জন্মদিনে শ্রদ্ধা
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতির মৌলিক বিষয় ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে আসছেন, এখনো করছেন। একজন সংগঠক হিসাবে সর্বজনের জন্য রাজনীতিকে গতি দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠের আইকন।
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে জন্মগ্রহণকারী আনু মুহাম্মদ স্যারের চুল কবে থেকে পাকা শুরু হয়েছে, খেয়াল করিনি। তবে শেষপর্যন্ত আনু মুহাম্মদ স্যারের সঙ্গে ‘সর্বজনকথা’ জার্নালের প্রকাশ ও সম্পাদনার কাজ করতে করতে আমাদের অনেকেরই চুল পাকা শুরু হয়েছে। যখন আমাদের অনেকেরই চুল পাকেনি তখন কাজের সুবাদে তাঁর সঙ্গে আড্ডা হতো।
আড্ডা দেওয়ার ছলে যখনই একটা দরকারি বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশ করতাম, তখনই আনু স্যারের রাজনৈতিক মগজে কাজ করত কীভাবে এই কথাটা প্রকাশ করা যায়। ফোন করে বলতেন, ‘ঋতু-উ-উ। কালকে একটা প্রোগ্রাম আছে, আসো।’। তারপর বলতেন, ‘ওইখানে বসছ কেন? স্টেজে এসে বসো।’ তারপর মাইকটা এগিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘বলো।’ আমার অবস্থা হতো ‘অ্যাঁ’!
অপ্রস্তুত অবস্থায় কী বলতাম জানি না। কোনোমতে উতরে যেতাম। আমরা অনেকেই মাথায় অনেক কথা নিয়ে ঘুরি, কিন্তু ঠিক মতো বলতে পারি না। অনেক সময় লেখার অনেক বিষয় থাকলেও লিখতে পারি না। এটা বুঝেই স্যার এরকম করতেন। এটা শুধু আমার অভিজ্ঞতা নয়। আমরা যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছি, সবার অভিজ্ঞতাই কাছাকাছি। তিনি এখনো এরকমই করেন। এখনো ত্রাসের মধ্যে থাকি, কখন কী বলতে হয়।
সেদিনও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির আলোচনায় স্টেজে যাব না বলার পর স্যার বলেন, দর্শকের সারিতে ঠান্ডা বেশি, স্টেজে ঠান্ডা কম। এখানে বসলে বাতাস কম লাগবে। এরকম খেলার ছলে আমাদের যত ইনকনফিডেন্স আছে, সেগুলোকে তিনি গুঁড়িয়ে দেন। কথা বলার স্পেস তৈরি করেন। হাতপা কাঁপতে কাঁপতে কথা বলে আসি। কথা সুন্দর গুছিয়ে না বললেও পরে মনে শান্তি হয় এই ভেবে যে ওই বিষয়ে অন্তত প্রতিবাদী বাক্যটা তো উচ্চারণ করে এসেছি।
এই হলো আনু মুহাম্মদ। একজন চুম্বক-চরিত্র। একজন প্রকৃত পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল। তিনি শুধু একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়ালের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি হয়ে উঠেছেন অসংখ্য সত্যভাষী প্রতিবাদী মানুষের প্রেরণা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো হোক কিংবা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো হোক, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মেকানিজম যদি না থাকে—যেকোনো সমাজেই প্রশ্নহীনতা, নজরদারিহীনতা হতাশার চাষাবাদ করে। আনু মুহাম্মদ একজন পাবলিক ইন্টেলেচ্যুয়াল হিসেবে হতাশার চাষাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছেন। অন্ধকারে বাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল ‘ঢাকা স্ট্রিম’ থেকে ফোন করে যখন আমাকে স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে লিখতে বলা হলো, আমি গভীর সমুদ্রে পড়ে গেলাম। এই সমুদ্র থেকে উঠে আসা কঠিন। ১ নম্বর অপরাধ হলো, স্যারকে নিয়ে কখনো কিছু লিখি না। দ্বিতীয় হলো, একটা প্রবন্ধ লিখে আসলে তাঁর সম্পর্কে কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি একজন ব্যক্তি নয়, একটা রাজনীতি। তাঁকে নিয়ে লিখলে তাঁর রাজনীতি নিয়ে লিখতে হবে।
আমরা যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখি, তাঁদের জন্য তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখানোর ঝুঁকি থেকে যায়। তাঁর বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, স্মৃতি সামনে চলে আসে। তাঁর রাজনীতিটা হারিয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। এ কারণে আনু মুহাম্মদকে নিয়ে লেখা গভীর সমুদ্রে পতিত হওয়ার মতো ঘটনা।
আনু মুহাম্মদ একজন শিক্ষক, লেখক, সংগঠক—সর্বোপরি একজন আপোসহীন প্রতিবাদী কণ্ঠ। আমরা তাঁকে পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা জনবুদ্ধিজীবী বলি নানা কারণে। প্রথমত, তিনি অর্থনীতির মৌলিক বিষয় ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে আসছেন, এখনো করছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি একজন সংগঠক হিসাবে সর্বজনের জন্য রাজনীতিকে গতি দিয়েছেন। তৃতীয়ত, তিনি বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠের আইকন হয়ে উঠেছেন। সর্বজনের বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে আলোচনা জারি রেখেছেন।
আনু মুহাম্মদের কাজ নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লেখা যাবে। তাঁর কাজ ছেঁকে আনতে গেলে তাকাতে হবে তাঁর লেখা বইয়ের দিকে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে তাঁর অনেক বইয়ের মধ্যে কয়েকটির নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে–‘বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র’, ‘ক্রান্তিকালের বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়ন সাম্রাজ্য’, ‘পুঁজির বিশ্বযাত্রা’, ‘বাংলাদেশের কোটিপতি’, ‘মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক’, ‘আতংকের সমাজ সন্ত্রাসের অর্থনীতি’, ‘বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, উন্নয়ন সহিংসতা’, ‘পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং অনুন্নত বিশ্ব’, ‘বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং বাংলাদেশের অনুন্নয়ন’, ‘অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র : সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা’, ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীত’, ‘অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র’, ‘এঙ্গেলসের এয়ন্টি-ডুরিং’ (অর্থনীতি), ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন সংকট এবং এনজিও মডেল’, ‘অর্থশাস্ত্র পরিচয়’, ‘কার্ল মার্ক্সের পুঁজি’, ‘অর্থশাস্ত্র ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি’।
১৯৭০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি দশকের অর্থনীতি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, প্রবণতা, ইতিহাস এসেছে তাঁর বেশ কিছু বইয়ে। এই দশকগুলোকে আলাদা করে বুঝতে গেলে পড়তে হবে ‘সত্তর দশকে’, ‘সামরিক শাসনের দশকে’, ‘রাজনীতির সামরিকীকরণ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশের রাজনীতি’, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতি বাংলাদেশের দুই দশক’, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ’, ‘কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ‘বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, উন্নয়নের বৈপরীত্য’, ‘সর্বজনের সম্পদ কতিপয়ের মালিকানা’, ‘করোনাকালে বাংলাদেশ’, ‘রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্র নাই’ ইত্যাদি।
সত্যি বলতে আনু মুহাম্মদের বইয়ের মোট সংখ্যা কত, আমি নিজেও জানি না। এত বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি।
আনু মুহম্মদ বাংলাদেশ তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন। গ্যাস রপ্তানি বিরোধী আন্দোলন, ফুলবাড়ি আন্দোলন, সুন্দরবন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লিখতে হলে বই লিখতে হবে একটা। তবে সে কাজটা করার অবকাশ রাখেননি তিনি। কারণ, তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের তেল গ্যাস কার সম্পদ কার বিপদ?’, ‘প্রাণ প্রকৃতি বাংলাদেশ’, ‘ফুলবাড়ি, কানসাট, গার্মেন্টস ২০০৬’। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা করে। এ বিষয়ে তাঁর বইয়ের নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারত প্রশ্ন’। তিনি সেমিনার ও গবেষণার জন্য অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। লিখেছেন, ‘বিপ্লবের জন্মভূমি কিউবা : বিশ্বায়িত পুঁজিবাদে ল্যাটিন আমেরিকা’, ‘হুগো শ্যাভেজের সাথে ভেনেজুয়েলার গল্প’।
বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো, সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ থেকে আনু মুহম্মদ সব সময় সমৃদ্ধ হন। তাঁর প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর লেখায়, আলোচনায় আর কাজ-কর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যে। ‘মানুষের সমাজ’, ‘নারী পুরুষ ও সমাজ’, ‘সমাজ, সময় ও মানুষের লড়াই’, ‘ছেঁটে ফেলা বটগাছ, খেয়ে ফেলা নদী’ – এই বইগুলোতে প্রাণ-প্রকৃতির রক্ষা নিয়ে তাঁর গভীর আকুতি, আবেগ, লড়াইয়ের শক্তি দেখতে পাওয়া যায়।
২০১৪ সাল থেকে আনু মুহাম্মদ ‘সর্বজনকথা’ জার্নাল সম্পাদনা করে আসছেন। আমি শুরু থেকে প্রকাশক। প্রকাশক হিসাবে প্রথম দিকে অনেক দায়িত্ব পালন করলেও এখন আমার কাজের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। আমাদের রেজাউল করিম ভাই অনেক দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ায় আমার খুব বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় না।
১১ বছর ধরে একটা পত্রিকা কোনো স্পন্সর ছাড়া প্রকাশ করা সহজ কথা নয়। আনু মুহাম্মদ সম্পাদক হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি কখন এত কাজ করেন, আমার জানা নেই। মাঝখানে একবার অর্থসংকটে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে মনে হয়েছিল পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিতে হবে। বিশেষ করে পত্রিকা প্রকাশের পর বিতরণ, টাকা সংগ্রহ, সাবস্ক্রাইবারদের হিসাব রাখা নিয়ে আমাদের সব সময় সংকট হয়। স্যার যেভাবে মানুষকে লেখায় অনুপ্রাণিত করতে পারেন, যেভাবে জনসংযোগ করেন তাতে লেখার সংখ্যা বেশিই হয়ে যায়।
এই করে করে ১১ বছর কেটে গেল। স্যারের কাজ নিয়ে বলতে গেলে ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকাকে বাদ দেয়া যায় না। তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন। আমাদের পত্রিকার অর্থসংকটের কারণে অনেকবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল শুধু অনলাইনে প্রকাশ করা নিয়ে। এই কথা বললে তাঁর চেহারাটা চুপসে যায়। চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে বুঝি, তিনি হাল ছাড়তে রাজি নন। কাজেই আমরা আবার হাল ধরি। এগিয়ে আসেন স্যারের সহযাত্রী, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, পাঠক, সমাজসেবী, পরিবেশকর্মীসহ আরও অনেকেই। এই পাঠকদের কারণেই বেঁচে আছে ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকা।
আনু মুহাম্মদ স্যারকে নিয়ে লিখতে গেলে কোনোদিন লেখা শেষ হবে না। আজ শুধু তাঁর বই আর পত্রিকা নিয়ে আংশিক লিখেছি। কারণ, এই প্রকাশনাগুলোর পাতায় পাতায় তাঁর চিন্তাগুলো লেখা রয়েছে। তাঁকে জানতে হলে সামনে থেকে দেখার প্রয়োজন কম, পড়ার প্রয়োজন বেশি।
আমি আনু মুহাম্মদের সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে দুই কলম লিখেছি। এর আগে ‘মেঘবার্তা’র সম্পাদক, লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং আরও অনেক প্রকাশনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। বহু তরুণ লেখক গবেষকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, মতবিনিময় করেছেন, ভ্রমণ করেছেন। এ সময়ের সব প্রতিবাদী তরুণদের প্রেরণা তিনি। আমাদের মধ্যে তরুণ হয়ে আনু মুহাম্মদ আরও অনেক জন্মদিনে প্রাণ ও প্রকৃতিকে আলোকিত করে যান। জন্মদিনে এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।
সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে জন্মগ্রহণকারী আনু মুহাম্মদ স্যারের চুল কবে থেকে পাকা শুরু হয়েছে, খেয়াল করিনি। তবে শেষপর্যন্ত আনু মুহাম্মদ স্যারের সঙ্গে ‘সর্বজনকথা’ জার্নালের প্রকাশ ও সম্পাদনার কাজ করতে করতে আমাদের অনেকেরই চুল পাকা শুরু হয়েছে। যখন আমাদের অনেকেরই চুল পাকেনি তখন কাজের সুবাদে তাঁর সঙ্গে আড্ডা হতো।
আড্ডা দেওয়ার ছলে যখনই একটা দরকারি বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশ করতাম, তখনই আনু স্যারের রাজনৈতিক মগজে কাজ করত কীভাবে এই কথাটা প্রকাশ করা যায়। ফোন করে বলতেন, ‘ঋতু-উ-উ। কালকে একটা প্রোগ্রাম আছে, আসো।’। তারপর বলতেন, ‘ওইখানে বসছ কেন? স্টেজে এসে বসো।’ তারপর মাইকটা এগিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘বলো।’ আমার অবস্থা হতো ‘অ্যাঁ’!
অপ্রস্তুত অবস্থায় কী বলতাম জানি না। কোনোমতে উতরে যেতাম। আমরা অনেকেই মাথায় অনেক কথা নিয়ে ঘুরি, কিন্তু ঠিক মতো বলতে পারি না। অনেক সময় লেখার অনেক বিষয় থাকলেও লিখতে পারি না। এটা বুঝেই স্যার এরকম করতেন। এটা শুধু আমার অভিজ্ঞতা নয়। আমরা যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছি, সবার অভিজ্ঞতাই কাছাকাছি। তিনি এখনো এরকমই করেন। এখনো ত্রাসের মধ্যে থাকি, কখন কী বলতে হয়।
সেদিনও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির আলোচনায় স্টেজে যাব না বলার পর স্যার বলেন, দর্শকের সারিতে ঠান্ডা বেশি, স্টেজে ঠান্ডা কম। এখানে বসলে বাতাস কম লাগবে। এরকম খেলার ছলে আমাদের যত ইনকনফিডেন্স আছে, সেগুলোকে তিনি গুঁড়িয়ে দেন। কথা বলার স্পেস তৈরি করেন। হাতপা কাঁপতে কাঁপতে কথা বলে আসি। কথা সুন্দর গুছিয়ে না বললেও পরে মনে শান্তি হয় এই ভেবে যে ওই বিষয়ে অন্তত প্রতিবাদী বাক্যটা তো উচ্চারণ করে এসেছি।
এই হলো আনু মুহাম্মদ। একজন চুম্বক-চরিত্র। একজন প্রকৃত পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল। তিনি শুধু একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়ালের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি হয়ে উঠেছেন অসংখ্য সত্যভাষী প্রতিবাদী মানুষের প্রেরণা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো হোক কিংবা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো হোক, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মেকানিজম যদি না থাকে—যেকোনো সমাজেই প্রশ্নহীনতা, নজরদারিহীনতা হতাশার চাষাবাদ করে। আনু মুহাম্মদ একজন পাবলিক ইন্টেলেচ্যুয়াল হিসেবে হতাশার চাষাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছেন। অন্ধকারে বাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল ‘ঢাকা স্ট্রিম’ থেকে ফোন করে যখন আমাকে স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে লিখতে বলা হলো, আমি গভীর সমুদ্রে পড়ে গেলাম। এই সমুদ্র থেকে উঠে আসা কঠিন। ১ নম্বর অপরাধ হলো, স্যারকে নিয়ে কখনো কিছু লিখি না। দ্বিতীয় হলো, একটা প্রবন্ধ লিখে আসলে তাঁর সম্পর্কে কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি একজন ব্যক্তি নয়, একটা রাজনীতি। তাঁকে নিয়ে লিখলে তাঁর রাজনীতি নিয়ে লিখতে হবে।
আমরা যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখি, তাঁদের জন্য তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখানোর ঝুঁকি থেকে যায়। তাঁর বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, স্মৃতি সামনে চলে আসে। তাঁর রাজনীতিটা হারিয়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। এ কারণে আনু মুহাম্মদকে নিয়ে লেখা গভীর সমুদ্রে পতিত হওয়ার মতো ঘটনা।
আনু মুহাম্মদ একজন শিক্ষক, লেখক, সংগঠক—সর্বোপরি একজন আপোসহীন প্রতিবাদী কণ্ঠ। আমরা তাঁকে পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা জনবুদ্ধিজীবী বলি নানা কারণে। প্রথমত, তিনি অর্থনীতির মৌলিক বিষয় ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে আসছেন, এখনো করছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি একজন সংগঠক হিসাবে সর্বজনের জন্য রাজনীতিকে গতি দিয়েছেন। তৃতীয়ত, তিনি বাংলাদেশের প্রতিবাদী কণ্ঠের আইকন হয়ে উঠেছেন। সর্বজনের বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে আলোচনা জারি রেখেছেন।
আনু মুহাম্মদের কাজ নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লেখা যাবে। তাঁর কাজ ছেঁকে আনতে গেলে তাকাতে হবে তাঁর লেখা বইয়ের দিকে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে তাঁর অনেক বইয়ের মধ্যে কয়েকটির নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে–‘বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র’, ‘ক্রান্তিকালের বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়ন সাম্রাজ্য’, ‘পুঁজির বিশ্বযাত্রা’, ‘বাংলাদেশের কোটিপতি’, ‘মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক’, ‘আতংকের সমাজ সন্ত্রাসের অর্থনীতি’, ‘বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, উন্নয়ন সহিংসতা’, ‘পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং অনুন্নত বিশ্ব’, ‘বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং বাংলাদেশের অনুন্নয়ন’, ‘অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র : সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা’, ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীত’, ‘অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র’, ‘এঙ্গেলসের এয়ন্টি-ডুরিং’ (অর্থনীতি), ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন সংকট এবং এনজিও মডেল’, ‘অর্থশাস্ত্র পরিচয়’, ‘কার্ল মার্ক্সের পুঁজি’, ‘অর্থশাস্ত্র ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি’।
১৯৭০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি দশকের অর্থনীতি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, প্রবণতা, ইতিহাস এসেছে তাঁর বেশ কিছু বইয়ে। এই দশকগুলোকে আলাদা করে বুঝতে গেলে পড়তে হবে ‘সত্তর দশকে’, ‘সামরিক শাসনের দশকে’, ‘রাজনীতির সামরিকীকরণ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশের রাজনীতি’, ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতি বাংলাদেশের দুই দশক’, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ’, ‘কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ‘বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, উন্নয়নের বৈপরীত্য’, ‘সর্বজনের সম্পদ কতিপয়ের মালিকানা’, ‘করোনাকালে বাংলাদেশ’, ‘রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্র নাই’ ইত্যাদি।
সত্যি বলতে আনু মুহাম্মদের বইয়ের মোট সংখ্যা কত, আমি নিজেও জানি না। এত বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি।
আনু মুহম্মদ বাংলাদেশ তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন। গ্যাস রপ্তানি বিরোধী আন্দোলন, ফুলবাড়ি আন্দোলন, সুন্দরবন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লিখতে হলে বই লিখতে হবে একটা। তবে সে কাজটা করার অবকাশ রাখেননি তিনি। কারণ, তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের তেল গ্যাস কার সম্পদ কার বিপদ?’, ‘প্রাণ প্রকৃতি বাংলাদেশ’, ‘ফুলবাড়ি, কানসাট, গার্মেন্টস ২০০৬’। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা করে। এ বিষয়ে তাঁর বইয়ের নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারত প্রশ্ন’। তিনি সেমিনার ও গবেষণার জন্য অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। লিখেছেন, ‘বিপ্লবের জন্মভূমি কিউবা : বিশ্বায়িত পুঁজিবাদে ল্যাটিন আমেরিকা’, ‘হুগো শ্যাভেজের সাথে ভেনেজুয়েলার গল্প’।
বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো, সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ থেকে আনু মুহম্মদ সব সময় সমৃদ্ধ হন। তাঁর প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর লেখায়, আলোচনায় আর কাজ-কর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যে। ‘মানুষের সমাজ’, ‘নারী পুরুষ ও সমাজ’, ‘সমাজ, সময় ও মানুষের লড়াই’, ‘ছেঁটে ফেলা বটগাছ, খেয়ে ফেলা নদী’ – এই বইগুলোতে প্রাণ-প্রকৃতির রক্ষা নিয়ে তাঁর গভীর আকুতি, আবেগ, লড়াইয়ের শক্তি দেখতে পাওয়া যায়।
২০১৪ সাল থেকে আনু মুহাম্মদ ‘সর্বজনকথা’ জার্নাল সম্পাদনা করে আসছেন। আমি শুরু থেকে প্রকাশক। প্রকাশক হিসাবে প্রথম দিকে অনেক দায়িত্ব পালন করলেও এখন আমার কাজের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। আমাদের রেজাউল করিম ভাই অনেক দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ায় আমার খুব বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় না।
