দেশে বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের হার এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে শহরের অনানুষ্ঠানিক বসতি বা বস্তি এলাকায় এ চিত্র বেশ ভয়াবহ। শহরের বস্তি এলাকায় ৬৫ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। আর বিয়ের প্রথম এক বছরের মধ্যেই ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভধারণ করছেন, যার প্রায় অর্ধেকই অনাকাঙ্ক্ষিত। নবদম্পতিদের ওপর পরিচালিত আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে অ্যাডসার্চ (এডসার্চ) প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত দুই বছর মেয়াদি এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য কনটেক্সট অ্যান্ড নিডস রিলেটেড টু সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (এসআরএইচআর) অ্যামং নিউলিওয়েড কাপলস ইন সিলেক্টেড রুরাল অ্যান্ড আরবান এরিয়াস অব বাংলাদেশ’ নামের এ গবেষণায় সহায়তা করেছে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা।
গবেষণার তথ্যমতে, নারীদের মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ৪৩ শতাংশ এবং শহরের অনানুষ্ঠানিক বসতিতে ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই। পুরুষদের ক্ষেত্রে গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ২১ বছরের আগে। এসব বিয়ের প্রায় সবই আইনগতভাবে নিবন্ধিত। তবে বিয়ের পরপরই শিক্ষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটছে অধিকাংশ নারীর। প্রায় অর্ধেক নারী মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি। বিয়ের পর গ্রামীণ এলাকার ৬০ শতাংশ এবং শহরের ৬৬ শতাংশ নারী পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আপত্তি, বাসস্থান পরিবর্তন এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামীণ নারীদের তুলনায় শহরের বস্তি এলাকার নারীদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি তিন গুণের বেশি। শহরের ৬৮ শতাংশ নারী সন্তান নেওয়া অন্তত দুই বছর বিলম্বিত করতে চাইলেও তাঁদের ৬৭ শতাংশই ওই সময়ের মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন।
এদিকে সামগ্রিকভাবে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৭৩ শতাংশ নারী বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই গর্ভধারণ করেছেন। মোট গর্ভধারণের ৪৭ শতাংশই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত বা সময়ের আগে।
দাম্পত্য সহিংসতা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
গবেষণায় উঠে এসেছে দাম্পত্য সহিংসতার উদ্বেগজনক চিত্র। বিয়ের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই প্রতি পাঁচজন নারীর চারজন স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। দুই বছরের ব্যবধানে অর্ধেকের বেশি নারী অর্থনৈতিক সহিংসতার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী মানসিক, শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণের কারণে নারীদের আয়মূলক কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়ছে।
আইসিডিডিআরবির চারটি স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নজরদারি ব্যবস্থা (এইচডিএসএস) এলাকায় গ্রামীণ অঞ্চলে চকরিয়া ও মাতলব এবং শহরের মিরপুর ও কড়াইল বস্তিতে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬ নবদম্পতির ছয় ধাপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করেন অ্যাডসার্চের থিম লিড এবং আইসিডিডিআরবির এমসিএইচডি বিভাগের বিজ্ঞানী ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা।
গবেষণা ফলপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন অ্যাডসার্চ প্রকল্পের সমন্বয়ক আনিসউদ্দিন আহমেদ এবং ধন্যবাদ দেন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. শামস এল আরিফিন। প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ড. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, প্রারম্ভিক মাতৃত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবিলায় কিশোর স্বাস্থ্য ও স্কুল স্বাস্থ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সমিতির (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘পরিবার ও সমাজের চাপে নারীরা অল্প বয়সে গর্ভধারণে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাঁদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। এ ক্ষেত্রে তরুণীদের পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।’