leadT1ad

এখানে মৃত্যুর ফেরেশতার নাম বিয়ারিং প্যাড, আমরা ‘ড্যামোক্লিসের তরবারির’ নিচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজা

স্ট্রিম গ্রাফিক

মানুষের জীবন এখন এতটাই সস্তা ধাতব মুদ্রা, যার কোনো মূল্যই আর এই নগর রাষ্ট্রের কাছে অবশিষ্ট রইল না। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাথার ওপর নেমে আসতে পারে মৃত্যু—এই চরম সত্য এখন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কী অদ্ভুত এক নিয়তি! জীবিকার খোঁজে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অতি অবশ্যই প্রিয়জনের কাছ থেকে ‘শেষ বিদায়’ নিতে হবে। কারণ, আপনার জানা নেই, কখন কোন সরকারি উদাসীনতা কিংবা অবহেলা আপনার মাথায় হঠাৎ এক টুকরো আকাশ ভেঙে দেবে। এ যেন এক আধুনিক ট্র্যাজেডি, যেখানে নিয়তি রচিত হয় ইস্পাতের পিলারের গোড়ায় আর জীবন নিভে যায় বিয়ারিং প্যাডের আকস্মিক পতনধ্বনিতে।

ঘটনাটি একটি বিয়ারিং প্যাডকে কেন্দ্র করে। মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড। গতকাল রোববার ফার্মগেটে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মেট্রোরেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ল মানুষের মাথার ওপর। আর সেই মুহূর্তেই একজন মানুষ, তাঁর স্ত্রী ও ছোট ছোট দুটি সন্তানের অবলম্বন, একটি পরিবারের কর্মক্ষম অভিভাবক—৩৬ বছর বয়সী আবুল কালাম আজাদ ‘স্বাধীনতা’ পেয়ে গেলেন। আজাদ মানে তো মুক্ত, স্বাধীন। মেট্রোরেল তাকে সত্যিসত্যিই ‘আজাদী’ বানিয়ে দিল। এই নগরী, এই রাষ্ট্র, আর কোনোভাবেই তাঁকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে রাখতে পারবে না। শুধু তাঁর স্ত্রী আর ছোট দুটি সন্তান এখন এই ‘আজাদী’র ভয়াবহ ভার বহন করবে।

সরকারের উদাসীনতা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের নগ্ন চিত্র এটি। এটি আসলে নির্মাণের সময়ের দুর্নীতি ও পরবর্তী সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলার ফল। হঠাৎ একদিন ঠুস করে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়েনি নিশ্চয়। প্রতিদিন একটু একটু করে সরে গেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, সঠিকভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে বিয়ারিং প্যাড বসানো হয়েছিল কি না। না কি খাটের পায়ার নিচে ইট গুঁজে দেওয়ার মতো ঠেস দেওয়া হয়েছিল? এত বড় একটি প্রকল্পের সামান্যতম তদারকি থাকবে না? মনিটরিংয়ের এই চরম ঘাটতি প্রমাণ করে, মানুষের জীবনের মূল্য তাদের কাছে পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক মাত্র। পাঁচ লাখ টাকা আর পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস—এতেই কি সব দায় চুকে গেল? যারা এখন ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে, তাদের জন্য কি এই ঘোষণা যথেষ্ট?

ফুটপাত দিয়ে হাঁটা মানুষগুলোও যেন এক-একজন ড্যামোক্লিস। মাথার ওপরে ঝুলছে উন্নয়নের তরবারি, যেকোনো মুহূর্তে তা ছিঁড়ে পড়বে।

এর আগেও তো এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়েছিল উত্তরার দিকে। গাড়ির ভেতরে থাকা পাঁচজন মানুষ আর ফেরেনি। ২০২৩ সালের ২৯ মে মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে রড পড়ে বারো বছর বয়সী এক শিশু নিহত হয়েছিল। এমনকি বছরখানেক আগে (২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর) এই ফার্মগেট এলাকাতেই ৪৩০ নম্বর পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখন কেউ আহত হননি বটে। কিন্তু বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে, কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই শিক্ষা নিচ্ছে না। পাঁচ বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকে (বণিক বার্তা) খবর প্রকাশিত হয়েছিল, এই বিয়ারিং প্যাডগুলো ‘মানহীন’ শিরোনামে। তারপরও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। তারা যেন অপেক্ষায় ছিল, কখন মৃত্যুর ফেরেশতা হয়ে নেমে আসবে বিয়ারিং প্যাড আর তারা ছুটে যাবে পাঁচ লাখ টাকার চেক নিয়ে। তারা টাইফয়েডের ফ্রি টিকা দেওয়ার জন্য জোরাজোরি করবে, কিন্তু রাস্তায় চলাচল করা নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষার্থে ন্যুনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না। আদতে তাদের কাছে ‘উন্নয়ন’ বড়, মানুষ নয়।

সুতরাং আমাদের সাবধানে পথ চলতে হবে। সাবধানের মার নেই—এই প্রবাদটি এখন আমাদের জন্য এক মর্মান্তিক সত্য। আমাদের এখন এতটাই সাবধান হতে হবে যে, এখন থেকে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পথ চলতে হবে। কখন মাথার ওপর ‘উন্নয়নের’ টুকরো খসে পড়ে, এই ভয় নিয়ে বাঁচতে হবে।

আসলে পৃথিবীর কোথাও কি এমন মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল চলে? চলে। থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, জাপান, কানাডা, ভারত বা অন্যান্য উন্নত বিশ্বের শহরেও মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল আছে। কিন্তু সেখানে কি এভাবে মাথার ওপর মৃত্যু নেমে আসে? একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে পথচারী নিহত হয়? কত মানুষ মারা গেছে এভাবে পৃথিবীতে? এই প্রশ্নগুলো আমাদের রাষ্ট্রের বিবেকের কাছে, যদি তাদের কোনো বিবেক থেকে থাকে।

পৌরাণিক গ্রিকদের গল্পে ‘ড্যামোক্লিসের তরবারি’ নামে একটি মিথ প্রচলিত আছে। ড্যামোক্লিস একদিন রাজা হতে চেয়েছিল। রাজা ডায়োনিসিয়াস তাঁকে একদিনের জন্য সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, কিন্তু মাথার ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন এক সূক্ষ্ম ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে বাঁধা ধারালো তরবারি। উদ্দেশ্য ছিল, ক্ষমতা ভোগ করার সময়ও যেন সে বিপদের ভয়কে ভুলে না যায়। আমাদের আজকের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা মানুষগুলোও যেন এক-একজন ড্যামোক্লিস। মাথার ওপরে ঝুলছে উন্নয়নের তরবারি, যেকোনো মুহূর্তে তা ছিঁড়ে পড়বে। এই তরবারি হলো সরকারের উদাসীনতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর মনিটরিংয়ের চূড়ান্ত ব্যর্থতা।

আবুল কালাম আজাদকে মেট্রোরেল তার নামানুসারে ‘আজাদ’ করে দিয়েছে। কিন্তু এই নির্মমতা আমাদের সমাজের প্রতি এক কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল: উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া এই রাষ্ট্রে একজন সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য কোথায়? এই প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে আমাদের এখন আকাশের দিকে চোখ তুলে হাঁটতে হবে। হয়তো এটাই আমাদের নিয়তি। কারণ, আমরা তো ‘ড্যামোক্লিসের তরবারির’ নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অভাগা প্রজা।

কিন্তু ঈশ্বর তো আমাদের মাথার ওপর চোখ দেননি!

মারুফ ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত