leadT1ad

কেমন চলছে পূজার প্রস্তুতি

‘ষষ্ঠীর মধ্যে প্রতিমার কাজ শেষ হবে তো? হইতেই হইব’

কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ
ঢাকা
প্রতিমায় শেষ সময়ের আঁচর দিচ্ছেন শিল্পীরা। স্ট্রিম ছবি

চারপাশে যেন রঙের ছড়াছড়ি। খড়, মাটি আর ছোট-বড় বস্তা পড়ে আছে এদিক-সেদিক। এর মধ্যেই কাজ করে চলেছেন কৃষ্ণ পাল। বয়সে তরুণ এ মৃৎশিল্পী জানালেন, এবার পূজায় ৯টি প্রতিমা তৈরির কাজ নিয়েছেন তিনি। শাঁখারী বাজারের কাজ সেরে তাঁকে ছুটতে হবে দোহারে, সেখান থেকে মুন্সীগঞ্জে। সেখানেও যে প্রতিমা বানানোর অগ্রিম নিয়ে রেখেছেন।

গত রোববার রাজধানীর পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারের এক গলিতে কৃষ্ণ পালের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ‘এত কাজ নিয়েছেন, ষষ্ঠীর মধ্যে শেষ হবে তো?’—জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে জানালেন, ‘শেষ হইতেই হইব।’

২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে দুর্গাপূজা—সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পূজাকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। শাঁখারি বাজারের অলিগলি ঘুরে দেখা গেছে, পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। ভিড় জমে আছে পূজার সামগ্রী, স্বর্ণ ও শাঁখা-পলার দোকানে, বিক্রেতারাও ব্যস্ত।

কৃষ্ণ পাল বললেন, আরও আড়াই-তিন মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, একেকটি প্রতিমা তৈরি করতে সাত থেকে আট দিন সময় লাগে তাঁর। অবশ্য তিনি একা নন। তাঁর দলে আরও চারজন কারিগর আছেন। প্রতিমা-ভেদে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিচ্ছেন তিনি ও তাঁর দল। এর মধ্যে অবশ্য কাঁচামালের খরচ আছে।

বংশে তিনিই প্রথম প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন বলে জানান কৃষ্ণ পাল। তবে পল্টন পালের ক্ষেত্রে এ পেশাটা অবশ্য বংশানুক্রমিক। শাঁখারি বাজারের ছোট এক দোকানকেই নিজের স্টুডিও বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। সেখানেই কাজের ফাঁকে স্ট্রিমকে জানান, তাঁর দাদু, বাবা, বড় ভাই এবং তিনি—সবাই প্রতিমা তৈরির সঙ্গে জড়িত।

তবে পল্টন পালকে দিয়েই ‘খুব সম্ভবত’ তাঁর পরিবার এই ধারার ইতি টানতে চলেছে। তাঁর পরে আর কেউ এ পেশা বেছে নেয়নি। প্রতিমা তৈরির কাজ কতদূর এগোলো– এমন প্রশ্নের উত্তরে পল্টন জানালেন, প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। বাকি কাজ পূজার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি অবশ্য একাই কাজ করেন। প্রতি বছর তিন-চারটি প্রতিমার কাজ নিলেও এবার অসুস্থতার জন্য একটি প্রতিমাই বানাচ্ছেন।

পল্টন পাল ও তাঁর বানানো প্রতিমা। স্ট্রিম ছবি
পল্টন পাল ও তাঁর বানানো প্রতিমা। স্ট্রিম ছবি

পল্টন পালের তৈরি প্রতিমা উচ্চতায় প্রায় ৭ ফুট। এমন একটি প্রতিমা তৈরিতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি। এর মধ্যে অর্ধেক তাঁর পারিশ্রমিক। তবে এখানেই শেষ নয়। পল্টন জানান, প্রতিমা তৈরির পর বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সাজাতে আরও প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাগে।

পূজার প্রস্তুতিতে শুধু প্রতিমা শিল্পীরাই ব্যস্ত, এমনটি নয়। শাঁখারি বাজারের মা পদ্মা শঙ্খ ভাণ্ডারের দোকানি অভিজিৎ সুর স্ট্রিমকে জানান, পূজা কেন্দ্র করে শাঁখা, পলা ও আলতার বেচাকেনাও বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে পূজার বিক্রিবাট্টা শুরু হয়ে গেছে। তবে সামনে এটি আরও বাড়বে। এমনিতে এই দোকানে দৈনিক বিক্রি হয় ৫-৬ হাজার টাকা, তবে পূজার সময় তা বেড়ে ১০-১২ হাজার হয় বলে জানান তিনি।

শাঁখারী বাজারের মোটামুটি সব দোকানে ভিড় চোখে পড়লেও ব্যতিক্রম ছিল বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো। বাদ্য ভাণ্ডারের ফুলচাঁন দাসের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয় স্ট্রিমের। দোকানে বসে তবলা সারাই করছিলেন তিনি। পূজা উপলক্ষে ঢাকের চাহিদা বেড়েছে কি না, জিজ্ঞেস করতে জানালেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঢাকের বিক্রি কম।

ফুলচাঁন দাস জানান, এমনিতেই পূজা ছাড়া ঢাক খুব একটা বিক্রি হয় না। অন্য বছর যেখানে ৬-৭টা ঢাক বিক্রি হয়, এবার সেখানে এখন পর্যন্ত ঢাক বিক্রি হয়েছে তিনটি। বিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

এবার পূজায় ঢাকের বিক্রি কম। তাই অন্য বাদ্যযন্ত্রেই বেশি মনোযোগ কারিগরদের। স্ট্রিম ছবি
এবার পূজায় ঢাকের বিক্রি কম। তাই অন্য বাদ্যযন্ত্রেই বেশি মনোযোগ কারিগরদের। স্ট্রিম ছবি

পূজার প্রস্তুতি ও পরিবেশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুরোহিত সাধন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হয় স্ট্রিমের। তিনি বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার বাজেট কিছুটা বেড়েছে। এ বছর মহালয়ায় আমাদের হলে আনন্দময়ীর আগমনে অনুষ্ঠান হলো, যেটা একটা নতুন বিষয়। এ ছাড়াও এবার বেশি দিন ধরে হলে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা থাকছে, প্রতিমার আকার বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের প্রস্তুতি আগের চেয়ে ভালো।’

তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন সাধন চক্রবর্তী। নিরাপত্তার কারণে মন্দিরে নিয়মিত পাহারার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পরিস্থিতি

গত রোববার জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পূজা উপলক্ষে সাজ সাজ রব। বিভিন্ন জায়গায় কাঠ ও বাঁশের কাজ চলছে। পাশে ব্যানারে লেখা, ‘শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে উন্নয়নের কাজ চলছে।’ পূজা মণ্ডপের সামনের গ্রিলে বসছে নতুন রঙ।

সেদিন সকালে মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠান ছিল। মন্দিরের অফিস ম্যানেজার অর্জুন চন্দ্র দাস স্ট্রিমকে জানান, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রথা হলো মহালয়ার দিন বিসর্জন দেওয়া। অর্থাৎ, আগের বছরের প্রতিমা দশমীতে বিসর্জন না দিয়ে পরের বছরের মহালয়ার দিন বিসর্জন দেওয়া হয়।

দেবী দুর্গার আগমনে নতুন সাজে সেজছে পুরো ঢাকেশ্বরী মন্দির।

পূজার পরিস্থিতি নিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কী বলছে

পূজার সার্বিক পরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ স্ট্রিমকে বলেন, ‘সরকারের দিক থেকে সারা বাংলাদেশে (পূজার) বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। পূজার প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের দিক থেকে আন্তরিকতা রয়েছে।’ পূজার নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছে বলেও জানান তিনি।

তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি ছয়-সাতটা জেলাতে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এখানে ছয়টা, সত্তরটা বা ষাটটা ব্যাপার না, কিন্তু (ভাঙচুর) হয়েছে। একটাই বা হবে কেন?’

সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না বলেও এ সময় অভিযোগ করেন মণীন্দ্র কুমার নাথ।

মণীন্দ্র কুমার নাথ আরও বলেন, ‘আমরা এই ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টিত পূজা চাই না। আমরা চাই সার্বজনীনতা। কেন আমাকে পাহারা দিয়ে পূজা করতে হবে?’

পূজায় মেলা বসবে কি না, এ প্রসঙ্গে মণীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, ‘মেলা থাকবে। কিন্তু ঐ যে বলছে, মেলাতে মদ, গাঁজা বা খারাপ কোনো কিছু যদি থাকে, সেগুলিকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এটি আমাদেরও কথা।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মেলা সংক্রান্ত বক্তব্যে ভুল বার্তা গেছে বলেও জানান মণীন্দ্র কুমার। উল্লেখ্য, গত ৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পূজা উপলক্ষে অনেক সময় আশেপাশে যে মেলাগুলি হয়, তারপরে ওখানে গাঁজার আড্ডা বসে, মদের আড্ডা বসে। এগুলি কিন্তু এবার কোনো অবস্থায় হওয়া যাবে না। কোনো রকমের কোনো মেলা হবে না। বাট, ঐ ছোটখাটো দুই একটা দোকান থাকতে পারে। কমিটির থেকে পারমিশন নিয়ে তারা ঐ দোকানগুলি স্থাপন করতে পারবে।’

পূজা উপলক্ষে ভিড় বেড়েছে শাঁখারি বাজারের দোকানগুলোয়। স্ট্রিম ছবি
পূজা উপলক্ষে ভিড় বেড়েছে শাঁখারি বাজারের দোকানগুলোয়। স্ট্রিম ছবি

প্রশাসনের প্রস্তুতি

গত ১৭ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, আসন্ন দুর্গাপূজা নিরাপদে উদযাপিত হবে। পুলিশ পূজামন্ডপের নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থায় থাকবে।

তিনি আরও জানান, দুর্গাপূজা উপলক্ষে পুলিশ প্রাক-পূজা, পূজা চলাকালীন, প্রতিমা বিসর্জন ও পূজা পরবর্তী সময়ের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পুলিশ ইতিমধ্যে পূজাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা কার্যক্রম শুরু করেছে।

পূজার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে থেকে ধর্ম পালন করতে। আমরা চাই নাগরিক হিসেবে মুক্তভাবে যার যার ধর্ম পালন করতে। এ অধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ভূমিকা পালন করছে, আমরা এজন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের ধর্মীয় উৎসব পালনে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপের প্রয়োজন হবে না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত