leadT1ad

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির ‘ঝামেলা’ যে জায়গায়

কৌশিক বসু
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ২৬
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ২৮
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রথম ছয় মাসেই বিপুল সংখ্যক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন এবং আইন প্রণয়ন করেন। ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড মার্কিন ইতিহাসে ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসা ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের প্রথম ১০০ দিনের ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কোনো সময় দেখা যায়নি।

তবে ট্রাম্পের কার্যক্রমের সঙ্গে রুজভেল্টের সময়ের বিস্তর ফারাক আছে। রুজভেল্টের নিউ ডিল ছিল একটি মৌলিক এবং শেষ পর্যন্ত সফল প্রচেষ্টা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে রুজভেল্টের প্রণয়ন করা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের একটি সিরিজ ছিল ‘নিউ ডিল’। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া মহামন্দার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই কার্যক্রম শুরু হয় এবং সফলতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে মহামন্দা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়।

মেক্সিকো, কানাডা ও ভারতের মতো দেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালের শুল্ক বাড়িয়ে ট্রাম্প আসলে মার্কিন উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছেন। ফলে বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি ও নির্বাহী আদেশ এতটা স্পষ্ট বা তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট থেকে আসেনি। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগেই মার্কিন অর্থনীতি ভালো অবস্থায় ছিল।

কোনো সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের আধিপত্যশীল উৎপাদন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। তবে এই প্রচেষ্টা সফল হবে কি না তা এখনো অনিশ্চিত।

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক এজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অস্ত্রায়ন। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের ওপর ব্যাপকহারে পালটা শুল্ক আরোপ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপর আলোচনার মাধ্যমে সেই শুল্ক হার বারবার সমন্বয় করেছেন। কোথাও শুল্ক কমিয়েছেন, কোথাও বাড়িয়েছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে পুনর্বহাল রেখেছেন। এর ফলে কার্যকর হওয়া মার্কিন শুল্ক হারের গড় ২০২৪ সালে ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশেরও বেশি হয়েছে। এটি ১৯৩০-এর দশকের পর সর্বোচ্চ।

অনেক বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন, এত বেশি শুল্ক মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে। তবে প্রকৃত ঝুঁকি অন্য জায়গায়। মেক্সিকো, কানাডা ও ভারতের মতো দেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালের শুল্ক বাড়িয়ে ট্রাম্প আসলে মার্কিন উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছেন। ফলে বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হলে রপ্তানি কমে যেতে পারে। ফলে শ্রমজীবী মানুষের আয়ে সরাসরি চাপ পড়বে। এ ছাড়া আছে ট্রাম্পের ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট। এই আইন ধনীদের জন্য উচ্চ কর ছাড়ের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে বাজেট কমিয়েছে। ফলে আয় কমের সম্ভাবনার সঙ্গে এটা যুক্ত হয়ে ক্ষতি আরও বাড়াবে। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মার্কিনিরা। পাশাপাশি ফেডারেল ঘাটতি কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে।

ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

এই নীতিগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করা না হলে মার্কিন অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব বিধ্বংসী হতে পারে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত হলেও, উচ্চ শুল্ক শেষ পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ধীর করবে এবং শ্রমজীবী আমেরিকানদের মজুরি কমাবে। এই পতন দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় পরিণত হতে পারে, যা অর্থনৈতিক অবস্থার তীব্র অবনতি ডেকে আনবে।

অর্থনৈতিক অবস্থা শুধু অর্থনৈতিক নীতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ভাষায়, দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিশ্বাসের মাত্রার ওপর অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ভর করে।

দুর্ভাগ্যবশত, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শত শত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা হঠাৎ করে বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষানীতির প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্রদের ওপর ট্রাম্প যেভাবে আক্রমণ করছেন ও আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন, সেই কারণেও মানুষের আস্থা দিন দিন তলানিতে ঠেকছে।

সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ডলারের ওপর আস্থা হারানোর শঙ্কা। বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন অর্থনীতির মূলভিত্তি। ডলারের ওপর এই আস্থা কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে ২৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ জমা করার সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও ডলার যুক্তরাষ্ট্রকে বড় কৌশলগত সুবিধা দেয়, তবুও এটি একটি বড় দুর্বলতাও তৈরি করে। যদি রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের ওপর বিশ্বের আস্থা নষ্ট হয়, তবে আমেরিকান অর্থনীতির ভীতটাই কেঁপে উঠবে।

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি মার্কিন বাজারকে ক্রমশ অস্থির করছে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তবে ডলারের প্রতি আস্থা নষ্ট হবে এবং মার্কিন সম্পদ থেকে পুঁজি সরে যাবে।

এখন আশা একটাই, আমেরিকানরা যদি ট্রাম্পের ক্ষতিকর নীতির তীব্র বিরোধিতা করে, তাহলেই ট্রাম্প বাধ্য হবেন তাঁর পথ পরিবর্তন করতে। স্বল্পমেয়াদি চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও মার্কিন অর্থনীতি যথেষ্ট প্রাণবন্ত, চেষ্টা করলেই এর পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতা আসতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প যদি তাঁর প্রথম ছয় মাসের মতো পরবর্তী সাড়ে তিন বছর চালিয়ে যান, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে অকল্পনীয় অর্থনৈতিক পতনের মুখোমুখি হতে হবে।

লেখক: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ

(প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ)

Ad 300x250

সম্পর্কিত