.png)
বদরুদ্দীন উমর, আবুল হাশিম, আবুল কাসেম
বদরুদ্দীন উমর, তাঁর পিতা আবুল হাশিম ও পিতামহ আবুল কাসেম—এই তিন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি নানাভাবে গঠিত হয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিগঠনে একই পরিবারের ভূমিকা অসামান্য।

সালেহ ফুয়াদ

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চিন্তক ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। তাঁর ৯৪ বছরের জীবনাবসানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তৈরি হলো এক অপূরণীয় শূন্যস্থান। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, উপমহাদেশের মনন জগত ও রাজনীতিতে সেই পরিবারের রয়েছে তিন প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব।
১৯২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বদরুদ্দীন উমরের জন্ম। তাঁর বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবার আবুল হাশিমের পিতা আবুল কাসেম ছিলেন কংগ্রেসের বিধায়ক ও শীর্ষস্থানীয় নেতা। দেশভাগের কয়েক বছর পরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা থেকে তাঁরা এদেশে আসেন।
বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমর আজীবন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জীবন স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) তিনি যোগ দিয়েছিলেন গত শতকের ষাটের দশকে। এরপর আমৃত্যু তিনি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক ও সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ছিলেন আপসহীন, স্পষ্টবাদী ও নির্মল। ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে মানুষের সংগ্রামের কথা লিখে গেছেন শতাধিক বইয়ে।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি বলা যায় বদরুদ্দীন উমরকে। তাঁর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। এ বছর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল সরকার। তবে বদরুদ্দীন উমর এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন না জানিয়ে বিবৃতি দেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল, তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি।

বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও ইসলামী চিন্তাবিদ। ১৯৩১ সালে আইন শাস্ত্রে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই বর্ধমান জেলা কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
পিতা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর নিজের লেখায় জানাচ্ছেন, পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে ১৯৩৬ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন আবুল হাশিম এবং বর্ধমান থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে বাংলায় মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
উমরের মতে, প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে মুসলিম লীগের সাফল্য প্রধানত হাশিমের গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। হাশিম ছিলেন ১৯৪৭ সালের ‘অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা’পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার। তবে তাঁর এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।
ভারত বিভাগের পর আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক আইনসভার বিরোধীদলের সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে আবুল হাশিম পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। স্থায়ীভাবে বসবার শুরু করেন ঢাকায়। ওই সময় পরিবারের সঙ্গে বদরুদ্দীন উমরেরও এদেশে আসা। বাংলাদেশে এসে ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন আবুল হাশিম। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেপ্তার হন। প্রায় ১৬ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পান এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।
সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে আবুল হাশিম ‘খিলাফত-ই-রববানী পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামী আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল এ দলের উদ্দেশ্য। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এ দলের সভাপতি ছিলেন তিনি।
ইতিহাসবিদ গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া লিখেছেন, দুর্ভাগ্যবশত গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকে আবুল হাশিমের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে জ্ঞানচর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
আইয়ুব খানের শাসনামলে আবুল হাশিম ইসলামিক একাডেমির (যেটি বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে পরিচিত) পরিচালক ছিলেন। এ পদে থাকাকালীন তাঁর উদ্যোগে মূল আরবি থেকে পবিত্র কুরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ও তিনি আইয়ুব খানের বাঙালি-বিরোধী কার্যক্রমের প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তান সরকারের বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের ঘোষণা করলে আবুল হাশিম এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন আবুল হাশিম। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ক্রিড অব ইসলাম’, ‘ইন রেট্রোসপেকশন’, ‘লেট আস গো টু ওয়ার’, ‘অ্যাজ আই সি ইট’।
আবুল হাশিমের পিতা ও বদরুদ্দীন উমরের পিতামহ আবুল কাসেম ছিলেন কংগ্রেসের বিধায়ক ও শীর্ষস্থানীয় নেতা। ১৮৯৫ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।
১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত আবুল কাসেম তাঁর চাচা ভুপালের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াব আবদুল জব্বারের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। ১৯০৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি ও সাংবিধানিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১) প্রভাবশালী জাতীয় নেতা ছিলেন আবুল কাসেম।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর পিতামহ আবুল কাসেম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুসলিম লীগ গঠনের সমান্তরালে কলকাতায় ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন মাদ্রাজের সৈয়দ মোহাম্মদ বাহাদুর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ব্যারিস্টার আবদুর রসুল ছিলেন যথাক্রমে এর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। বাংলা থেকে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। একই বছর বাংলার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতাদের উদ্যোগে বেঙ্গল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে অপর একটি সংগঠন গড়ে ওঠে এবং আবুল কাসেম হন এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক। এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল। এ সময়েই তিনি বর্ধমান মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন।
আবুল কাসেম জীবনের প্রথমদিকে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ‘দ্য মোসলমান’ প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক হন তিনি। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি অল্পায়ু পত্রিকা--যেমন, ‘মুসলিম ক্রনিকল’, ‘মুসলিম আউটলুক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নবযুগ’ প্রকাশে এ কে ফজলুল হককে সহযোগিতা করেন। পাশাপাশি অন্য সংবাদপত্র—‘প্রোগ্রেস’, ‘মুসলিম স্টান্ডার্ড’ ও ‘মোসলেম বাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন আবুল কাসেম।
আবুল কাসেম বর্ধমান-বাঁকুড়া বিধান সভা থেকে ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী রাউলাট বিলের (১৯১৯) বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ দুইয়ের প্রতিবাদে তিনি ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গীয় আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন।
১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন আবুল কাসেম। ১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে খিলাফতের যে প্রতিনিধি দল ইউরোপে পাঠানো হয়, তিনি ছিলেন তার সদস্য। খিলাফত আন্দোলন শেষে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট আইন (১৯১৯) অনুসারে প্রথম যে ভারতীয় আইন পরিষদ (১৯২১-১৯২৩) গঠিত হয়, তার সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। পরে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের (১৯২৪-২৬) মনোনীত সদস্যও হয়েছিলেন। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ১৯২৭ সালে তিনি আবারও আইন পরিষদে প্রবেশ করেন এবং আমৃত্যু সদস্য পদে বহাল ছিলেন।
প্রায় প্রতিবছর দামোদর, অজয় ও কুনুর নদীর প্রভাবে বর্ধমান, বীরভুম ও বাঁকুড়া জেলায় বন্যা দেখা দিত। আবুল কাসেম এই এলাকায় বন্যার ত্রাণের কাজ সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সহায়তা করেন রাস্তা নির্মাণ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রচেষ্টায়। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্ধমান টাউন স্কুল।
বদরুদ্দীন উমর, তাঁর পিতা আবুল হাশিম ও পিতামহ আবুল কাসেম—এই তিন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি নানাভাবে গঠিত হয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিগঠনে একই পরিবারের ভূমিকা অসামান্য।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চিন্তক ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। তাঁর ৯৪ বছরের জীবনাবসানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তৈরি হলো এক অপূরণীয় শূন্যস্থান। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, উপমহাদেশের মনন জগত ও রাজনীতিতে সেই পরিবারের রয়েছে তিন প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব।
১৯২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বদরুদ্দীন উমরের জন্ম। তাঁর বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবার আবুল হাশিমের পিতা আবুল কাসেম ছিলেন কংগ্রেসের বিধায়ক ও শীর্ষস্থানীয় নেতা। দেশভাগের কয়েক বছর পরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলা থেকে তাঁরা এদেশে আসেন।
বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমর আজীবন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জীবন স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) তিনি যোগ দিয়েছিলেন গত শতকের ষাটের দশকে। এরপর আমৃত্যু তিনি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক-বিশ্লেষক ও সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ছিলেন আপসহীন, স্পষ্টবাদী ও নির্মল। ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে মানুষের সংগ্রামের কথা লিখে গেছেন শতাধিক বইয়ে।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি বলা যায় বদরুদ্দীন উমরকে। তাঁর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। এ বছর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল সরকার। তবে বদরুদ্দীন উমর এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন না জানিয়ে বিবৃতি দেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল, তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি।

বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও ইসলামী চিন্তাবিদ। ১৯৩১ সালে আইন শাস্ত্রে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই বর্ধমান জেলা কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
পিতা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর নিজের লেখায় জানাচ্ছেন, পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে ১৯৩৬ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন আবুল হাশিম এবং বর্ধমান থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে বাংলায় মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
উমরের মতে, প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে মুসলিম লীগের সাফল্য প্রধানত হাশিমের গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। হাশিম ছিলেন ১৯৪৭ সালের ‘অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা’পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার। তবে তাঁর এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।
ভারত বিভাগের পর আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক আইনসভার বিরোধীদলের সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে আবুল হাশিম পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। স্থায়ীভাবে বসবার শুরু করেন ঢাকায়। ওই সময় পরিবারের সঙ্গে বদরুদ্দীন উমরেরও এদেশে আসা। বাংলাদেশে এসে ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন আবুল হাশিম। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেপ্তার হন। প্রায় ১৬ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পান এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।
সমসাময়িক রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে আবুল হাশিম ‘খিলাফত-ই-রববানী পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ইসলামী আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল এ দলের উদ্দেশ্য। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এ দলের সভাপতি ছিলেন তিনি।
ইতিহাসবিদ গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া লিখেছেন, দুর্ভাগ্যবশত গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকে আবুল হাশিমের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে জ্ঞানচর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
আইয়ুব খানের শাসনামলে আবুল হাশিম ইসলামিক একাডেমির (যেটি বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে পরিচিত) পরিচালক ছিলেন। এ পদে থাকাকালীন তাঁর উদ্যোগে মূল আরবি থেকে পবিত্র কুরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ও তিনি আইয়ুব খানের বাঙালি-বিরোধী কার্যক্রমের প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তান সরকারের বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের ঘোষণা করলে আবুল হাশিম এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন আবুল হাশিম। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য ক্রিড অব ইসলাম’, ‘ইন রেট্রোসপেকশন’, ‘লেট আস গো টু ওয়ার’, ‘অ্যাজ আই সি ইট’।
আবুল হাশিমের পিতা ও বদরুদ্দীন উমরের পিতামহ আবুল কাসেম ছিলেন কংগ্রেসের বিধায়ক ও শীর্ষস্থানীয় নেতা। ১৮৯৫ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।
১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত আবুল কাসেম তাঁর চাচা ভুপালের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াব আবদুল জব্বারের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। ১৯০৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি ও সাংবিধানিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১) প্রভাবশালী জাতীয় নেতা ছিলেন আবুল কাসেম।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর পিতামহ আবুল কাসেম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুসলিম লীগ গঠনের সমান্তরালে কলকাতায় ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন মাদ্রাজের সৈয়দ মোহাম্মদ বাহাদুর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ব্যারিস্টার আবদুর রসুল ছিলেন যথাক্রমে এর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। বাংলা থেকে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। একই বছর বাংলার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতাদের উদ্যোগে বেঙ্গল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে অপর একটি সংগঠন গড়ে ওঠে এবং আবুল কাসেম হন এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক। এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল। এ সময়েই তিনি বর্ধমান মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন।
আবুল কাসেম জীবনের প্রথমদিকে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ‘দ্য মোসলমান’ প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক হন তিনি। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি অল্পায়ু পত্রিকা--যেমন, ‘মুসলিম ক্রনিকল’, ‘মুসলিম আউটলুক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নবযুগ’ প্রকাশে এ কে ফজলুল হককে সহযোগিতা করেন। পাশাপাশি অন্য সংবাদপত্র—‘প্রোগ্রেস’, ‘মুসলিম স্টান্ডার্ড’ ও ‘মোসলেম বাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন আবুল কাসেম।
আবুল কাসেম বর্ধমান-বাঁকুড়া বিধান সভা থেকে ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী রাউলাট বিলের (১৯১৯) বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ দুইয়ের প্রতিবাদে তিনি ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গীয় আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন।
১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন আবুল কাসেম। ১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে খিলাফতের যে প্রতিনিধি দল ইউরোপে পাঠানো হয়, তিনি ছিলেন তার সদস্য। খিলাফত আন্দোলন শেষে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট আইন (১৯১৯) অনুসারে প্রথম যে ভারতীয় আইন পরিষদ (১৯২১-১৯২৩) গঠিত হয়, তার সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। পরে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের (১৯২৪-২৬) মনোনীত সদস্যও হয়েছিলেন। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ১৯২৭ সালে তিনি আবারও আইন পরিষদে প্রবেশ করেন এবং আমৃত্যু সদস্য পদে বহাল ছিলেন।
প্রায় প্রতিবছর দামোদর, অজয় ও কুনুর নদীর প্রভাবে বর্ধমান, বীরভুম ও বাঁকুড়া জেলায় বন্যা দেখা দিত। আবুল কাসেম এই এলাকায় বন্যার ত্রাণের কাজ সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সহায়তা করেন রাস্তা নির্মাণ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রচেষ্টায়। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্ধমান টাউন স্কুল।
বদরুদ্দীন উমর, তাঁর পিতা আবুল হাশিম ও পিতামহ আবুল কাসেম—এই তিন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি নানাভাবে গঠিত হয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিগঠনে একই পরিবারের ভূমিকা অসামান্য।
.png)

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ১৬ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের যৌথ বিশ্লেষণে।
৬ ঘণ্টা আগে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ছড়ানো অপপ্রচারকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই হুমকি মোকাবিলায় দুটি সেল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে — ‘সেন্ট্রাল ডিসইনফরমেশন মনিটরিং সেল’ ও ‘সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন সেল’।
৬ ঘণ্টা আগে
আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে পুলিশের গায়ে উঠছে নতুন পোশাক। আয়রন (লৌহ) ও কফি রঙের ইউনিফরম দিয়ে পুরনো পোশাককে বিদায় জানানো হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে পুলিশ সদস্যদের গায়ে এই নতুন ইউনিফরম দেখা যাবে।
৬ ঘণ্টা আগে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে করা আপিলের শুনানি আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আপিল বিভাগ।
৮ ঘণ্টা আগে