১১ বছর ধরে একটা পত্রিকা কোনো স্পন্সর ছাড়া প্রকাশ করা সহজ কথা নয়। আনু মুহাম্মদ সম্পাদক হিসাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি কখন এত কাজ করেন, আমার জানা নেই। মাঝখানে একবার অর্থসংকটে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে মনে হয়েছিল পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিতে হবে। বিশেষ করে পত্রিকা প্রকাশের পর বিতরণ, টাকা সংগ্রহ, সাবস্ক্রাইবারদের হিসাব রাখা নিয়ে আমাদের সব সময় সংকট হয়। স্যার যেভাবে মানুষকে লেখায় অনুপ্রাণিত করতে পারেন, যেভাবে জনসংযোগ করেন তাতে লেখার সংখ্যা বেশিই হয়ে যায়।
এই করে করে ১১ বছর কেটে গেল। স্যারের কাজ নিয়ে বলতে গেলে ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকাকে বাদ দেয়া যায় না। তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি, পত্রিকা প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন। আমাদের পত্রিকার অর্থসংকটের কারণে অনেকবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল শুধু অনলাইনে প্রকাশ করা নিয়ে। এই কথা বললে তাঁর চেহারাটা চুপসে যায়। চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে বুঝি, তিনি হাল ছাড়তে রাজি নন। কাজেই আমরা আবার হাল ধরি। এগিয়ে আসেন স্যারের সহযাত্রী, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, পাঠক, সমাজসেবী, পরিবেশকর্মীসহ আরও অনেকেই। এই পাঠকদের কারণেই বেঁচে আছে ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকা।
আনু মুহাম্মদ স্যারকে নিয়ে লিখতে গেলে কোনোদিন লেখা শেষ হবে না। আজ শুধু তাঁর বই আর পত্রিকা নিয়ে আংশিক লিখেছি। কারণ, এই প্রকাশনাগুলোর পাতায় পাতায় তাঁর চিন্তাগুলো লেখা রয়েছে। তাঁকে জানতে হলে সামনে থেকে দেখার প্রয়োজন কম, পড়ার প্রয়োজন বেশি।
আমি আনু মুহাম্মদের সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে দুই কলম লিখেছি। এর আগে ‘মেঘবার্তা’র সম্পাদক, লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং আরও অনেক প্রকাশনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। বহু তরুণ লেখক গবেষকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, মতবিনিময় করেছেন, ভ্রমণ করেছেন। এ সময়ের সব প্রতিবাদী তরুণদের প্রেরণা তিনি। আমাদের মধ্যে তরুণ হয়ে আনু মুহাম্মদ আরও অনেক জন্মদিনে প্রাণ ও প্রকৃতিকে আলোকিত করে যান। জন্মদিনে এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।
আধুনিক কালে সংগীত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি ও মিডিয়ার গুরুত্ব সুগভীর। একজন শিশু নৈতিক জ্ঞান কি শুধু ধর্ম থেকেই পায়? নাকি ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, পরিবেশ, ইতিহাস, দর্শন সবকিছু থেকেই পেতে পারে?
১০ ঘণ্টা আগেগতকাল বিকেল বেলা, একপশলা বৃষ্টি কেবল শেষ হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে নিউজরুমে বসলাম ট্রেন্ডি কোনো ইস্যু নিয়ে স্যাটায়ার লিখব বলে। কিন্তু ট্রেন্ডে এমন কিছু পেলাম না, যা সম্পর্কে আমার জানাশোনা আছে। পেলাম হানিয়া আমিরকে। আমি তাঁকে চিনি না।
১ দিন আগেজাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব শান্তি দিবস (২১ সেপ্টেম্বর) কথা শুনলে মানুষের মনে এমন ক্ষোভ ও ব্যঙ্গ জাগতেই পারে যে, এসব দিবস দিয়ে আর কী আসে যায়, যেখানে যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই দেশবিদেশ নির্বিশেষে কেবল নিরন্তর যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের খবর। সঙ্গে সঙ্গে এমন হতাশাও তৈরি হয় যে বাংলাদেশেও শান্তি বলে কিছু নেই!
১ দিন আগেরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাঙ্গনকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নয়, অরাজকতার দুর্গে পরিণত হবে।
১ দিন আগে