leadT1ad

হাসিনার বিচারে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হলো ট্রাইব্যুনালে

তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার হচ্ছে। আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনের অধীনে এর আগে দুই ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি রায় হয়েছে।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৪৩
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়েছে।

আজ রোববার (১২ অক্টোবর) তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার হচ্ছে। আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনের অধীনে এর আগে দুই ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি রায় হয়েছে।

যুক্তিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলের ফিরিস্তি তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম। ১/১১-এর সেনা শাসনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, দাবি আদায়ের নামে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সেনা সমর্থিত শাসন এনেছে। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন।

‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। এর বিচারের ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। ওই সময় দেশে হাসিনার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিলো। আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি ও মাইন্ডসেট এই ট্রাইব্যুনালের সামনে আমরা এনেছি।’

‘শেখ মুজিবের আমলে রক্ষী বাহিনী দিয়ে নাগরিকদের রাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এই কাজটি হাসিনার আমলে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী করেছে গত ১৫ বছরে, আয়নাঘর বানিয়ে। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি আমরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছি।’

গুমের বিষয়ে তাজুল বলেন, তখন পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইত না। হাইকোর্ট বলতো, গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব। এ বিষয়ে হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘১৯৭২ সালে রক্ষীবাহিনী গঠন করে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ওই সময় এই বাহিনীর মাধ্যমে ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে মুজিবের আমলেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মেজর (অব.) এমএ জলিলের নির্বাচনী ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে ছিনিয়ে ঢাকায় এনে তার প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতি, দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের ঘটনায় অফিশিয়ালি ২৭ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে, বাস্তবে এর সংখ্যা আর বেশি। সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর শেখ মুজিব সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কোথায় সিরাজ শিকদার!’

১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ও দেশের বাইরে থেকে আসা ত্রাণ লুটপাট এবং বিদেশে পাচার ও বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, তখন দুই আনার লবণের দাম হয়েছিল ৮০ টাকা। ওই সময় অভাবে কারণে মানুষ ডাস্টবিন থেকে কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করে খেয়েছে। অথচ, ওই সময় শেখ মুজিবের বাসভবনে তখন ফরাসি সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। তাঁকে মুজিব জিজ্ঞেস করেন, বাংলা নাকি চাইনিজ খাবার খাবেন। তিনি চাইনিজে খেতে চান। পরে পাশের কামরায় গিয়ে দেখেন, খাসি, চিতল মাছসহ বাংলা খাবারের প্রাচুর্য রয়েছে টেবিলে। তাঁর একটি বইয়ে ওই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সেই বইয়ে ফালাচি লিখেছেন, 'আহা! আমি কেন চাইনিজ খেতে রাজি হলাম।

এ সময় আদালত জানতে চায়, আলোচ্য মামলায় এই ঘটনা দিয়ে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন।

জবাবে তাজুল বলেন, এটা আওয়ামী লীগের অপরাধী মনের পরিচায়ক। এটা সামনে না থাকলে তাদের শাসনামলের নমুনা জাতি বুঝতে পারবে না। তাই এই পটভূমি বিচারের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে। তবে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা তৈরি করে বাকশাল। এ সময় পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা বই ‌‌'স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ'; মওদুদ আহমদ এবং মহিউদ্দিন আহমেদের এ বিষয়ে লেখা একাধিক বইয়ের উদ্ধৃতি দেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিলো দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। এটা ছিলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, যাতে ইচ্ছামত নির্বাচন করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় জুডিশিয়াল কিলিং, এর মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসি দেওয়া হয়। হাসিনাকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, 'আপনি (একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচার করেন।' হাসিনা জবাব দেন, 'বিচার করার জন্য প্রমাণ কোথায় খুঁজে পাবো।' প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, 'প্রমাণের ব্যবস্থা আমি করবো।'

বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাধা ছিলো দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। এটা ছিলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ।

এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, বিচারকরা যা কিছু তা করবে, এর একটা নিয়ন্ত্রণ বা জবাবদিহি থাকা দরকার। আমি মনে করি, এর জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকা দরকার।

তাজুল বলেন, এ ধরনের একটা কাউন্সিল আছে, যেটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একজন সদস্যও যদি আইন ভঙ্গ করেন, তবে তখন কী হবে।

ক্রসফায়ারের নির্মমতা বর্ণনা করতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুরে একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়, তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে আগুন লেগে যায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হা-হা করে হাসছিল। আমরা তদন্তের সময় এ বিষয়ে একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাথায় কেন গুলি করা হয়?

তারা উত্তর দেয়, 'মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হয়।' এখান থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সময় ছাত্রদের পাখির মত গুলি করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা বোঝাতে চাই যে, এই ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি, এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্র্যাকটিস।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘১৯৭২ সালে রক্ষীবাহিনী গঠন করে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। ওই সময় এই বাহিনীর মাধ্যমে ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে মুজিবের আমলেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

গুমের বিষয়ে তাজুল বলেন, তখন পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইত না। হাইকোর্ট বলতো, গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব। এ বিষয়ে হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে।

এর আগে ৮ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনাল। সেই অনুযায়ী আজ রোববার সকালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে প্রসিকিউশন। আদালতে আসামি হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে, ৮ অক্টোবর প্রসিকিউশনের পক্ষে সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়। আসামিরা পলাতক থাকায় আইন অনুযায়ী তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়েই এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এর পরের ধাপই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কের পরেই মামলাটি রায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।

এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন জন আসামি। তারা হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে মামুন পরে রাজসাক্ষী হিসেবে হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার সাক্ষ্য মামলায় অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে প্রসিকিউশন সূত্র।

Ad 300x250

সম্পর্কিত