুক্তিটি চীনের দক্ষিণ সীমান্ত নির্ধারণ করে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাও দূর করে এটি। চীন সীমান্তটিকে একটি ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে মেনে নেয়। ভবিষ্যতে কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে যেন এটি পুনর্বিবেচনা করা যায়।
এ জি নুরানি লিখেছেন, ১৯৬৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে চীন আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছে। কেবল ভারত ও ভুটানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ এখনো অমীমাংসিত।
নুরানি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি একতরফাভাবে এই বিরোধের সমাধান করব, নাকি পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাব?’ তাঁর মতে, কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি তখনই সম্ভব, যখন তা দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। এর মানে হলো, দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
(ওয়াকার মুস্তাফার বিবিসি উর্দুর প্রতিবেদন অবলম্বনে।)
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রথম বন্ধু ছিল ভারত। এখন শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠবেন, কিন্তু সত্য এই যে, পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিনিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা পাকিস্তানকে চীন সন্দেহের চোখে দেখত। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চীন বেশি ভরসা করেছিল সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ ভারতের ওপর।
ফলে খুব কম মানুষই কল্পনা করতে পেরেছিল, আগামী কয়েক দশকের পরিক্রমায় পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটি এমনই বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়াবে যে তা ‘লৌহকঠিন ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘সব সময়ের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিতি পাবে।
অ্যান্ড্রু স্মল তাঁর ‘দ্য চায়না-পাকিস্তান অ্যাক্সিস: এশিয়াজ নিউ জিওপলিটিক্স’ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৫০ সালের শুরুতে বেইজিংয়ের নিকটতম সঙ্গী ছিল ভারত, পাকিস্তান নয়।
ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমস্যার সূত্রপাত মূলত কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে। তবে ভারতের সঙ্গে এ দ্বন্দ্ব তুঙ্গে পৌঁছালেও চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলেছে চীন।
দ্বন্দ্বের সূচনা
আরও অনেক সমস্যার মতো চীনের সঙ্গে বিরোধের উৎস ব্রিটিশ শাসনামল।
আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ড. ইয়াকুব খান বাঙ্গাশের মতে, মহারাজা রনজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজরা কাশ্মীর উপত্যকাকে বিক্রি করে দেয় জম্মুর রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে। শিখদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধের পর ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ ‘অমৃতসর চুক্তি’র অধীনে সম্পন্ন হয় এই বেচাবিক্রির কাজ। সে সময় কাশ্মীরের মূল্য ধরা হয়েছিল ৭৫ লাখ রুপি।
ড. বাঙ্গাশ বলেন, এভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সৃষ্টি হলেও এর পূর্ব সীমান্ত নির্ধারিত হয়নি। তাঁর মতে, ‘তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ের দিকে এই সীমান্ত ছিল বিরান ও জনশূন্য, তাই এ নিয়ে তেমন চিন্তাও ছিল না।’
লাহোরের ইনফরমেশন টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ড. বাঙ্গাশ বলেন, ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইন থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালের ম্যাকমোহন লাইন পর্যন্ত যেসব সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল একে অপরের থেকে আলাদা।
ভারতের ব্রিটিশ সরকার কখনো কোনো অঞ্চলকে জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ বলে ঘোষণা করত, আবার সেই অঞ্চলকে অন্য কোনো অঞ্চলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করত। এই প্রক্রিয়া অনেক বছর ধরে চলছিল। সীমানা ভাগাভাগির সময় তিব্বতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বারবার আলোচনা করা হলেও শিনজিয়াংয়ে থাকা চীনের সরকারের সঙ্গে সীমান্ত সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়েছে ভারতের। ফলে চীনের সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের এসব নিয়ে গোলযোগ লেগেই থাকত।
ভারতের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এই সীমানা নির্ধারণের সময় চীনা সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইরা ম্যাকডোনাল্ড তাঁর ‘হোয়াইট এজ দ্য শ্রাউড: ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড ওয়ার অন দ্য ফ্রন্টিয়ার্স অব কাশ্মীর’ বইতে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, ‘ব্রিটেন বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিল তিব্বতকে। যার মধ্যে ১৮৬৫ সালের আরদাঘ-জনসন লাইনও ছিল, যা আকসাই চীনের বেশিরভাগ অংশকে লাদাখের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এছাড়া ১৮৯৯ সালের ম্যাকার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইন, যা তুলনামূলকভাবে বাস্তব প্রস্তাব ছিল। তবে এই প্রস্তাবগুলো কখনও আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন পায়নি।’
ম্যাকডোনাল্ড লেখেন, ‘যখন ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় তখন ব্রিটিশ নকশাগুলোতে আকসাই চীনের কোনো স্পষ্ট সীমানা ছিল না।’
উত্তর-পূর্ব কাশ্মীরের ব্রিটিশ শাসনের সেই সীমান্ত রেখাগুলো চীন কখনও স্বীকার করেনি। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের পরও এই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
চীনের দাবি ছিল, বেইজিংয়ে তাদের সরকারের কোনো কর্মকর্তা ভারতের সরকারের সঙ্গে সীমান্তসংক্রান্ত কোনো চুক্তি করেনি।
চীনের বাড়ানো হাত ভারত ধরল না কেন
ভারত ও চীন দুই দেশ আকসাই চীনের ওপর মালিকানা দাবির সময়ে অঞ্চলটি মূলত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ছিল। অ্যান্ড্রু ম্যাক্সওয়েল তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াস চায়না ওয়ার’ বইয়ে বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতে আকসাই চিন ছিল শতকের পর শতক ধরে লাদাখেরই অংশ।
অপর দিকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের মতে পশ্চিম সীমান্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইনই একমাত্র সীমান্ত প্রস্তাব যা কোনো চীনা সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী আকসাই চীনের কিছু অংশ চীনের সীমানার মধ্যে পড়েছিল।
চৌ এন লাই আরও দাবি করেন, ‘আকসাই চীন ইতিমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণেই আছে এবং আলোচনা চলাকালে বাস্তবতার ভিত্তিতে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।’
এসবের মধ্যেই চীনের কমিউনিস্ট সরকার তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার পর লাদাখের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে। এগোনোর উদ্দেশ্য ছিল আকসাই চীন অঞ্চল দিয়ে একটি সামরিক সড়ক নির্মাণ করা। ১৯৫৬–৫৭ সালে এই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
এই সড়ক শিনচিয়াং ও পশ্চিম তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে এবং চীনকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যবর্তী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়।
ভারত বেশ দেরিতে ওই সড়কের বিষয়ে জানতে পারে। এরপরেই দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ শেষমেশ ১৯৬২ সালের অক্টোবরে চীন-ভারত যুদ্ধে রূপ নেয়। সে যুদ্ধের পর থেকে লাদাখের উত্তর-পূর্ব অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
জার্মান সংস্থা এসডব্লিউপির দুই গবেষক ক্রিশ্চিয়ান ভ্যাগনার ও অ্যাঞ্জেলা স্টেনজেল এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন। তাঁরা বলছেন, ১৯৫৯ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতের কাছে একটি প্রস্তাব তোলেন। তিনি চাইছিলেন ভারত ও চীন এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে, যেখানে তারা একে অপরের কিছু ভূখণ্ডের দাবির ক্ষেত্রে ছাড় দেবে।
এক্ষেত্রে চীন আকসাই চীন পাবে, আর ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতের (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ) ওপর দাবি ছেড়ে দেবে। কিন্তু ভারতের সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
জার্মান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালের পর ভারত-চীন সম্পর্ক যখন উন্নতির দিকে যেতে শুরু করে, সীমান্ত ইস্যুটি তখন আবার গুরুত্ব পায়। ১৯৯৩ সালের চুক্তির আওতায় লাইন অব অ্যাকচ্যুয়াল কনট্রোলকে (এলএসি) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট রেখা নয়। এটি দুইপক্ষের সম্মতিপ্রাপ্ত টহল-রুট ও সামরিক চৌকির এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বাতিল করে এবং সেটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০২০ সালের ৪ আগস্ট পাকিস্তান একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুন ইং এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সম্প্রতি ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ আইন একতরফাভাবে পরিবর্তন করে চীনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করেছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে চীনও লাদাখ বা আকসাই চীন প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসে।
এই সব পদক্ষেপে বোঝা যায়, কাশ্মীর ইস্যুটি এখন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এর ফলে চীন ও পাকিস্তান সম্ভবত আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার দিকে এগোতে পারে।
পাকিস্তান-চীনের সীমান্ত চুক্তি
সীমান্ত সংকট চীন ও পাকিস্তানের মধ্যেও ছিল।
ভারতের চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবিদ এ জি নূরানি ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকায় (২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৫৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান যখন আলোচনার প্রস্তাব দেয়, তখন চীনের তরফ থেকে এক ধরনের শীতল ও সন্দেহভরা মনোভাব পাওয়া যায়। তখনও চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতকে গুরুত্ব দিত।’
পাকিস্তানের সেই প্রস্তাবের জবাব দিতে চীন এক বছর সময় নেয়। অবশেষে ১৯৬০ সালের ৮ ডিসেম্বর তার প্রতিক্রিয়া জানায় চীন।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’-এ লিখেছেন, ‘১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে চীনা রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানের কাছে জাতিসংঘে চীনের আসনের জন্য সমর্থন চান। এর জবাবে তিনি সীমান্ত সমস্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।’
চীনা রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে জটিল বলে বর্ণনা করলে আইয়ুব খান বলেন, ‘আমাদের উচিত দুটি বিষয়কে তাদের নিজ নিজ গুরুত্ব অনুযায়ী বিবেচনা করা।’
অ্যান্ড্রু স্মল লিখেছেন, ‘আইয়ুব খান নিশ্চিত ও সতর্কভাবে এগিয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুব খানকে পরামর্শ দেন যেন তিনি তাঁর আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন।’ ওই বক্তব্যে তিনি কাশ্মীর নিয়ে চীন-ভারত বিরোধকে কেবলই ‘ভারতের সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বেইজিংকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে তারা ভারতের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে।
১৯৬২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।
প্রাথমিকভাবে চীনের দাবি ছিল খুনজরাব উপত্যকা এবং কে-২-এর আশপাশের অঞ্চলগুলো। তবে পরে তারা কিছু সংশোধনসহ পাকিস্তানের মানচিত্র মেনে নেয়। কে-২ পর্বতশৃঙ্গ দুই দেশের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়।
পাকিস্তানের হুনজা উপত্যকার বাসিন্দারা শতকের পর শতক ধরে শিমশাল পাসের ওপারের কিছু চারণভূমি ব্যবহার করে আসছে। পাকিস্তান ওই অংশের মালিকানা দাবি করে চীনের কাছে। চীনা প্রতিনিধিরা এতে সম্মত হন। তারা বলেন, বিষয়টি ‘মেরিট’-এর ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। পরে ওই এলাকা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়।
২ মার্চ ১৯৬৩ বেইজিংয়ে ‘চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সমঝোতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। ২৬ মার্চ ১৯৬৫ সাক্ষর হয় ভূমি সীমা চিহ্নিতকরণ প্রোটোকল। চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর পূর্বসূরি মনজুর কাদির। ১৯৬২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মূল চুক্তির ঘোষণা আসে। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ১৯৬৩ সালের মার্চে ভুট্টো নিজেই বেইজিং যান এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেন ইর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পুরো ঘটনাই ঘটে মাঝরাতে।
এ চুক্তিটি কারাকোরাম ওয়াটারশেড ভিত্তিক ছিল যা ১৮৯৭ সালের আর্দাগ লাইন, ১৮৯৯ সালের ম্যাককার্টনি-ম্যাকডোনাল্ড প্রস্তাব এবং ১৯০৫ সালের কার্জন সংশোধন-এর ভিত্তিতে গঠিত। ভারত এই চুক্তিকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। ভারতের মতে, ১৯৪৭ সালের চুক্তি অনুসারে সম্পূর্ণ কাশ্মীর ভারতের অংশ। জাতিসংঘে একটি প্রতিবাদপত্রও জমা দেয় তারা। পাকিস্তান তার উত্তরে জানায়, চীন এই সীমান্তকে একটি ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর তা পুনর্বিবেচনা করা হবে।
১৯৬৩ সালের ২৬ মার্চ দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের প্রতিবাদপত্র প্রসঙ্গে বলেন, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের অংশ নয়, বরং কাশ্মীরবাসীর। এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট ও ১৯৪৯ সালের ৫ জানুয়ারির প্রস্তাব অনুযায়ী। অর্থাৎ একটি অবাধ গণভোটের মাধ্যমে।
ভুট্টো আরও বলেন, যেহেতু ভারত ও পাকিস্তান এই প্রস্তাবে একমত, তাই এককভাবে কাশ্মীরের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করা দুঃখজনক ও অনুচিত। পাকিস্তান চীনকে এক ইঞ্চি জমিও দেয়নি, উল্টো ৭৫০ বর্গমাইল জমি পেয়েছে। আগে যা ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণে।
কোন পথে এগোবে চীন-ভারত সীমান্ত সংকট
চীন-পাকিস্তান সীমান্ত সমঝোতা চুক্তিটি চীনের দক্ষিণ সীমান্ত নির্ধারণ করে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাও দূর করে এটি। চীন সীমান্তটিকে একটি ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা’ হিসেবে মেনে নেয়। ভবিষ্যতে কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে যেন এটি পুনর্বিবেচনা করা যায়।
এ জি নুরানি লিখেছেন, ১৯৬৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে চীন আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছে। কেবল ভারত ও ভুটানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ এখনো অমীমাংসিত।
নুরানি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি একতরফাভাবে এই বিরোধের সমাধান করব, নাকি পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাব?’ তাঁর মতে, কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি তখনই সম্ভব, যখন তা দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। এর মানে হলো, দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
(ওয়াকার মুস্তাফার বিবিসি উর্দুর প্রতিবেদন অবলম্বনে।)
আত্মহত্যাকে এত ছি ছি চোখে দেখার কিছু নেই। যেকোনো আত্মহত্যার পেছনে অন্তত তিনটি কারণ থাকে। ১. জৈবিক ২. মনস্তাত্ত্বিক ও ৩. ভৌগলিক। কেউ একজন আত্মহত্যা করলেই আমরা ধরে নিই, সে মানসিক সমস্যায় ছিল। এমন ভাবনা সত্যিই হাস্যকর।মানসিক সমস্যা ছাড়াও মানুষের জীবনে আরও বহুবিধ সমস্যা থাকে। সেসব কারণেও
১৬ দিন আগেমো. তৌফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ও নগদ অর্থকরী ফসল। প্রতি বছর দেশের আলু উৎপাদনের একটি বড় অংশ আসে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা থেকে। কিন্তু ২০২৫ সালের শুরু থেকে এই অঞ্চলের কৃষকরা নজিরবিহীন দামের পতনে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
১৬ দিন আগেকৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন আগে থেকেই ছিল। নাম—‘নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি’। কিন্তু তা যেন নিখিল বাংলার কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ‘যথাযথ’ ভূমিকা রাখতে পারছিল না।
২০ দিন আগেজুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন আঙ্গিকে আগামী ২ জুন (সোমবার) অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন।
৩০ মে ২০২৫