স্ট্রিম প্রতিবেদক
বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঘোষিত রোডম্যাপ প্রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আজ শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম এ দাবি করেন।
তিনি জানান, গত বছর প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করেন। এছাড়া, তিনি তাঁর রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। রোডম্যাপের বাস্তবায়ন প্রায় শতভাগ অর্জিত হয়েছে।
জানা গেছে, বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত বছরের ১১ আগস্ট বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতা ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের হারানো আস্থা ফেরাতে ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ প্রদান করেন।
ওই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা, বিচার বিভাগ সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ সারা দেশ থেকে আগত জেলা আদালতের বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন।
আগামীকাল প্রধান বিচারপতির বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তব্যে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার যথাযথ প্রতিপালনসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনা, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষ, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশসমূহের ন্যায় সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, সকল প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে দেশে সুবিচারের সংস্কৃতির উন্মেষের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কারে রূপরেখা তুলে ধরেন। সেই অনুযায়ী গত এক বছরে বিচার বিভাগে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, তা শুধু নীতিগত কাগজে কলমের পরিবর্তন নয়; বরং তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়নে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশসমূহসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ হয় তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিদের মতামত গ্রহণ করে খসড়াটি গত বছরের ২৮ অক্টোবর প্রস্তাব আকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে উপদেষ্টা পরিষদে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন হয় এবং গত ২১ জানুয়ারি অধ্যাদেশটি পাস হয়। এই অধ্যাদেশের আওতায় প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল এপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে এবং উক্ত কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বর্ণিত নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ করে স্বচ্ছ প্রকিয়ায় মেধা, দক্ষতা ও সততার নিরিখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নব দিগন্তের সূচনা হয়।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্রীকরণ নিশ্চিত করতে গত বছরের ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুলস অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে প্রস্তাব পাঠানো হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রিটে আগামী ৩ মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। অন্তবর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতকরণে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
যতদ্রুত সম্ভব বিচার বিভাগ থেকে সব প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে, সুপ্রিম কোর্টের সেবার মানোন্নয়নে প্রধান বিচারপতি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই ১২ দফা নির্দেশনার যথাসম্ভব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টে প্রতি মাসে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা নিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ তাদের নিজ নিজ দপ্তর কর্তৃক সেবা সহজিকরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেন। সুপ্রিম কোর্টের মত জেলা আদালতসমূহেও অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশের বিচার বিভাগে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বিচারসেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২ জানুয়ারি থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানি সংক্রান্ত একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধায়ন ও উদ্ভাবনে উক্ত বেঞ্চের সব কাগজাদি অনলাইনে জমা দিতে অনলাইন প্লাটফর্ম প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের অপর একটি কোম্পানি বেঞ্চে কাগজমুক্ত বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বেঞ্চসমূহেও কাগজমুক্ত কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রধান বিচারপতির রয়েছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নির্দেশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতে উপস্থিত সব আসামির আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা আবশ্যক, তাই আদালতে উপস্থিত আসামিদের কেউ যেন আইনগত সহায়তা বঞ্চিত না থাকেন। এটি নিশ্চিত করতে অধস্তন আদালত/ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে উক্ত আসামির জন্য লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল থেকে আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া, উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে আদালতে উপস্থিত কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত থাকলে উক্ত আইনজীবী যেন নির্বিঘ্নে ও বাধাহীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহযোগিতার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ রহিতক্রমে গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে জেলা জজশিপ ও সেশনস ডিভিশন পৃথককরণ এবং সংশ্লিষ্ট জজশিপ ও সেশনস ডিভিশনের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ২১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। দেশের অধস্তন আদালতসমূহে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফলে বিচারকের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে মামলা জট ও দীর্ঘসূত্রিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশেষত দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হচ্ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগের ফলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ হতে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক দায়রা বিভাগ পুনর্গঠন করা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
রোডম্যাপে বিচার বিভাগে মেধার বিকাশসহ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ চালুর ঘোষণা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচার সেবায় বিচারপ্রার্থী জনগণের অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫ এর অধীনে গঠিত সার্ভিসের বিচারিক পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠিত কমিটি এ বিষয়ে ইতিমধ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। কমিটির গত ২ সেপ্টেম্বরের সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ইতিমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১টি পদসহ মোট ২৩২টি পদ সৃষ্টি হয়েছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হলেও এ সংক্রান্ত রিভিউ দরখাস্তটি অনিষ্পন্ন ছিল। গত বছরের ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ উক্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হলে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করলে গত ১৯ নভেম্বর তাঁদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতির বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি তাদের বেঞ্চ প্রদান থেকে বিরত থাকেন। তাদের মধ্যে আটজনের বিষয় সুরাহা হয়েছে। অপর চার বিচারপতির বিষয়ে কাউন্সিলের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
রোডম্যাপে অধস্তন আদালতের বিচারকের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত বৈষম্য দূরীকরণে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আগত বিচারপ্রার্থীরা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে, সেবা গ্রহণ বিষয়ে অসুবিধার মুখোমুখি হলে তাকে সহায়তা করতে হেল্পলাইন নাম্বার চালু হয়। একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা উক্ত হেল্পলাইন পরিচালনা করেন এবং সেবাগ্রহীতাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে থাকেন। ওই হেল্পলাইন স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গত জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় হেল্পলাইনটি চালু হয়। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে হেল্পলাইন নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল অ্যাপ সার্ভিস চালু রয়েছে।
গত ১৪ মে প্রধান বিচারপতি নাগরিকদের বিচার সেবায় অভিগম্যতা এবং বিচার সংক্রান্ত অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে সব অধস্তন আদালতে বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে বাধা ও অনিয়ম দূর করতে দেশের ৬৪ জেলায় ও ৮টি মহানগরে সুপ্রিম কোর্টের আদলে হেল্পলাইন চালুর ঘোষণা দেন। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি সার্কুলার গত ১৩ মে ইস্যু করা হয়। জেলা পর্যায়ে হেল্পলাইন সার্ভিস ফলপ্রসূ করতে উক্ত সার্কুলারে প্রতি জেলায় ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগ মূলত দেশের জনগণের সেবার জন্যই গঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা এবং তা পূরণে বিচার বিভাগের কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে চলতি বছর প্রধান বিচারপতি দেশের সকল বিভাগীয় শহরে ইউএনডিপির সহায়তায় জুডিশিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যান্ড ইফিশিয়েন্সি শীর্ষক রিজিওনাল কনফারেন্স আয়োজন করেন। সেখানে বিচারক, আইনজীবী, উন্নয়ন সহযোগীসহ নানা অংশীজন অংশগ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপের বাস্তবায়নের বাস্তব রূপরেখা তৈরির মূল ভিত্তি হিসেবে উক্ত স্টেকহোল্ডার মিটিংসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিচার ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক বিচার ব্যবস্থা হিসেবে উন্নীত করতে আধুনিকায়নের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী যেমন—ইউএনডিপি, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট, জিআইজেড, ইউনিসেফ, জাইকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনার করেছেন এবং প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। বিদেশি এই সকল উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় প্রধান বিচারপতির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন দেশের যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি তাদের নিকট হতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।
এছাড়া, প্রধান বিচারপতি তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন। সেকল দেশের বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়নের আদলে কিভাবে দেশের বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা যায় সে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পারস্পরিক দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং উক্ত দেশের বিচারব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি কেবল দেশের মধ্যেই নয় বরং দেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি তাঁর রোডম্যাপ ভাষণে বিচারকগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে তিনি গত ৬ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি এস এম এমদাদুল হককে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ১৩ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট হতে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের ৩০ শতাংশ বিচারিক ভাতা বিদ্যমান পে-স্কেপ হতে প্রদান সংক্রান্ত একটি পত্র আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়, যা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সরকারের অন্যান্য কর্মবিভাগের কর্মকর্তাদের মতো বিচারকগণের সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেন এবং এ লক্ষ্যে গত বছরের ১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনুকূলে সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হয়।
সারা দেশে অবস্থিত আদালতসমূহের প্রাঙ্গণসহ আদালতে কর্মরত বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি নানামুখি পদক্ষেপ নেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এছাড়া, আদালত ও আদালতে কর্মরত বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্দেশনা দিয়ে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়।
গত বছরের ৭ জানুয়ারির সংস্কারকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকৃত মূল ভবন ও এজলাস কক্ষ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হলো।
রোডম্যাপে বিচার সেবার আধুনিকায়নসহ দ্রুততম সময়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত চৌকি আদালতসমূহে আগত বিচারপ্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত বিচার সেবা নিশ্চিতে চৌকি আদালতসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রয়োজনীয় ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহের জন্য নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনার আলোকে গত ২ জুলাই দেশের ৪০টি চৌকি আদালতের এজলাস ও দপ্তরে ব্যবহারের জন্য মোট ৭১টি ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট ২৩টি জেলায় বর্তমানে মোট ৪০টি চৌকি আদালতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত উক্ত চৌকি আদালতসমূহে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের কার্যক্রম পরিচালতি হয়ে থাকে। উক্ত আদালতসমূহে সিনিয়র সহকারী জজ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সরবরাহকৃত উক্ত কম্পিউটারসমূহ চৌকি আদালতসমূহের কার্যক্রমে গতিশীলতার সঞ্চার করবে।
দেশের আদালতসমূহের বিচার কাজে গতিশীলতা আনতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার আলোকে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জেলা আদালতসমূহে এ পর্যন্ত মোট ৪০০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার দেওয়া হয়। এছাড়া, উক্ত সময়ে দেশের ১২০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে সুপ্রিম কোর্ট ল্যাপটপ প্রদান করেছে।
প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছরে বিচার বিভাগে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের ধারণাকে বাস্তবায়নের এক স্পষ্ট প্রতিফলন। এটি প্রত্যাশিত যে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আগামী দিনে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বমানের উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে—সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের মন্তব্য।
বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঘোষিত রোডম্যাপ প্রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আজ শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম এ দাবি করেন।
তিনি জানান, গত বছর প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করেন। এছাড়া, তিনি তাঁর রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। রোডম্যাপের বাস্তবায়ন প্রায় শতভাগ অর্জিত হয়েছে।
জানা গেছে, বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত বছরের ১১ আগস্ট বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতা ও বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের হারানো আস্থা ফেরাতে ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ প্রদান করেন।
ওই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা, বিচার বিভাগ সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ সারা দেশ থেকে আগত জেলা আদালতের বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন।
আগামীকাল প্রধান বিচারপতির বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তব্যে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার যথাযথ প্রতিপালনসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনা, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষ, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশসমূহের ন্যায় সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, সকল প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে দেশে সুবিচারের সংস্কৃতির উন্মেষের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কারে রূপরেখা তুলে ধরেন। সেই অনুযায়ী গত এক বছরে বিচার বিভাগে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, তা শুধু নীতিগত কাগজে কলমের পরিবর্তন নয়; বরং তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়নে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশসমূহসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ হয় তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিদের মতামত গ্রহণ করে খসড়াটি গত বছরের ২৮ অক্টোবর প্রস্তাব আকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে উপদেষ্টা পরিষদে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন হয় এবং গত ২১ জানুয়ারি অধ্যাদেশটি পাস হয়। এই অধ্যাদেশের আওতায় প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল এপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে এবং উক্ত কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বর্ণিত নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ করে স্বচ্ছ প্রকিয়ায় মেধা, দক্ষতা ও সততার নিরিখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নব দিগন্তের সূচনা হয়।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্রীকরণ নিশ্চিত করতে গত বছরের ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুলস অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে প্রস্তাব পাঠানো হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রিটে আগামী ৩ মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। অন্তবর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতকরণে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
যতদ্রুত সম্ভব বিচার বিভাগ থেকে সব প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে, সুপ্রিম কোর্টের সেবার মানোন্নয়নে প্রধান বিচারপতি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই ১২ দফা নির্দেশনার যথাসম্ভব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টে প্রতি মাসে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা নিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ তাদের নিজ নিজ দপ্তর কর্তৃক সেবা সহজিকরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেন। সুপ্রিম কোর্টের মত জেলা আদালতসমূহেও অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশের বিচার বিভাগে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বিচারসেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২ জানুয়ারি থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানি সংক্রান্ত একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধায়ন ও উদ্ভাবনে উক্ত বেঞ্চের সব কাগজাদি অনলাইনে জমা দিতে অনলাইন প্লাটফর্ম প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের অপর একটি কোম্পানি বেঞ্চে কাগজমুক্ত বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বেঞ্চসমূহেও কাগজমুক্ত কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রধান বিচারপতির রয়েছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নির্দেশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতে উপস্থিত সব আসামির আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা আবশ্যক, তাই আদালতে উপস্থিত আসামিদের কেউ যেন আইনগত সহায়তা বঞ্চিত না থাকেন। এটি নিশ্চিত করতে অধস্তন আদালত/ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে উক্ত আসামির জন্য লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল থেকে আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া, উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে আদালতে উপস্থিত কোনো আসামির পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত থাকলে উক্ত আইনজীবী যেন নির্বিঘ্নে ও বাধাহীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহযোগিতার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ রহিতক্রমে গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে জেলা জজশিপ ও সেশনস ডিভিশন পৃথককরণ এবং সংশ্লিষ্ট জজশিপ ও সেশনস ডিভিশনের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ২১ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। দেশের অধস্তন আদালতসমূহে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফলে বিচারকের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে মামলা জট ও দীর্ঘসূত্রিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশেষত দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হচ্ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগের ফলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ হতে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক দায়রা বিভাগ পুনর্গঠন করা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
রোডম্যাপে বিচার বিভাগে মেধার বিকাশসহ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ চালুর ঘোষণা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচার সেবায় বিচারপ্রার্থী জনগণের অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫ এর অধীনে গঠিত সার্ভিসের বিচারিক পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠিত কমিটি এ বিষয়ে ইতিমধ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। কমিটির গত ২ সেপ্টেম্বরের সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ইতিমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১টি পদসহ মোট ২৩২টি পদ সৃষ্টি হয়েছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হলেও এ সংক্রান্ত রিভিউ দরখাস্তটি অনিষ্পন্ন ছিল। গত বছরের ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ উক্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হলে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করলে গত ১৯ নভেম্বর তাঁদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতির বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি তাদের বেঞ্চ প্রদান থেকে বিরত থাকেন। তাদের মধ্যে আটজনের বিষয় সুরাহা হয়েছে। অপর চার বিচারপতির বিষয়ে কাউন্সিলের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
রোডম্যাপে অধস্তন আদালতের বিচারকের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত বৈষম্য দূরীকরণে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আগত বিচারপ্রার্থীরা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে, সেবা গ্রহণ বিষয়ে অসুবিধার মুখোমুখি হলে তাকে সহায়তা করতে হেল্পলাইন নাম্বার চালু হয়। একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা উক্ত হেল্পলাইন পরিচালনা করেন এবং সেবাগ্রহীতাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে থাকেন। ওই হেল্পলাইন স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গত জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় হেল্পলাইনটি চালু হয়। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে হেল্পলাইন নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল অ্যাপ সার্ভিস চালু রয়েছে।
গত ১৪ মে প্রধান বিচারপতি নাগরিকদের বিচার সেবায় অভিগম্যতা এবং বিচার সংক্রান্ত অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে সব অধস্তন আদালতে বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে বাধা ও অনিয়ম দূর করতে দেশের ৬৪ জেলায় ও ৮টি মহানগরে সুপ্রিম কোর্টের আদলে হেল্পলাইন চালুর ঘোষণা দেন। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি সার্কুলার গত ১৩ মে ইস্যু করা হয়। জেলা পর্যায়ে হেল্পলাইন সার্ভিস ফলপ্রসূ করতে উক্ত সার্কুলারে প্রতি জেলায় ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগ মূলত দেশের জনগণের সেবার জন্যই গঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা এবং তা পূরণে বিচার বিভাগের কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে চলতি বছর প্রধান বিচারপতি দেশের সকল বিভাগীয় শহরে ইউএনডিপির সহায়তায় জুডিশিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যান্ড ইফিশিয়েন্সি শীর্ষক রিজিওনাল কনফারেন্স আয়োজন করেন। সেখানে বিচারক, আইনজীবী, উন্নয়ন সহযোগীসহ নানা অংশীজন অংশগ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপের বাস্তবায়নের বাস্তব রূপরেখা তৈরির মূল ভিত্তি হিসেবে উক্ত স্টেকহোল্ডার মিটিংসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিচার ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক বিচার ব্যবস্থা হিসেবে উন্নীত করতে আধুনিকায়নের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী যেমন—ইউএনডিপি, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট, জিআইজেড, ইউনিসেফ, জাইকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনার করেছেন এবং প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। বিদেশি এই সকল উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় প্রধান বিচারপতির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন দেশের যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি তাদের নিকট হতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।
এছাড়া, প্রধান বিচারপতি তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন। সেকল দেশের বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়নের আদলে কিভাবে দেশের বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা যায় সে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পারস্পরিক দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং উক্ত দেশের বিচারব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি কেবল দেশের মধ্যেই নয় বরং দেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি তাঁর রোডম্যাপ ভাষণে বিচারকগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে তিনি গত ৬ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি এস এম এমদাদুল হককে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ১৩ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট হতে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের ৩০ শতাংশ বিচারিক ভাতা বিদ্যমান পে-স্কেপ হতে প্রদান সংক্রান্ত একটি পত্র আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়, যা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সরকারের অন্যান্য কর্মবিভাগের কর্মকর্তাদের মতো বিচারকগণের সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেন এবং এ লক্ষ্যে গত বছরের ১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনুকূলে সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হয়।
সারা দেশে অবস্থিত আদালতসমূহের প্রাঙ্গণসহ আদালতে কর্মরত বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি নানামুখি পদক্ষেপ নেন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এছাড়া, আদালত ও আদালতে কর্মরত বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্দেশনা দিয়ে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়।
গত বছরের ৭ জানুয়ারির সংস্কারকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষের উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকৃত মূল ভবন ও এজলাস কক্ষ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হলো।
রোডম্যাপে বিচার সেবার আধুনিকায়নসহ দ্রুততম সময়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত চৌকি আদালতসমূহে আগত বিচারপ্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত বিচার সেবা নিশ্চিতে চৌকি আদালতসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রয়োজনীয় ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহের জন্য নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনার আলোকে গত ২ জুলাই দেশের ৪০টি চৌকি আদালতের এজলাস ও দপ্তরে ব্যবহারের জন্য মোট ৭১টি ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট ২৩টি জেলায় বর্তমানে মোট ৪০টি চৌকি আদালতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত উক্ত চৌকি আদালতসমূহে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের কার্যক্রম পরিচালতি হয়ে থাকে। উক্ত আদালতসমূহে সিনিয়র সহকারী জজ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সরবরাহকৃত উক্ত কম্পিউটারসমূহ চৌকি আদালতসমূহের কার্যক্রমে গতিশীলতার সঞ্চার করবে।
দেশের আদালতসমূহের বিচার কাজে গতিশীলতা আনতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার আলোকে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জেলা আদালতসমূহে এ পর্যন্ত মোট ৪০০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার দেওয়া হয়। এছাড়া, উক্ত সময়ে দেশের ১২০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে সুপ্রিম কোর্ট ল্যাপটপ প্রদান করেছে।
প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছরে বিচার বিভাগে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের ধারণাকে বাস্তবায়নের এক স্পষ্ট প্রতিফলন। এটি প্রত্যাশিত যে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আগামী দিনে আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বমানের উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে—সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের মন্তব্য।
এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু আর এখন কেবল মৌসুমি বা শহুরে কোনো রোগ নয়। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রায় সব মৌসুমেই মানুষের জীবনে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
১ ঘণ্টা আগেবিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মনোযোগ যখন কমে আসছে, তখন এই বিষয়টিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন সাংবাদিক, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
২ ঘণ্টা আগেজুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আজ শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদের এলডি হলে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
৩ ঘণ্টা আগেরাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ২৯টি মামলার আসামি মো. বশির ওরফে কামরুল হাসান ওরফে জুয়েল (৫৩) গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
৩ ঘণ্টা আগে