গতকাল ঢাকার ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে একজন মানুষের প্রাণ গেল, আহত হলেন আরও দুজন। ঢাকা শহরে এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন নয়। ভবন ধসে পড়া, অগ্নিকাণ্ড, ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা, ছিনতাই—নানাভাবে মানুষের জীবন এখানে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। দেশের অন্যতম বড় মেগা প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেল যখন আধুনিক ঢাকার প্রতিচ্ছবি হওয়ার কথা, তখন তার অবকাঠামো থেকে খসে পড়া মৃত্যু নগরবাসীর নিরাপত্তাহীনতার এক মর্মান্তিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের নগর জীবন, বিশেষ করে ঢাকার জীবনযাত্রা, কেন এতটা অনিরাপদ এবং এই ধরনের দুর্ঘটনা কেন ঘটে?
দুর্ঘটনার ত্রিস্তরীয় কারণ
যেকোনো পরিবহন বা অবকাঠামোগত দুর্ঘটনার পেছনে মূলত তিনটি প্রধান কারণ কাজ করে। এই কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে পারলে সমস্যার গভীরতা বোঝা সহজ হয়।
১. চলমান উপাদান: প্রথমত, যে বাহনগুলো সচল থাকে, যেমন—গাড়ি, বাস বা মেট্রোরেলের কোচ, সেগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ব্রেকফেল হওয়া, ইঞ্জিনের সমস্যা বা অন্য কোনো কারিগরি ত্রুটি একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
২. স্থায়ী অবকাঠামো: দ্বিতীয় কারণটি হলো স্থায়ী অবকাঠামো, যার মধ্যে রয়েছে রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেলের পিলার ও লাইন। রাস্তার ভুল নকশা, অতিরিক্ত বাঁক, প্রয়োজনীয় সাইন-সিম্বলের অভাব, কিংবা অবকাঠামোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। যেমনটি ঘটেছে ফার্মগেটের ঘটনায়।
৩. মানবিক উপাদান: তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো মানবিক উপাদান। এর মধ্যে চালক, পথচারী, ব্যবস্থাপক এবং সাধারণ নাগরিক—সকলেই অন্তর্ভুক্ত। চালকের অসতর্কতা, বেপরোয়া গতি, পথচারীর আইন না মানার প্রবণতা কিংবা ব্যবস্থাপকদের দায়িত্বে অবহেলা—এই সবগুলোই দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
মেট্রোরেল দুর্ঘটনা: ব্যবস্থাপনার অবহেলা নাকি কাঠামোগত ত্রুটি?
মেট্রোরেলের মতো একটি আধুনিক প্রযুক্তির প্রকল্পে দুর্ঘটনার একাধিক সম্ভাব্য ক্ষেত্র থাকতে পারে। এর চলমান কোচগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটি হতে পারে, আবার এর বিশাল স্থায়ী অবকাঠামো, যেমন—লাইন, স্টেশন, পিলার ইত্যাদির নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণেও ঘাটতি থাকতে পারে। এর সাথে মানবিকের ভুল তো রয়েছেই।
ফার্মগেটের ঘটনায় বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র কারণ হলো পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিদর্শনের অভাব। একটি বিয়ারিং প্যাড বা কংক্রিটের অংশ একদিনে দুর্বল হয় না। এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত এবং সঠিক পরিদর্শন। যখন এমন একটি অংশ খসে পড়ে, তখন এটিই প্রতীয়মান হয় যে, সঠিক সময়ে এর দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়নি বা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনেকে এর নির্মাণ উপকরণের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। মান যদি নিম্নমানের হয়েও থাকে, তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে সেটিও ধরা পড়ার কথা। একটি গাড়ির চাকা পুরনো হলে যেমন বদলে ফেলতে হয়, তেমনি অবকাঠামোর কোনো অংশ দুর্বল হলে তা মেরামত বা প্রতিস্থাপন করা জরুরি। সুতরাং, চূড়ান্তভাবে এটি ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতিকেই নির্দেশ করে।
অনিরাপদ নগর জীবন: একটি সামগ্রিক চিত্র
মেট্রোরেলের এই ঘটনাটি ঢাকার সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের নগর জীবন, বিশেষ করে ঢাকা, মোটেও নিরাপদ নয়। এই অনিরাপদ পরিস্থিতির পেছনে তিনটি প্রধান কারণ দায়ী:
অপরিকল্পিত নগরায়ন: পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক ভবন উঠছে, রাস্তাঘাট দখল হচ্ছে। পুরান ঢাকা বা নতুন ঢাকার অনেক এলাকার রাস্তা এতটাই সংকীর্ণ যে, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের সুযোগ থাকে না। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতাও সীমিত; অনেক উঁচু ভবনে আগুন লাগলে তা নেভানোর মতো সরঞ্জাম তাদের নেই।
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা: নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা এবং উদাসীনতা দেখা যায়। তারা যেন এই শহরের নিরাপত্তা বিধানে পুরোপুরি ব্যর্থ।
নাগরিকদের দায়িত্বহীনতা: এর সাথে যুক্ত হয়েছে নগরের অধিবাসীদের সম্মিলিত দায়িত্ববোধের অভাব।
সমাধানের পথ ও নাগরিক শুভবুদ্ধির সংকট
প্রশ্ন হতে পারে এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমি বলব এর কোনো সহজ বা একক সমাধান নেই। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত বা কম্প্রিহেনসিভ উদ্যোগ। বিশ্বজুড়ে নগর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়— ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফোর্সমেন্ট, এবং এডুকেশন ও অ্যাওয়ারনেস।
অর্থাৎ, একদিকে যেমন নিরাপদ রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো (ইঞ্জিনিয়ারিং) তৈরি করতে হবে, তেমনই সেই নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ (ইনফোর্সমেন্ট) করতে হবে। এর পাশাপাশি, স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে সব স্তরে মানুষকে নাগরিক দায়িত্ব এবং আইন মেনে চলার বিষয়ে শিক্ষিত (এডুকেশন) করে তুলতে হবে এবং সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা (অ্যাওয়ারনেস) তৈরি করতে হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আমরা হয়তো একটি ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেল তৈরি করছি (ইঞ্জিনিয়ারিং), কিন্তু সেটি ব্যবহারের নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করছি না (ইনফোর্সমেন্ট)। আবার, মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগও খুব সীমিত। ফলে, রাস্তায় লোহার ব্যারিকেড দিয়েও মানুষের রাস্তা পারাপার ঠেকানো যায় না, কারণ মানুষ সেই ব্যারিকেড কেটেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়।
ঢাকার নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় কারণ হলো এর নাগরিকদের মধ্যে ‘সিভিক সেন্স’ বা নাগরিক শুভবুদ্ধির চরম অভাব। আমরা প্রত্যেকেই এই শহরকে ব্যবহার করি, কিন্তু একে নিজের বলে মনে করি না। রাস্তায় নামলে দেখা যায় এক অদ্ভুত ক্ষমতার লড়াই। ট্রাক ড্রাইভার বাস ড্রাইভারকে পরোয়া করে না, বাস ড্রাইভার রিকশাচালককে মানুষ মনে করে না, আবার সেই রিকশাচালকই পথচারীর গায়ের উপর দিয়ে রিকশা তুলে দিতে চায়। এখানে কেউ কাউকে সম্মান করে না, নিজের অধিকারের জন্য অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করতেও দ্বিধা করে না। সবাই আগে যেতে চায়, লাইন ভাঙতে চায়, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চায়।
এই সম্মিলিত আইন না মানার সংস্কৃতিই ঢাকাকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নাগরিক হিসেবে আমি আমার শহরের প্রতি দায়িত্বশীল না হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল আইন বা অবকাঠামো দিয়ে এই শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত, ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কর্তৃপক্ষ এবং নাগরিক উভয়কেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। মেট্রোরেলের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এই শহরকে নিরাপদ করতে হলে কেবল কংক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়, এর সাথে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং নাগরিকদের মধ্যে মানবিক ও সভ্য আচরণের বিকাশ। নইলে এমন মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে, আর আমরা এক অনিরাপদ শহরে অসহায়ভাবে বেঁচে থাকব।
লেখক:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক