leadT1ad

সন্তোষে ভাসানীর গড়া প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকই বিলুপ্তির পথে

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক

ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে অবস্থিত সন্তোষ এলাকা একসময় ছিল মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মানবসেবা, শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসংস্কারের কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে প্রায় ২৫টি শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা দ্রুত অবনতি হচ্ছে— যার অর্ধেক ইতিমধ্যে বিলুপ্ত, আর বাকিগুলোও জীর্ণদশার দিকে এগোচ্ছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এ অধ্যায় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মানুষ ও মাভাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা।

ভাসানীর হাত ধরে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় এখন চোখে পড়ার মতো। ঐতিহাসিক মুসাফিরখানার টিনশেড ঘর প্রায় ধসে পড়েছে। নার্সারি কিণ্টারগার্টেন স্কুল ভবনটিও ধ্বংসপ্রায়।

অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে পীর শাহজামান, রাবেয়া বসরী ও শাহ এনায়েতউল্লাহ হোস্টেলের কার্যক্রম। বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সূচিশিল্প স্কুল ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। হারিয়ে গেছে সৈয়দ হোসেইন আহমদ মাদানি গ্রন্থাগার, ড. মীর ফখরুজ্জামান পাঠাগার, নার্সারি বাগান এবং ভাসানীর নিজস্ব পত্রিকা ‘হক-কথা’র ছাপাখানা।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা ভাসানীর নামে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরের। ১৯৬৭ সালে চীন সফরে মাও সেতুংয়ের উপহার দেওয়া ঐতিহাসিক ট্রাক্টরটি এখন ধ্বংস হতে বসেছে। ভাসানীর ‘ওফাত বার্ষিকী’তে নামমাত্র রঙ করা হলেও অন্যান্য নিদর্শনের অবস্থাও শোচনীয়।

সন্তোষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সংগৃহীত ছবি
সন্তোষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সংগৃহীত ছবি

মাভাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এ ঐতিহাসিক ক্ষতি রোধে শক্তিশালী উদ্যোগ দরকার। বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি (বিএমবি) বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ ইমন বলেন, ‘মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর হাতে গড়া এই এলাকাটি একসময় ছিল শিক্ষা ও মানবসেবার এক অনন্য কেন্দ্র। ঐতিহাসিক মুসাফিরখানা, নার্সারি স্কুল এবং কারিগরি কেন্দ্রসহ সবকিছুই কালের সাক্ষী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশাল ঐতিহ্যের জীর্ণদশা এবং একের পর এক স্থাপনা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দেখে আমরা গভীরভাবে ব্যথিত। আমরা আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ভার এককভাবে না নিয়ে, বরং সরকারি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমাদের এই ঐতিহ্যগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন, যাতে সেগুলো সুরক্ষিত থাকে এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে পারে।’

ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স (এফটিএনএস) বিভাগের শিক্ষার্থী সমাপ্তি খান বলেন, ‘মওলানা ভাসানী আদর্শ এবং তাঁর মানবসেবার যে দর্শন ছিল, সেগুলোর অসংখ্য স্মারক বহন করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। হোস্টেল, পাঠাগার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এগুলো ভালোভাবে সংরক্ষিত থাকলে শিক্ষার্থীরা সরাসরি তাঁর কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারত। তাই, অবশিষ্ট ভবনগুলোর প্রতি অবিলম্বে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। ভাসানীর গড়া প্রতিষ্ঠান ও স্মারকগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সঠিক মূল্যায়ন করে পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করা এখন সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি।’

মাভাবিপ্রবি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হ্নদয় হোসাইন বলেন, ‘আমরা জানি এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ এবং এর জন্য বিপুল সরকারি অর্থের সংস্থান প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা, কর্তৃপক্ষ যেন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি বাস্তবসম্মত ও ধাপে ধাপে কাজ করার পরিকল্পনা তৈরি করে। অন্তত যে নিদর্শনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোকে আগে বাঁচানোর চেষ্টা করা হোক।’

মওলানা ভাসানীর নাতি আজাদ খান ভাসানী বলেন, ‘মওলানা ভাসানী ছিলেন শোষিত মানুষের আপসহীন নেতা। তিনি কেবল রাজনীতিক ছিলেন না, ছিলেন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় অর্ধেক বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় আমরা ব্যথিত। এই স্মৃতিচিহ্নগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য অধ্যায়।’

মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক দরবার হল। সংগৃহীত ছবি
মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক দরবার হল। সংগৃহীত ছবি

তিনি আরও বলেন, ‘আমি সরকারের প্রতি বিশেষ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং মাভাবিপ্রবি প্রশাসনের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা কালক্ষেপণ না করে এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করুন। অবিলম্বে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে ভাসানীর সমস্ত স্মৃতি ও নিদর্শন স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।’

মাভাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, মওলানা ভাসানীর স্মৃতিধন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এলাকায় অবস্থিত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে নেই। তবু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হিসেবে আমরা ভাসানীর প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিতভাবে সহায়তা করে থাকি। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বা সংস্কারে ত্রুটি থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালে আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করব।’

সাম্প্রতিক পদক্ষেপের বিষয়ে উপাচার্য জানান, ‘ভাসানীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষিত ভাসানী রিসার্চ সেন্টারটি আমরা এবার সংস্কার করেছি। ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ঐতিহাসিক ট্রাক্টরটি সংস্কার করার চেষ্টা চলছে। সফলভাবে ভাসানী মেলা আয়োজনের বিষয়েও সার্বিক তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত