leadT1ad

মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সম্পত্তির ‘খবর না জানা’ শেখ হাসিনা ১৩ বছর আগে কেনেন পাশের জমি

গত বছর গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বহু বছর ধরে বিভিন্ন জেলায় দরিদ্র হিন্দু পরিবারের জমি কিনেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে তাঁদের কেনা এমন ২৬টি জমির দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে স্ট্রিম। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব—

স্ট্রিম অনুসন্ধানী দল
স্ট্রিম গ্রাফিক

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার নগরঘাট। এখানে ভৈরব নদের পাড়ে রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার মাতৃসূত্রে পাওয়া প্রায় ৪ বিঘা জমি। কিন্তু ‘দীর্ঘদিন মায়ের এই সম্পত্তির খবর না জানা’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ বছর আগেই কিনেছিলেন পাশের জমিও!

পাটের গুদাম ও একটি দ্বিতল রেস্টহাউস থাকা জমিটি ২০২৩ সালের ৬ জানুয়ারি দেখতেও যান শেখ হাসিনা। ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে জমিটির মালিকানা পাওয়ার বিষয়টি শেখ হাসিনা জানতে পারেন ২০০৭ সালে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। তবে স্ট্রিমের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ১৯৯৪ সালেই এর পূর্ব পাশে প্রায় ১ বিঘা জমি কিনেছিলেন শেখ হাসিনা।

গত বছর গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বহু বছর ধরে বিভিন্ন জেলায় দরিদ্র হিন্দু পরিবারের জমি কিনেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে তাঁদের কেনা এমন ২৬টি জমির দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে স্ট্রিম।

২০২৩ সালে গুদামটির অবস্থা, এটি ‘শেখ হাসিনার গুদাম’ নামে পরিচিত। স্ট্রিম ছবি
২০২৩ সালে গুদামটির অবস্থা, এটি ‘শেখ হাসিনার গুদাম’ নামে পরিচিত। স্ট্রিম ছবি

নগরঘাটে মায়ের সম্পত্তির পাশে শেখ হাসিনার জমি কেনার বিষয়টিও এমন একটি দলিল থেকে জানতে পারে স্ট্রিম। প্রাপ্ত দলিল অনুসারে, ১৯৯৪ সালের ২ মে শেখ হাসিনা নগরঘাট এলাকায় শান্তি পদ দাস ও তাঁর বাবা ঠাকুর পদ দাসের কাছ থেকে বসতভিটা ও গোলপাতার ঘেরসহ ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ জমি কেনেন।

দিঘলিয়া মৌজার ৮০৫ নম্বর খতিয়ানের ২২৫২ নম্বর দাগে অবস্থিত জমিটির জন্য ১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। সংখ্যালঘু পরিবারটি তাদের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির পর দেশ ছেড়ে চলে যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাঁরা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনা জেলার হাবড়ায় বসবাস করছেন।

শেখ হাসিনার কেনা জমির দলিল
শেখ হাসিনার কেনা জমির দলিল

জমিটি দেখভাল হতো যেভাবে

সরেজমিন নগরঘাট এলাকায় দেখা যায়, জমিটির পশ্চিম পাশেই রয়েছে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অংশ। অথচ ২০২৩ সালে শেখ হাসিনার সফরের সময় মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে নগরঘাট এলাকায় ১ একর ৪৪ শতক (৪ বিঘা) জমিতে পাট গোডাউন ও এক কক্ষ বিশিষ্ট ঘরসহ জমি কেনেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর গুদামের চিত্র। স্ট্রিম ছবি
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর গুদামের চিত্র। স্ট্রিম ছবি

প্রথম দিকে শেখ মুজিবের ছোটভাই শেখ আবু নাসের জমিটি দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীকালে এটি দেখভাল করতেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট এবং সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, মা-বাবার মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা জমিটির মালিক হলেও তিনি তা জানতেন না। ২০০৭ সালে ব্যক্তিগত আইনজীবীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা জমিটির খোঁজ পান।

তবে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বেগম মন্নুজান সুফিয়ান যেহেতু এ জমির দেখভাল করতেন, তাই জমির বিষয়টি সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতেন না; এমন দাবি সন্দেহের উদ্রেক করে। ওই সময় গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত যে খবর বেরিয়েছিল, তার কোনো প্রতিবাদও শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়নি।

গুদামের ভেতরের চিত্র। স্ট্রিম ছবি
গুদামের ভেতরের চিত্র। স্ট্রিম ছবি

গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ভিউ-এর ছবি থেকে যা দেখা গেল

গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ভিউয়ের ছবিতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এই জমিতে একটি ছোট ও পুরোনো গুদাম ছিল। ওই বছরের ১ নভেম্বরের ছবিতে জায়গাটি ফাঁকা দেখা যায়। কিন্তু পরের ছবিগুলোতে দেখা যায় নির্মাণকাজ চলছে।

বিভিন্ন সময়ে গুগলের স্যাটেলাইট ভিউতে গুদামের স্থানের চিত্র
বিভিন্ন সময়ে গুগলের স্যাটেলাইট ভিউতে গুদামের স্থানের চিত্র

আর ২০২০ সালের ১৩ মার্চ স্যাটেলাইট ভিউতে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে আধুনিক গুদাম ও অতিথিশালা; যা এখনো বর্তমান। এ ছাড়া গোডাউনসংলগ্ন পাকা রাস্তার নামকরণ করা হয় শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেলের নামে।

সরেজমিন নগরঘাট

দিঘলিয়া উপজেলার গ্রামটি খুলনা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। সরাসরি কোনো যানবাহনের চলাচল না থাকায় সেখানে পৌঁছাতে প্রথমে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তায় অটোরিকশা বা ভাড়া গাড়িতে যেতে হয় রেলিঘাট পর্যন্ত। এরপর সেখান থেকে ভৈরব নদী পার হতে হয় নৌকা বা ফেরিতে।

তারপর ঘাটের পাশেই দেখা যায় শেখ পরিবারের সেই জমি, যার প্রবেশপথে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘শেখ হাসিনার বাড়ি’। এখানে নদী ঘেঁষেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি দ্বিতল অতিথিশালা। এরপরই তৈরি করা হয়েছে বড় একটি পাটের গুদাম। গ্রামে এটি ‘শেখ হাসিনার গুদাম’ নামে পরিচিত। এই গুদামঘেঁষা পূর্বপাশের জমিটিই শেখ হাসিনা কেনেন ১৯৯৪ সালে।

শেখ হাসিনা যাঁর কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন, সেই শান্তি পদ দাসের বসতভিটার একাংশ। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। স্ট্রিম ছবি
শেখ হাসিনা যাঁর কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন, সেই শান্তি পদ দাসের বসতভিটার একাংশ। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। স্ট্রিম ছবি

২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এখানে থাকছেন জাহিদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী বিলকিস বেগম। তাঁরা বসবাস করছেন সেই টিনশেড ঘরে, যেখানে আগে শান্তি পদ দাস থাকতেন।

স্ট্রিমকে বিলকিস জানান, তিনি শুনেছেন, শেখ হাসিনা সরাসরি শান্তি পদ দাসের কাছ থেকে জমিটি কিনেছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে শান্তির ভাই গোপাল পদ দাস ভারত থেকে এসেছিলেন। তিনি ছবি ও ভিডিও করেন। যাওয়ার সময় বলে যান, ‘এই বাড়ির প্রতিটি কোনা আমাদের হাতে তৈরি। দয়া করে যত্ন করে রাখবেন।’

বর্তমানে শেখ হাসিনার মালিকানায় থাকা পরিত্যাক্ত এই বসতভিটার একসময়ে মালিক ছিলেন শান্তি পদ দাস। জমি বিক্রির পর তাঁর পরিবার এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাবড়ায় থাকেন বলে জানা গেছে। স্ট্রিম ছবি
বর্তমানে শেখ হাসিনার মালিকানায় থাকা পরিত্যাক্ত এই বসতভিটার একসময়ে মালিক ছিলেন শান্তি পদ দাস। জমি বিক্রির পর তাঁর পরিবার এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাবড়ায় থাকেন বলে জানা গেছে। স্ট্রিম ছবি

এদিকে, শান্তি পদ দাস ১৯৮০ সালে বসতবাড়ির পাশে অখিল চন্দ্র দাস ও রতন কুমার দাসের কাছ থেকে কিছু জমি কিনেছিলেন। এই রতন কুমার দাসের বাবা ও দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরও দিঘলিয়ায় ৪৭টি হিন্দু পরিবার ছিল। এখন আছে মাত্র দুটি। হয়রানি, ব্যবসায় বাধা, শ্মশানের জমি সংকুচিত এবং মন্দিরের জমি নিয়ে সংকটের কারণে অনেক পরিবার ভারত চলে যায়। শান্তি পদ দাসেরও দৌলতপুরে দোকান ছিল, কিন্তু নিয়মিত চাঁদাবাজি ও হুমকির কারণে তিনি জমি বিক্রি করে চলে যেতে বাধ্য হন।’

শান্তি পদ দাস যখন জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন, তখন মন্নুজানের কাছ থেকে খবর পেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালে জমি কিনে নেন। তবে তিনি জমি রেজিস্ট্রির সময় উপস্থিত ছিলেন না। এরপর থেকেই মন্নুজান জমিটির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন।

বসতভিটা বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়া শান্তি পদ দাশের বাড়িতে নতুন নামফলক বসেছে। তাতে লেখা ‘শেখ হাসিনার বাড়ি’। এর ওপরে বাড়িটির এখন যিনি তত্ত্ববধায়ক, সেই মো. জাহিদুল ইসলামের নাম লেখা। স্ট্রিম ছবি
বসতভিটা বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়া শান্তি পদ দাশের বাড়িতে নতুন নামফলক বসেছে। তাতে লেখা ‘শেখ হাসিনার বাড়ি’। এর ওপরে বাড়িটির এখন যিনি তত্ত্ববধায়ক, সেই মো. জাহিদুল ইসলামের নাম লেখা। স্ট্রিম ছবি

একইভাবে সশরীরে উপস্থিত না থেকে শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি কিনেছেন। এ নিয়ে ‘‘নাবালকের জমি কিনে সরকারি খরচে যেভাবে ‘শখের বাগান’ করেছেন শেখ হাসিনা’’ এবং ‘‘এক বাজার এলাকাতেই শেখ পরিবার কিনেছে হিন্দুদের ১৫ একর জমি, বিক্রেতারা জানতেন না ক্রেতা কে’’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে স্ট্রিম। এর মধ্যে শেখ হাসিনা তাঁর স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পৈতৃক বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে কেনা জমি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আম বাগান করেন। এই বিক্রেতাদের মধ্যে তিনজন তখন ছিলেন নাবালক। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ১৭ জনের কাছ থেকে শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা এবং দুজনের ছেলেমেয়েরা কেনেন ২০ এককের বেশি জমি। কোনো ক্ষেত্রেই জমি রেজিস্ট্রির সময় শেখ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন না।

এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি কিনে জনগণের সামনে নিজেকে দীনহীন হিসেবে উপস্থাপন করা প্রতারণার শামিল। -ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন

যা বলছেন আইনজীবী

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান এ বিষয়ে স্ট্রিমকে বলেন, শেখ হাসিনা তাঁর সম্পদ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধারণা দিতেন, তার সঙ্গে এই জমি কেনার বিষয়গুলো মেলে না। বিভিন্ন সময় তিনি বলতেন, তাঁর কিছুই নেই, অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেরসহ পরিবারের সদস্যদের নামে জমি কিনে রেখেছেন। এটা আসলে তাঁর কথার সঙ্গে কাজের অসামঞ্জস্যতাই প্রমাণ করে।

তিনি আরও বলেন, এসব জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থাকছেন না, কিন্তু তাঁর নিকটাত্মীয় বা নিযুক্ত লোকজন এ সব বেচাকেনা সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন। ফলে শেখ হাসিনার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে এটি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।

শিহাব উদ্দিন খান বলেন, এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি কিনে জনগণের সামনে নিজেকে দীনহীন হিসেবে উপস্থাপন করা প্রতারণার শামিল। তাঁর সম্পৃক্ততা সরাসরি দেশের সব মানুষের সঙ্গে, অথচ জনগণের কাছে তাঁর সম্পত্তির হিসাব এভাবে লুকানো এক ধরনের শঠতা, একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যা তিনি করতে পারেন না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত