leadT1ad

ড্যাফোডিল-সিটি ইউনিভার্সিটি সংঘাত: পরিস্থিতি শান্ত, সিটিকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
সাভার

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ২৮
সিটি ইউনিভার্সিটি। সংগৃহীত ছবি

তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোববার গভীর রাতে সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর এখন পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে ক্ষতিগ্রস্ত সিটি ইউনিভার্সিটি। রাতভর তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকা। সোমবার দুপুরে ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত সিটি ইউনিভার্সিটির পাশে থেকে তারা ক্ষতিপূরণে সহযোগিতা করবে।

তুচ্ছ ঘটনায় শুরু সংঘর্ষ

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার রাত ৯টায় আশুলিয়ার খাগান এলাকার ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস’ হোস্টেলের সামনে সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী মোটরসাইকেল থেকে থুথু ফেললে তা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। এতে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী দেশীয় অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ওই বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।

খাগান এলাকার ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস’। স্ট্রিম ছবি
খাগান এলাকার ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস’। স্ট্রিম ছবি

এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কয়েকশো শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে গেলে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন।

একপর্যায়ে রাত ১২টার পর ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের অবরোধ করে ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় তারা প্রশাসনিক ভবন, কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল লুট করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুড়িয়ে ফেলা হয় তিনটি বাস ও একটি প্রাইভেটকার। ভাঙচুর করা হয় আরও পাঁচটি যানবাহনে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

ধ্বংসস্তূপে সিটি ইউনিভার্সিটি

সোমবার সকালে সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখা যায় আগুনে পোড়া ভবন ও যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচ, কাঠসহ ভাঙা আসবাবপত্র। একাডেমিক ভবনের জানালার থাই গ্লাস ভাঙা, ভেতরে ছড়িয়ে আছে ফাইল, ভাঙা কাচ, চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, এসি, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টারসহ নানা জিনিস। শিক্ষার্থীরা জানান, রাতে ব্যাপক লুটপাটও হয়েছে।

সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ড্যাফোডিলের এক ছাত্রের গায়ে থুতু লাগা থেকে ঘটনার শুরু। পরবর্তী সময়ে সে স্যরিও বলেছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে সেভাবে নেয়নি, তাকে সেখানে মারধর করে। এরপর তাকে আটকে রাখে। যখন বিষয়টা আমাদের কাছে আসছে, তখন আমরা এগোই। এভাবেই প্রথম অবস্থায় হয়। আমরা ঢিল ছুড়ছি, এমন পর্যন্তই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা... আমাদের ক্যাম্পাসে গেলে দেখবেন, অ্যাকাউন্টসে কোনো টাকা নাই, পাঁচটা গাড়ি ভেঙেছে, প্রত্যেকটা রুমে সব ভেঙেছে, কিছুই নেই। এগুলা কী ধরনের আচরণ? একটা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কীভাবে এসব করতে পারে?’

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঘুমন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা অস্ত্র নিয়ে আসে। মেয়েদের হলের কলাপসিবল গেটে ভাঙচুরের চেষ্টা করে, ইট ছুঁড়ে মারে। সেগুলো মেয়েদের গায়ে লেগেছে। আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ভাঙচুর করেছে।’

সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ভাঙচুরের দৃশ্য। স্ট্রিম ছবি
সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ভাঙচুরের দৃশ্য। স্ট্রিম ছবি

সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। ওরা এসে পুরো ক্যাম্পাসে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শতশত ছাত্রকে মারছে, আহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাইনি। তারা খাগান পর্যন্ত এসেছে। ড্যাফোডিলের ছেলেরা এখান পর্যন্ত এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল। কেউ রক্ষা করতে আসেনি। টানা হামলা হয়েছে, কিন্তু কেউ আসেনি। হাজার হাজার ছাত্র এখানে, আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। দুইটা ছাত্রী হল আছে, তারাও আতঙ্কে আছে। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’

সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, সেটি এখনো আমরা নিশ্চিত নই। ছাত্রদের মারামারি থেকে ক্যাম্পাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হতে পারে? এটি পরিকল্পিত। আমাদের শিক্ষার্থী আহতের সংখ্যা আনুমানিক অর্ধশতাধিক হতে পারে।’

‘আটক’ শিক্ষার্থী ও হস্তান্তর

ঘটনার পর রাতেই সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে কিছু ড্যাফোডিল শিক্ষার্থী আটকা পড়ে। সোমবার দুপুরে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ জানান, ‘ইতোমধ্যে তাদের হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রশাসনের কিছু লোকজন এসেছিলেন, তাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তো আর তাদের আটকে রাখিনি, তারা এখানে ঘুরে ফিরেই বেড়াচ্ছিল। কিন্তু যেহেতু তারা অনেকটা আটকা পড়ে গিয়েছিল, যেহেতু রাতের বেলা ছিল তো। আমরা মূলত তাদের সেইফ করার চেষ্টা করেছি কারণ কেউ যেন তাদের আঘাত করতে না পারে, এইজন্য তাদের একটা নিরাপত্তার মধ্যে আমরা রেখেছিলাম। এরপর উনারা এসে তাদের নিয়ে গেছেন।’

অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটির বাসে। স্ট্রিম ছবি
অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটির বাসে। স্ট্রিম ছবি

তবে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদের ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো তাদের পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছে। এ ছাড়া আমাদের ভিসি শিক্ষার্থীদের সেখানে ভাঙচুর করতে পাঠিয়েছেন, ছেড়ে দেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের কাছ এমন জবানবন্দিও রাখা হয়েছে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘মূলত ইউজিসি তাদের মুক্ত করেছে। ইউজিসির প্রতিনিধি দলের কাছে শিক্ষার্থীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম, শিক্ষকরাও ছিল। এখন ওই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের এখন আমরা হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর, তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়েছে।’

দায় শনাক্তে ফুটেজ চায় ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ

সোমবার দুপুরে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে অ্যাক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা একটা আক্রমণের শিকার হলাম। সংঘবদ্ধ আক্রমণের ফলে ব্যক্তি পর্যায়ের একটি বিষয় সামষ্টিক পর্যায়ে চলে গেছে। এরপর নানান ঘটনা ঘটেছে। সেটার একটা চূড়ান্ত প্রকাশ হয়েছে। আমাদের এখানে অনেক ছাত্রছাত্রী, সংখ্যায় বেশি। তারা সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে গিয়ে যা করার সেটি করেছে। সেটি আপনারা সবাই জানেন এবং সিটি ইউনিভার্সিটি যেহেতু রাস্তার ওপরে। সেখানে সেটি একটা মবের আকার ধারণ করেছে।’

সিটি ইউনিভার্সিটিতে ভাঙচুরের ঘটনা শনাক্ত কঠিন কাজ বলে মনে করেন ড্যাফোডিলের এই প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ওখানকার লোকজন জড়িত ছিল, সেটি বের করা একটি কঠিন কাজ, কারা কীভাবে করলো। কারণ ওটাতো একেবারেই মেইন রোডের সঙ্গে। কাজেই সেই জায়গাটিতে আমরা এখনো অসহায়। আসলে সেটি সঠিকভাবে কার দায় কারা দায়ী সেগুলো বের করা এবং এক্ষেত্রে সময় লাগবে এবং সিটি ইউনিভার্সিটির কো-অপারেশন লাগবে। তারা যদি আমাদের ফুটেজ দেয়, আমরা শনাক্ত করতে পারি, কোন শিক্ষার্থীরা কি করলো, কারা করলো আমরা বুঝতে পারবো।’

এখনো কিছু শিক্ষার্থী জিম্মি আছে বলে অভিযোগ করেন সৈয়দ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা যদি ট্রিগার করে বসে এই বিশাল ছাত্রসমাজকে এখানে, তাহলে কিন্তু সেই দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। সেটি সিটি ইউনিভার্সিটিকেই নিতে হবে। ছাত্র আটকে কোনো সমাধানের আলোচনা হওয়া সম্ভব না। আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর ওনাদের ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে কথা বলেছেন, আমি নিজে উনাদের প্রো ভিসির সঙ্গে কথা বলেছি যে সব হবে।’

সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্ট্রিম ছবি
সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্ট্রিম ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিভাবক ইউজিসিকে জানিয়েছি যে এসে বিচার করেন। কিন্তু যেই বিচারই করা হোক না কেন, প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে যেই শিক্ষার্থীরা জিম্মি রয়েছে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।’

তিনি বলেন, ‘তো সেই জায়গা থেকে আমি সিটি ইউনিভার্সিটির সুমতি কামনা করি, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। তাদের শিক্ষার্থীদেরও আমি বলবো আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই বন্ধু, কাজেই সেই জায়গা থেকে আমরা যেন মানবিকভাবে দেখি।’

পরিস্থিতি এখন শান্ত

সোমবার দুপুরে সাভার থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস.) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঝগড়াবিবাদ, ভাঙচুর যা হয়েছে রাতেই হয়ে গেছে। আর এ ঘটনা কেনো ঘটল, সেটি আসলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পরিবেশ কিছুটা থমথমে।’

সিটি ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা

রাতভর সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর থেকে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটির সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে আজ সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উপাচার্যের পক্ষে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মীর আকতার হোসেের সই করা জরুরি নোটিশে এ কথা জানানো হয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত