leadT1ad

বাউল নির্যাতন/ভিডিও থাকলেও হামলাকারীদের ‘চিনছে না’ কেউ

আরিফুল ইসলাম সাব্বির
আরিফুল ইসলাম সাব্বির
মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে

মানিকগঞ্জে বাউল ভক্তদের ওপর হামলা চালানো হয়। স্ট্রিম ছবি

বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তাঁর অনুসারীরা গতকাল রবিবার মানিকগঞ্জ শহরের প্রেস ক্লাবে সামনে মানববন্ধনের ডাক দেয়। একই দিন সভা আহ্বান করে হেফাজতে ইসলাম, ইমাম সমিতি, ইমাম পরিষদ, খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি সংগঠন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংঘাত এড়াতে বাউল অনুসারীদের মানববন্ধন দুই ঘণ্টা পিছিয়ে বেলা ১১টায় করতে বলে। তবে শেষ পর্যন্ত সংঘাত হয়েছে। ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’– এর ব্যানারে আসা মুসল্লিরা পুলিশের সামনে চড়াও হন বাউল অনুসারীদের ওপর। এতে উভয়পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন।

এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়ালেও হামলায় জড়িতদের কাউকে ‘চিনতে পারছেন’ না কেউ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হামলাকারী কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। আটক নেই, মামলাও হয়নি। তবে দুপক্ষই লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।

আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) ঘটনাস্থল সরেজমিনে কথা হয় তৌহিদী জনতার আহ্বানে কর্মসূচির অন্যতম সংগঠক মানিকগঞ্জ কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও জেলা ইমাম পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পূর্বঘোষণা অনুযায়ী তৌহিদী জনতা মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে মিছিল নিয়ে বিজয় মেলার মাঠের সামনে সমবেত হয়। হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, জামায়াতে ইসলামীর নেতাসহ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও মুসল্লিদের অংশগ্রহণে কর্মসূচিটি সার্বজনীন হয়ে ওঠে।’

মুজিবুর রহমানের দাবি, আমরা মিছিল নিয়ে স্টেডিয়াম মাঠের সামনে আসি। এরপর সেখানে বক্তারা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমি স্মারকলিপির জন্য গণস্বাক্ষর নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে দেখি দৌড়াদৌড়ি চলছে। এগিয়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনতে থাকি। ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।’

এ সময় প্রতিবেদক তাঁকে একটি ভবনের নিচ তলায় আটকে থাকা বাউল অনুসারীদের পেটানোর ফেসবুকের ভিডিও দেখান। হামলাকারী কাউকে চিনতে পারছেন কিনা– জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এখানে হামলাকারী কাউকে আমি চিনি না।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ওই মুহূর্তে কারও হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। বাউল ভক্তরা সময় ও কর্মসূচির স্থান লঙ্ঘন করাই বিষয়টি বড় হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’

গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরের জাবরা এলাকায় খালা পাগলীর মেলায় পালাগানের আসরে প্রশ্নোত্তর পর্বে বাউলশিল্পী আবুল সরকার আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। প্রায় ১৫ দিন পর গত ১৯ নভেম্বর রাতে মাদারীপুরে একটি গানের আসর থেকে আবুল সরকারকে আটক করে মানিকগঞ্জের ডিবি। পরদিন ঘিওর থানায় মুফতি মো. আবদুল্লাহর মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

জানা যায়, এরই জেরে শনিবার সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জ কেন্দ্রীয় মসজিদে বৈঠক করেন জেলা ইমাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়াল, ইমাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান, খেলাফত মজলিসের শেখ মাহবুবুর রহমান, আনিসুল ইসলামসহ অনেকে। বৈঠক থেকে বাউল আবুল সরকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রবিবার সকাল ৯টায় কর্মসূচি দেওয়া হয়।

কর্মসূচির দিনে স্টেডিয়াম মাঠের সামনে সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম মানিকগঞ্জের সভাপতি সাইদ নুর, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সালাউদ্দিন, জেলা জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ, জামায়াতে ইসলামীর জিয়াউর রহমানসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও মুসল্লিরা অংশ নেন।

সংঘাতের পরে সন্ধ্যায় হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলা আমির আবদুল্লাহ আল ফিরোজ। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি ও বেয়াদবিমূলক কথাবার্তা সহ্য করার মতো নয়। তবুও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শেষ করেছি। মিছিলের পরে সমাবেশে বক্তৃতার সময় কতিপয় বয়াতি আশেপাশে থাকা আমাদের কয়েকজনকে বেদম মারধর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে আমাদের কয়েকজন আহত হয়।’

শনাক্ত হয়নি হামলাকারী, কাটেনি আতঙ্ক

হামলার পর বাউল ও তাদের অনুসারীরা আতঙ্কে রয়েছেন। থানায় অভিযোগ দেওয়ার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না তারা। আজ ঘটনাস্থল দক্ষিণ সেওতায় থমথমে পরিবেশ দেখা যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল স্থানীয়রা। তাদের ভাষ্য, মানিকগঞ্জ শহরে এমন সংঘাত তারা আগে দেখেননি।

স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, রবিবার সকালে বয়াতিদের কেউ কেউ চায়ের দোকানে বসেছিলেন। অনেকে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। হঠাৎ মুসল্লিরা তাদের ধাওয়া দেয়।

স্টেডিয়াম থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে আরশাদ আলীর নির্মাণাধীন বাড়িতে আশ্রয় নেন ৭-৮ জন বাউল অনুসারী। তাদের তিনজন ছিলেন ভবনের নিচে। ভবনের বাসিন্দারা ফটক আটকে তাদের রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েকজন প্রথমে ফটক ভাঙার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে বাড়ির জানালার কাঁচে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুর শুরু করেন। বাধ্য হয়ে ফটক খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে নিচে থাকা তিন, নিচ তলার টয়লেটে আশ্রয় নেওয়া একজনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়।

নাম প্রকাশ না করে বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, সংঘর্ষ শুরু হলে কয়েকজন এসে নিচ তলায় পার্কিং স্পেসে আশ্রয় নেন। একজন বাথরুমে লুকান। মুসল্লিরা এসে সবাইকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলেন। না দেওয়ায় বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করেন। পরে বাধ্য হয়ে বাড়ির ফটক খুলে দেওয়া হয়।

বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভাতিজা পাপেল সরকার বলেছেন, পুলিশ বললে আমরা মাঠের বাইরে দূরে আড়ালে চলে যাই। কিন্তু তারা মিছিল নিয়ে আসার সময় হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করেন– ‘ওই কোনায় লোক আছে, ধর’। তারপরই অল্প বয়সী মাদ্রাসার ছাত্ররা হামলা করে। একটি ভবনে আশ্রয় নিলে, সেখানে আমাদের আরিফুল ইসলাম, আলিমসহ কয়েকজনকে পেটানো হয়। পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে।

তিনি জানান, হামলায় আমাদের সাতজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বাউলশিল্পী হেলাল সরকার, লাভলু সরকার, আরিফুল ইসলাম, আলিম, জহিরুল ও শুভকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পাপেল সরকারের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হামলাকারীরাই আমাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছে। সবাই আতঙ্কে রয়েছি। গ্রেপ্তারের ভয়ে কয়েকজন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না নিয়েই চলে গেছেন। তবে কে হুমকি দিয়েছেন, তা বলতে পারেননি তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে পাপেল সরকার বলেন, ‘সংঘাতের পর আবুল সরকারের স্ত্রী আলেয়া বেগমসহ আমরা থানায় গেলেও কোনো অভিযোগ করতে পারিনি।’ তবে আজ সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সালাউদ্দিন স্ট্রিমকে বলেন, ‘আহত বাউল আবদুল আলীম অজ্ঞাতপরিচয় অনেকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। রাতের মধ্যেই এটি মামলা হিসেবে নেওয়া হবে।’

সদর থানার ওসি কামাল হোসেন জানান, সংঘাতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তারা কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি। ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত